ঘুমটা ভেঙ্গে গেল,ভোর হচ্ছে সবেমাত্র। ছুটির দিনে এত তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙ্গার কোন কারন নাই,পরপর ২ দিন ছুটি। পাশে সুষ্মি নাই,কাল রাতের ঝগড়ার ফল। ঝগড়াড় এক পর্যায়ে আমি চুপ হয়ে যাই,আমার উপর যত রাগ,অভিমান সব ফুলঝুড়ির মত ফুটতে থাকে তখন। এসব শুনতে শুনতে কালকে কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না।
পর্দার ফাক দিয়ে বাইরে তাকাতেই সাদা তুষারে ঢাকা বাসার সামনেরর লনটা চোখে পড়ল, চমৎকার দেখাচ্ছে। রাতে তুষারপাত হয়েছে,মিস হয়ে গেল। আমি আর সুষ্মি দুজনেই তুষারপাত অনেক পছন্দ করি। শেষ যেবার তুষারবৃষ্টি হল আমরা দুজনে হাতে হাত ধরে বাসার সামনের এই লনটাতে হেটে বেড়িয়েছিলাম,কিছুক্ষন পর শুরু হয়েছিল বরফ ছোড়াছুড়ি। সেটা ছিল সুষ্মির দেখা প্রথম তুষারপাত।
বাসায় এসে এই হিমশীতল ঠান্ডায় কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বারান্দায় বসে সুষ্মি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর আমি ওর সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। এসব ভাবতে ভাবতে মনটা ভাল হয়ে গেল। সুষ্মি নিশ্চই ড্রইং রুমের সোফায় ঘুমাচ্ছে,অনেক অভিমানী মেয়ে। আমার উপর তো রাজ্যের অভিমান। আমারও ভালই লাগে,আমার উপর করবে না তো কার উপর করবে?ভালটাও তো আমাকেই বাসে,শুধু বাসেই না অনেক বেশী পরিমান ভালবাসে।
সোফায় কম্বল গায়ে বাচ্চা মেয়েদের মত জড়সড় হয়ে ঘুমাচ্ছে আমার সুষ্মি,খুব মায়া লাগছে,আদর করতে ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু ঘুম থেকে জাগাতে মন চাইছে না,মুখের উপর কিছু চুল এসে এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আছে। সরিয়ে দিব?না থাক অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে। রাতের ঝগড়ার কথা মনে হয়ে নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে,অনেক বেশী কথা শুনিয়ে ফেলেছি,একদমই ঠিক হয় নি। কি করব রাগ উঠলে আশপাশের সব ভুলে যাই।
যখন সুষ্মি ওই ছেলেটাকে নিয়ে কথা বলল,আমার তো তখন ঠিক থাকার কথা না। ও কেন বলবে ওই ছেলেটা বেশ রোমান্টিক ছিল,মাঝে মাঝেই ঘুরতে যেতে চাইত,এইসব কথা কেন বলবে?আমার সাথে ইয়ার্কি করার জন্য না আমাকে রাগানোর জন্য?ওই ছেলেটা মানে যার সাথে ওর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। ওই ছেলে রোমান্টিক তাহলে আমার কাছে না এসে তো ওই ছেলের কাছে গেলেই পারত। আরো কত কি বল্লাম। আসলে মাথা ঠিক ছিল না।
মনে পড়ল সুষ্মির দুষ্টুমিতে ভরা মুখটা একটু পরে কালো মেঘে ছেয়ে গেল। আর চোখ দিয়ে জল ঝড়তে লাগল। বেশ কিছুক্ষন পর ওর অভিমানী কঠিন মুখটা আমার মুখের সামনে এনে বলল “ভুল করে ফেলছি ,অনেক ভুল করে ফেলছি যে সে বারবার বলার পরও তার সাথে একবারের জন্যও ঘুরতে যাই নাই,আর তোমার সাথে পালিয়ে চলে আসছি”। সত্যি কথা বলতে আমাদের আজকে একসাথে থাকার সম্পূর্ন কৃতিত্বটা আসলেই আমার সুষ্মির। এতে কোন সন্দেহ নাই।
আর আমি শুধু শুধু ওকে কত কথা শুনালাম। না ঠিক হয় নাই,একদমই ঠিক হয় নাই।
সুষ্মি,ও সুষ্মি ওঠ,দেখ না বাইরে কি সুন্দর তুষার পড়ে আছে।
আমার নাম সুষ্মি না,সুষ্মিতা। আর এত সকালে আমার সাথে ঢং করবা না।
ঘুমাতে দাও।
বলেই ওপাশ ফিরল সুষ্মি,রাগটা বেশ ভালই জমেছে বোঝা যাচ্ছে। ওর আসল নাম সুষ্মিতা,আমি সংক্ষেপে সুষ্মি বলে ডাকি। রাগ করলে এই কথাটা আমাকে ও মনে করিয়ে দেয়,কেন যেন তখন আমারও অনেক অভিমান হয় তখন।
সুষ্মির সাথে পরিচয়টা যেমন সাধারণভাবে হয়নি ঠিক তেমনি প্রেমটাও কখনো চুটিয়ে করতে পারি নি।
কারন ওর সাথে পরিচয় হবার ৩ মাসের মাথায় ওর বিয়ের কথা চলতে থাকে। তখন ও মেডিক্যাল ৩য় বর্ষে আর আমি ৩য় বর্ষে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি। আমাদের প্রেমের কলি তখনো ফুল হয়ে ফোটেনি অথবা আদৌ কোন প্রেম ছিল কিনা তাও জানি না। এর উপর আবার আমাদের মাঝে দুরত্বও ছিল অনেক। আমি দেশের বাইরে ব্যাচেলর করছি তখন।
এসবকিছুর পরেও শুধু জানতাম আমরা একজনের কথা আরেকজনকে না বললে থাকতে পারি না। অস্থির হয়ে যাই। যেদিন ওর বিয়ের খবরটা শুনলাম,হোচট খেলাম,বেশ ভালভাবেই হোচট খেলাম।
ছেলে ওদের পূর্ব পরিচিত ইন্টার্নী ডাক্তার,সব দিক দিয়েই ভাল। কিন্তু ওর কথা মনে হলেই মেজাজটা ভীষণ রকম খারাপ হয়ে যায়।
মনটা চায় ব্যাটার মুখের মধ্যে একটা বন মাইরা বিয়ের সখ মিটিয়ে দেই। প্রেম করলাম আমি,ভালবাসলাম আমি আর বিয়া করবা তুমি?এতটুকুও ভাবতে পারি না। মাথা জ্বালা করতে থাকে। আর যদি ভাবতে চাই ওদের ছেলেমেয়ে তো আমাকে মামা বলে ডাকবে তাহলে তো আমার মনে হয় স্ট্রোক করার মত অবস্থা। এসবের মধ্যেই দিন চলে যাচ্ছিল।
চেহারা,বেশ ভুষাতেও পরিবর্তন দেখতে পেলাম। কি করা যায় চিন্তা করি। এর মধ্যে সুষ্মি একদিন জানান দিল বিয়ের কথাবার্তা অনেক দূর চলে গেছে,এখন আর আমাদের কথা বলা উচিৎ না। আর আমরা তো প্রেমিক প্রেমিকা না। তাই এই বিয়েতে কোন সমস্যা নেই ওর,আর ওর বাবা সহজভাবে নিবে না ও যদিও বিয়ে না করতে চায়।
আসলে আমাদের মাঝে কখনো বলা হয়নি আমরা একজন আরেকজনকে ভালবাসি। আমি বুঝে গেছি আমি ওর প্রেমে ডুবে গেছি,ওর দিক থেকেও আমি তাই মনে করতাম,কিন্তু সেদিন আরেকবার স্বপ্ন ভঙ্গের মেঘ দেখতে পেলাম মনের আকাশে। শুধু কি মুখে বললেই প্রেম হয়ে যায় নাকি?এরপরদিন জানিয়ে দিল আমাদের মাঝে আর যোগাযোগ থাকা ঠিক না,এতে আমাদের দুজনেরই সমস্যা,আজকে এবং এটাই আমাদের শেষ কথা। হায়রে নারীকূল!কত সহজে কথাগুলো শুনিয়ে দিয়ে গেল। যদিও কিছুক্ষণ পরেই পাগলীটা থাকতে পারে নাই,ফেসবুকে মেসেজ দিয়েছে “আমার বাবু টা কি করে?”এইসব এইসব আরো কত কি,তখন বুঝতাম ওই কঠিন কথাগুলা বলতে ওর কত কষ্ট হত।
এরকম কাহিনী আমাদের অনেক হয়েছে। সাময়িক বিচ্ছেদের পর আবার যখন কথা বলতাম তখন কত রঙ্গীন মনে হত দুনিয়াটাকে,সেই সময়টা আমরা স্বপ্নে হারিয়ে যেতাম,ভালবাসায় মাখামাখি হয়ে চাঁদ দেখতাম,থাক না আমাদের মাঝে হাজার মাইলের ‘দুরত্ব’ নামক এক অশরিরী,তবুও তো আমরা একই আকাশের নীচে,একই চাঁদের আলো গায়ে মাখছি। দুরত্বটাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দুজন দুজনের হাত ধরে বসে থাকতাম,আর আমাদের দুশ্চিন্তাগুলোকে একপাশে রেখে শিকল দিয়ে বেধে রাখতাম। কথা বলতে বলতে আমার হাতের উপরই ঘুমিয়ে পড়ত সুষ্মি। আমাদের সম্পর্কটা তখন শুধুমাত্র প্রেমেতে বাধা ছিল না,দুজনে তখন একটা একক স্বত্তা হয়ে গিয়েছিলাম।
আমি ওকে বলতাম চল আমরা পালিয়ে বিয়ে করে ফেলি
“আমাকে কি খাওয়াবা?রাখবা কোথায়?”,
কথা ঠিক আছে কিন্তু হয়ে যাবে কিছু একটা চল কি আছে জীবনে?এরপরেই সিরিয়াস হয়ে সুষ্মি আবার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিত,যেন পরে কষ্টটা বেড়ে না যায়। ওকে বুঝাতাম না আর,যে আমার জন্য যেভাবেই পার অন্তত দেড়টা বছর অপেক্ষা কর। মনে হত ও যদি আমাকে আসলেই ভালবাসে এবং আমার ভালবাসার জোর যদি প্রবল হয় তাহলে আমাদের মিল হবেই। কিভাবে হবে তা জানি না।
সামনের শুক্রবার ছেলের বাড়ি থেকে দেখতে আসবে সুষ্মিকে,বিয়ের তারিখও ওইদিনই ঠিক করা হবে।
এর মাঝেই আমার সুষ্মি চরম একটা কাজ করে ফেলল,আমার শ্বশুড়মশাইকে পরিষ্কার জানিয়ে দিল ডাক্তারি পাশ না করে সে বিয়ের পিড়িতে বসবে না। তাদের মতেই সে বিয়ে করবে তবে ডাক্তার হবার আগে নয়। এইবার আমার পাগলীটা অনেক বেশী কঠিন। তাকে টলানো সহজ হল না,অবশেষে অনেক ধানাইপানাই এর পর দু পক্ষই রাজি হল পড়া শেষ করার পরই তাদের বিয়ে হবে। সেদিন আমার এত আনন্দ হয়েছিল মনে হচ্ছিল ওইদিনই আমরা বিয়ে করে ফেল্লাম।
আনন্দে সত্যিকার অর্থেই লাফিয়েছিলাম এই ভেবে যে অন্তত কিছুটা সময় পাওয়া গেল। ১ বছর পরই আমার গ্র্যাজুয়েশন। এরপর রুজি রোজগারের কিছু ১টা পাওয়া যাবেই। এরপর অনেক কিছুই করা যাবে,সিদ্ধান্ত ফাইনাল।
সুষ্মি মেয়েটা এমন যে কোন এক সিরিয়াল দেখতে বসলেই চোখের জল,নাকের জল এক করে ফেলে।
কিন্তু আমার সাথে কথা বলার সময় এমনটা কোনদিন করে নাই,সেদিন যেমনটা করল,কথা বলার পুরো সময়টা কেঁদেছিল। সেদিন ওর কান্না বুঝিয়ে দিয়েছিল আমার প্রতি অনেক বিশ্বাস আর ভালবাসা নিয়েই সে কাঁদছে। আমিও ওকে বাঁধা দেই নি,পাশে ছিলাম বরাবরের মত দুরত্বটাকে দূরে ছূড়ে ফেলে।
দেড় মাসের কিছু বেশী হল ওর পড়া শেষ হয়ে গেল। বিয়েও হল।
কিন্তু বাবা মা যেখানে ঠিক করেছিল সেখানে না,আমার সাথে। আমরা পালিয়ে বিয়ে করলাম। সবই প্ল্যান করা ছিল। আমিও এখন একটা রুজির পথ বের করে ফেলেছি । থাকা খাওয়া এখন আর কোন সমস্যা না।
শেষ পরীক্ষাটা শেষ হবার পরই কোর্টে গিয়ে আমরা শুভকাজটা সেরে ফেলি,এরপর দুই জনের বাসায় জানাই। সেদিকে ততক্ষণে লঙ্কাকান্ড শুরু হয়ে গেছে। যাই হোক এগুলা সব ঠিক হবে একদিন,কিন্তু আমরা আমাদের হারিয়ে ফেললে সেটা আর ঠিক হবে না। তিন দিনের মধে সুষ্মির ভিসা রেডি করে আবার প্রবাসে পাড়ি জমাই। ভিসার ব্যাপারে কোম্পানীর সাথে আগেই কথা বলা ছিল,তাই আর কোন সমস্যা হয় নাই।
বিয়ের পর কোথায় চুটিয়ে প্রেম করব তা না সারাক্ষণ শুধু পালিয়ে বেড়ান আর সুষ্মির বিরতিহীন কান্না দেখা। এখানে এসে অন্তত পালিয়ে থাকতে হচ্ছে না,কিন্তু সুষ্মির কান্না ঠিকই দেখতে হচ্ছে। আমাদের বিয়ের বয়স মাত্র দেড় মাস,কারো বাবা মা ই এখনো মেনে নেয় নাই। যদিও আমরা প্রতিদিনই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বেশীদিন আর লাগবে না বলে মনে হয়।
আমাদের মায়েরা আমাদের পক্ষে চলে এসেছে,এখন শুধু বাবা। চলে আসবে। সমস্যা হবে না আশা করি।
আমাদের এই মিলন মেলার গল্প বলতে বলতে কিন্তু আমি সুষ্মির রাগ ভাঙ্গানোর জন্য বাইরে থেকে ওর পছন্দের কিছু ফুল নিয়ে আসলাম,এসে দেখি ও এতক্ষণে ঘুম থেকে উঠে গেছে।
সুষ্মিতা,কিছু ফুল আনলাম তোমার জন্য
আমার দিকে না তাকিয়েই,তুমি এত সকালে বাইরে গেছ কেন?শীতের মধ্যে?মাফ্লার নিয়েও তো যাও নাই।
তোমার ঠান্ডার সমস্যা তুমি জান না?এত ঢং কর ক্যান তুমি?
ফুলগুলা নিবা না?
না নিব না। আমার সাথে এত খারাপ ব্যাবহার কর ক্যান?
আর করব না।
সবসময়ই বল তুমি,আবার ঠিকই কর। আবার ঢং করে ফুল নিয়ে আসছে!
ঢং না তোমার ভাল লাগতে পারে এর জন্য নিয়ে আসছি,এখন দেখি তোমার ভাল লাগে নাই। ফেলে দেই তাহলে
কে বলছে ভাল লাগে নাই,সবসময়ই বেশী বুঝ তুমি।
এত্ত ভাব ধরতে পারে!এখনো একটা বার আমাকে সুন্দর করে ডাকও দেয় না,সুন্দর করে কিছু বলেও না। মনে করে ফুল দিলেই সব শেষ হয়ে যায়।
এতক্ষণে বুঝলাম মহারানীর আসল রাগটা কোথায়,ওর কাছে যেয়ে হাত দুটা ধরে,একটা সিরিয়াস কথা বলি?
কি কথা বলবা?
আমি তোমাকে ভালবাসি। জানি না কত,তবে যেদিন এই ভালবাসা থাকবে না সেদিন আমিও থাকব
এই প্রথম তুমি আমাকে সারাসরি ভালবাসি বললা,কিন্তু এই ধরনের অলক্ষুণে কথা বল ক্যান?ফাজিল ১ টা। আমিও বলব কিছু সিরিয়াস কথা তবে তার আগে আমাকে জড়িয়ে ধরতে হবে,আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবা?বেশ ঠান্ডা পড়েছে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।