আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সময়ের কথা



সময় নিয়ে আমি একবার ভারি মুশকিলে পড়ে গিয়েছিলাম। ফিরে ফিরে মাথার ভেতর একই প্রশ্ন- সময় কী? আমরা সময় দেখি না। দেখি ঘটনা। কাল এ সময় চা খাচ্ছিলাম। এখন লিখছি।

একটু পরে বেরুবো। এখানে খাওয়া, লেখা ও বেরুনো ঘটনা। এগুলো ঘটেছে বা ঘটবে কাল, এখন ও পরে। সময়ের চিরন্তন প্রবাহকে খণ্ডিত করে আমরা এরকম নাম দিয়েছি। তা হলে ঘটনা থাকে সময়ের ভেতর।

গ্লাস যেমন পানি ধারণ করে, সময়ও তেমনি ঘটনার আধার। এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। গোলটা হল, ঘটনা সময়ের মধ্যে থাকে- এর অর্থ কি এই যে, সময় বাস্তব অস্তিত্বময় কোনও সত্তা? কারণ ধারণ করতে পারা একটা ক্ষমতা, যার অস্তিত্ব নেই, তার ক্ষমতা থাকবে কী করে? বস্তু মাত্রেরই আণবিক অস্তিত্ব আছে। কিন্তু সময়ের আণবিক অস্তিত্ব আছে, এমন দাবি কেউ করে নি। তবে কি সময় অবস্তু? শুধুই ধারণা? যদি তাই হয় তবে সেই ধারণা মনে কীভাবে আসে? সময়ের ভাব কি অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আসে, নাকি সময়ের ভিত্তিতে আমরা অভিজ্ঞতাকে অনুধাবন করি? আমার আসল মুশকিল এইখানে না, আরো স্পর্শকাতর জায়গায়।

তর্কটা ধর্মতাত্ত্বিক। সময় কি সৃষ্ট? যা বাস্তব, তাকে সৃষ্ট হতে হবে। যদি সময়কে অবাস্তব বলি, বিপদ। প্রমাণ করতে হবে আমি বাস করছি সময়হীনতায়, আমার বয়স বাড়ছে না, ফলে আমি মরবোও না। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবই কল্পনা।

অন্যদিকে যদি বলি বাস্তব তবে জানতে হবে তা সৃষ্ট না অসৃষ্ট। ভাবতে গিয়ে মনে হলো, কুয়াশায় পথ খুঁজে পাচ্ছি না। ধরা যাক সৃষ্ট। এ ধরে নেওয়া আরও কিছু ধারণাকে ধরে নিয়ে আসে: আল্লাহ এ জগৎ সৃষ্টি করেছেন কোনো এক সময়ে- কিন্তু সময়কে সৃষ্টি করেছেন কোন সময়ে? সৃষ্টি বলতে একসময় হয়তো কিছুই ছিলো না; কিন্তু সময় ছিলো না, এটা কল্পনা করা যায় না। তবে কি সময় অনাদি? কুরআনে আছে, একদিন সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে।

তারপর পুনর্সৃষ্টি। এ 'তারপর' একটা সময়; মানে সময় ধ্বংস হবার নয়। তাহলে কি সময় অনন্ত? সময় পৃথিবীতে আছে, বেহেশতেও আছে। এ দুয়ের বাইরেও সবখানেই আছে। সময় কোথাও সীমিত নয়।

অসীম? গোল, চৌকো- এমন আকারও জানি না। তা হলে সময় নিরাকার? কিন্তু সত্তাগতভাবে তো নয়ই, গুণগতভাবেও আমরা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে বা কিছুকে শরিক বা সদৃশ মনে করি না। কাজেই সময় বলে সত্যি যদি কিছু থাকে, তো তাকে নিজের মতোই থাকতে হবে। আল্লাহর মতো নয়। আল্লাহর পরম একতায় ও অনন্যতায় কোনও মিশ্রণ গ্রাহ্য নয়।

শুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন বিশ্বাস গঠনের জন্যেই সময়ের প্রকৃতি বোঝা দরকার। আল্লামা ইকবালের কথায় : "মুসলিম তামাদ্দুনের ইতিহাসে শুদ্ধ প্রজ্ঞার ও ধর্মীয় মনস্তত্ত্বের ক্ষেত্রে যে আদর্শের সাক্ষাৎ মেলে সে হচ্ছে অসীমকে পাওয়া ও উপভোগ করা। এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি যে তামাদ্দুনের তাতে সময় ও কালের সমস্যা একটি জীবন-মরণ প্রশ্ন হয়ে ওঠে। " আলবৎ সত্যি কথা। সময়ের আসল রূপ না বুঝে ইসলামী আকিদার অনেকখানিই ব্যাখ্যা করা যায় না।

তবে বিষয়টা দর্শনের আলোচ্য। আর দার্শনিকরা যে ভাষায় আলোচনা করেন তাতে আলোকপাতের চে' কুয়াশাপাতই বেশি হয়। আমরা বহু মতের ভিড় থেকে নিজের জ্ঞান অনুযায়ী সত্যের আলোকরেখা চিনে নেবার চেষ্টা করবো। মুসলিম চিন্তাগোষ্ঠী আশারিয়ার মতে, সময় হচ্ছে প্রতিটি বর্তমান মুহূর্ত 'এখন' এর আনুক্রমিক ধারা। একটি এখন, দু'টি এখন, অসংখ্য এখন? দুটি এখনের মাঝখানে তাহলে কী আছে? সময়হীন শূন্য? অদ্ভুত! সময় আলু, নাকি মুরগির ডিম! সত্যকে বুঝতে যে প্রজ্ঞা দরকার, এ দীন সম্প্রদায়ের তা ছিলো না।

ফলে সূক্ষ্মদর্শী মুতাযিলার সঙ্গে স্থূল দ্বিমত পোষণ ছাড়া ইতিহাসে এদের আর কোনো কৃতিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ইমানুয়েল কান্ট মনে করেন, সময় হলো সংবেদনের আকার। এটি জ্ঞাতা মনের আধার। এর বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। কিন্তু নিটশে মনে করেন, স্থান ব্যক্তিনিষ্ঠ হলেও সময় তা নয়।

তাঁর মতে সময় সত্তাবান এবং একটি অসীম প্রক্রিয়া। ইমাম গাযালীর ধারণা, সময় ও কাল মূলত বিভিন্ন বস্তুর সম্পর্কবিশেষ। এ সম্পর্ক আল্লাহ-সৃষ্ট। এর জ্ঞান আল্লাহই আমাদের দিয়েছেন। তিনি দার্শনিক কান্টের সঙ্গে এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন যে, সব ধরণের অভিজ্ঞতা লাভের পূর্বশর্ত এই স্থান ও কাল।

আমরা স্থান-কাল ভিন্ন কোনো বস্তুর কিংবা কোনো বস্তু ভিন্ন স্থান-কালের কল্পনা করতে পারি না। অভিজ্ঞতা স্থান-কাল সম্ভব করে তোলে না বরং স্থান-কালই অভিজ্ঞতা লাভের প্রাথমিক উপায়। নিউটনের মতে সময় আপেক্ষিক নয়; নিরপেক্ষ। আল্লামা ইকবালের তাতে আপত্তি। তিনি বলেন, সময়ের স্বাধীন সত্তা স্বীকার করে যদি ধরে নিই তা স্বীয় স্বরূপে সমভাবে প্রবাহমান; তাহলে আমরা বুঝতে পারি না কীভাবে কোনো বস্তুকে সময়ের স্রোতে ডুবিয়ে দিলে তার ওপর সময় ক্রিয়া করে, এবং সে বস্তুটি যাকে এমন করা হয়নি তা থেকে পৃথক হয়।

সময়কে উপানুমানে বুঝতে গেলে তার আদি, অন্ত ও সীমার কোনো সন্ধান মেলে না। প্রবাহই যদি সময়ের প্রকৃতির শেষ কথা হয় তবে প্রথম প্রদত্ত সময়কে বুঝতে দ্বিতীয় একটি সময়ের প্রয়োজন এবং দ্বিতীয়টিকে বুঝতে তৃতীয় আরেকটি। এভাবে অসংখ্য সময়ের উৎপত্তি হবে। কাজেই সময়কে বিষয়ী দৃষ্টিতে বিচার করা ঠিক নয়। কারণ আমরা আণবিক সময় আল্লাহর ওপর আরোপ করতে পারি না।

ইকবাল মনে করেন, কেবল চেতন অভিজ্ঞতাতেই কালের সত্যিকার রূপ প্রস্ফূটিত হতে পারে। কাজেই কালের প্রকৃতি বুঝবার জন্যে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণই শুদ্ধ পথ। তিনি সাধারণভাবে স্থান-কাল আপেক্ষিকতাবাদের সঙ্গে একমত। তিনি হোয়াইটহেডের সঙ্গেও একমত যে, গতিময় শূন্যে প্রকৃতি একটি স্থির তথ্য নয়; বরং প্রকৃতি হচ্ছে ঘটনার একটি কাঠামো। প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ক্রম-সৃষ্টি-প্রবাহ।

স্থান-কাল আপেক্ষিক এবং বাস্তব। এ দুয়ের মধ্যে কাল অধিকতর মৌলিক। যদিও সমস্ত বস্তুর মূলে রয়েছে স্থান ও কাল, তবু এদের সম্পর্ক দেহ-মনের সম্পর্কের মতো। কাল হলো স্থানের মন। আমাদের জাগতিক এবং মানসিক অস্তিত্বের মতো 'খুদি'র আন্তরজীবনেরও দু'টি দিক আছে।

কদরদানমূলক ও ক্ষমতামূলক। কদরদান খুদি শুদ্ধ কাল অর্থাৎ অনুক্রমহীন পরিবর্তনের ধারণা দেয়। ক্ষমতামূলক খুদির প্রকাশ ধারাবাহিক কালের মধ্যে। ইকবাল বার্গসঁ'র মতো বাহ্যিক ও অন্তর্জগতের নিত্য পরিবর্তনের মধ্যে অনুক্রমহীন কাল বা শুদ্ধকালের ধারণায় বিশ্বাস করেন। পরম খুদির সাক্ষাৎ মেলে এ বিশুদ্ধ কালেই।

ম্যাকটেগার্ড ও আরো কতিপয় চিন্তাবিদ শুদ্ধকাল ও ধারাবাহিক কালের পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারেন নি। সম্ভবত এ জন্যেই তাঁরা কালের সত্তা অস্বীকার করাকে সম্ভব বলেন। তাঁরা স্বীকার করেন শুধু কালের ধারাবাহিক প্রকৃতিকেই। ইকবাল বলেন, যদি আমরা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতকে কালের প্রয়োজনীয় অঙ্গ মনে করি, তাহলে কালকে আমরা একটা সরলরেখা বলে কল্পনা করি। এ রেখার কিয়দংশ আমরা ভ্রমণ করে পেছনে ফেলে এসেছি আর কিছু অংশ সামনে ভ্রমণের বাকি রয়ে গেছে।

সময়ের এরূপ ধারণা সময়কে একটি সৃষ্টিধর্মী বৈপ্লবিক গতি না করে একে সম্পূর্ণ অনড় করে তোলে। ফলে ভবিষ্যৎ পূর্ব থেকেই নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় সত্য, পূর্ব-নির্ধারিত নয়। কাজেই সময়ের প্রকৃত রূপ যাঁরা ঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেন না, তাঁরাই সময়কে এমন রেখা হিসেবে কল্পনা করেন। ইকবাল বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করতে চাই যে সময়টা সত্তার মধ্যে একটি অপরিহার্য উপাদানরূপে বিরাজ করছে।

কিন্তু প্রকৃত সময় ক্রমিক সময় নয় যাতে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের পার্থক্য অপরিহার্য। প্রকৃত সময় হচ্ছে খাঁটি বা বিশুদ্ধ সময় অর্থাৎ পর্যায় বা অনুক্রমহীন পরিবর্তন। এ কাল অতীত-ভবিষ্যৎরহিত এক অনন্ত বর্তমান। এ কাল আল্লাহর পরম গুণ -- অসৃষ্ট, অনাদি, অনন্ত, অসীম ও নিরাকার। এ কাল সম্পর্কেই হাদীসে কুদ্সীতে আল্লাহর বাণী : 'আনা দাহর', আমিই সময়।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।