আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বান্দরবনে বড় বিলাই (তখন ছোট ছিল) - ৬ (শেষ)

বান্দরবনে বড় বিলাই (তখন ছোট ছিল) - ১ বান্দরবনে বড় বিলাই (তখন ছোট ছিল) - ২ বান্দরবনে বড় বিলাই (তখন ছোট ছিল) - ৩ বান্দরবনে বড় বিলাই (তখন ছোট ছিল) - ৪ বান্দরবনে বড় বিলাই (তখন ছোট ছিল) - ৫ মামাবাড়িতে দিনগুলো একরকম স্বপ্নের মত কেটে যাচ্ছিল। অবশেষে একদিন বাড়ি ফেরার সময় হল। ভোররাতে মামা ডেকে দিলেন। ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলাম আগের রাতেই। তৈরী হয়ে নিলাম ঝটপট।

মামা বললেন, এখন অনেক ঠান্ডা লাগবে, কিন্তু পরে রোদ উঠলে আবার গরম লাগবে, এখন দুইটা জামা পরে নাও, রোদ উঠলে একটা খুলে ফেললেই হবে। আমরা মামার কথামত দুইটা জামা পরে নিলাম। বাসা থেকে বের হয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এই সময়ে আগে কখনও বের হইনি। পূর্ণিমা ছিল কি না জানি না, কিন্তু আকাশে তখনও এত্ত বড় একটা চাঁদ চারদিক আলো করে রয়েছে।

চাঁদের আলোয় খালটা আর তার উপরের কাঠের সেতুটাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোন স্বপ্নের রাজ্যে এসে পড়েছি। যা হোক, দুইটা রিকশা ঠিক করা হল। একটাতে মামী পিচ্চি মামাত ভাই আর ছোট বোনকে নিয়ে উঠেছেন, আরেকটায় মামার সাথে আমি আর মামাত ভাইদের বড়জন। রওনা দিলাম আবার সেই ১২ মাইলের মাটির রাস্তা দিয়ে। এইবার অবশ্য রিকশা নষ্ট হয়নি, তাই আগের চেয়ে কম সময় লাগল।

তবে রাস্তা কয়েক জায়গায় ভাঙা ছিল। বাইপাস দিয়ে যেতে হচ্ছিল। ঐ সময় সবাই নেমে যাচ্ছিল রিকশা থেকে, শুধু আমাকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল, আমার নাকি পাখির মত ওজন, এইজন্য। আমি আরামে ব্যাগগুলো ধরে বসে রইলাম রিকশায়। অবশ্য ভয়ও করছিল একটু একটু।

ধীরে ধীরে চাঁদ মামা বিদায় নিয়ে সূর্য মামা চলে এলেন। রাস্তায় এত রকম পাখি দেখছিলাম, সবগুলোর নাম জানতে ইচ্ছা করছিল। মামাকে জিজ্ঞেস করে করে বিরক্ত করে ফেললাম। রিকশা যাত্রা শেষে এল সেই লক্কর-ঝক্কর বাস যাত্রা। বাস স্টেশনে এসেই আমরা আমাদের একটা জামা খুলে নিলাম, সকালের ঠান্ডা এখন একেবারেই নেই।

লক্কর-ঝক্কর বাস দিয়ে আমরা গেলাম চট্টগ্রাম রেল স্টেশনে। সেখানকার ক্যান্টিনে ভাত খেতে বসলাম। পিচ্চিদের কেউই ঠিকমত খেতে পারলাম না। ভাইগুলো তো প্রায় সবই নষ্ট করল। একেবারেই স্বাদ পাচ্ছিলাম না খাবারে।

সেটা খাবারের দোষ, না কি জীবনে প্রথম ট্রেনে চড়ব সেই উত্তেজনার ফল, বলতে পারব না। ট্রেনের নাম বলতে পারব না। দুইটা সামনাসামনি বেঞ্চ টাইপের সিট নেয়া হয়েছিল। আমরা দুই বোন উঠেই জানালার পাশের দুইটা সিট দখল করলাম। হাউ-কাউ আর গরমে পিচ্চিগুলো অস্থির হয়ে যাচ্ছিল।

মামী ওদের বুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন, এই যে একটু পরেই ট্রেন ছাড়বে, তখন অনেক মজা হবে দেখ। ট্রেন ছাড়ার পর মামী বললেন, এই যে ছেড়ে দিয়েছে, আস্তে আস্তে আরও জোরে চলবে। একটু জোরে চলা শুরু করার পর যখন বললেন, এই যে দেখেছ কত জোরে চলছে ট্রেন, আমার তখন মনে হল এত আস্তে চলে না কি ট্রেন। আমি বললাম, একটু পর আরও জোরে চলবে। মামী একটু অবাক হয়ে তাকালেন, কিছু বললেন না।

আমি হতাশ হয়ে দেখলাম, ট্রেনের গতি আর বাড়ল না। মনে মনে হয়ত ভেবেছিলাম টিভিতে রোলার কোস্টার যেমন দেখি অমন জোরে ট্রেন চলবে। যা হোক, ট্রেন চলা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি আর ছোট বোন সিট ছেড়ে দিয়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম। একটা দৃশ্যও যেন ছুটে না যায়। পাহাড় দেখছিলাম অপলক নয়নে।

এত পাহাড়ও আছে আমাদের দেশে! এত সুন্দর! মাঝখানে মামা-মামী টুকটাক খাবারের জন্য ডাকছিলেন। কে শোনে কার কথা, আমরা জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি তো আছিই। পিচ্চিগুলোর জন্য মামী ফিডারে করে দুধ এনেছিলেন, কিন্তু ওরা খেতে চাইছিল না। এক ঝালমুড়িওয়ালা এলে ছোটটা খেতে চাইল। কিন্তু ওর পেট খারাপ থাকে বলে মামা না করে দিলেন।

সে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ঝালমুড়ির দিকে। এটা দেখে পাশের সিটের এক ভদ্রলোকের খুব মায়া হল। উনি ঝালমুড়িওয়ালাকে ডেকে একটুখানি মুড়ি-চানাচুর মাখিয়ে পিচ্চিকে সাধলেন। পিচ্চি সাথে সাথে হাত পেতে দিল। আর মামা জোরে একটা ধমক দিয়ে দিলেন।

পিচকার আবার অপমানবোধ ছিল। সে সাথে সাথে হাত সরিয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। ঐভাবে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুতেই তার মান ভাঙানো যায় না। পরে অবশ্য ঘুম চলে আসায় মামীর কোলে ঘুমিয়ে গিয়েছিল।

বাইরের দৃশ্য এক সময় পরিবর্তন হওয়া শুরু করল। পাহাড়ের বদলে এখন সারি সারি ধানক্ষেত, আরও নানান রকমের ক্ষেত, পুকুর, গাছপালা আসতে থাকল। আমরা এখনও দাঁড়িয়েই আছি জানালার পাশে। সন্ধ্যা পর্যন্ত ঐভাবেই ছিলাম। এরপর অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় আর কিছু দেখা যাচ্ছিল না।

এইবার দুই বোন একটু বসলাম সিটে। ট্রেনের দুলুনিতে একটু একটু ঘুমও এসে যাচ্ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলাম কমলাপুর রেল স্টেশনে। এখান থেকে প্রথমে গেলাম মামীর ভাইয়ের বাসায়। ওখানে মামী পিচ্চিদের নিয়ে থাকবেন।

কিছুক্ষণ বসেছিলাম ওখানে, কিন্তু যেখানেই বসি, মনে হয় যেন ট্রেনে বসে বসে দুলছি। স্থির হয়ে বসার চেষ্টা করছি কিন্তু দুলেই যাচ্ছি। খুব অদ্ভূত লাগছিল অনুভূতিটা, সেই সাথে অস্বস্তিকরও। যা হোক, মামা এরপর আমাদের নিয়ে আমাদের বাসায় এলেন। আমার ছোট ভাইটা ছিল মামাত ছোট ভাইটার বয়সী।

তখনও কথা তেমন বলতে পারে না, একটা-দুইটা শব্দ দিয়ে মনের সব ভাব প্রকাশ করে ফেলে। আমাকে এতদিন পরে দেখে সে খুশিতে ঝলমল করতে থাকল, কিন্তু ভাষায় আর প্রকাশ করতে পারছিল না। আমার হাত ধরে সে টুকটুক করে সারা বাড়ি হেঁটে বেড়ানো শুরু করল, আর আমাকে সব কিছু ধরে ধরে দেখাল যে সবকিছু ঠিক আছে। প্রতিটা ঘরের প্রতিটা আসবাব ধরে ধরে দেখাল। এমন কি রান্নাঘরেও নিয়ে গেল, হাঁড়ি-পাতিল ধরে ধরে বলল, এইতা এইতা।

মানে, দেখ এগুলোও ঠিক আছে। আব্বা ফোনে কথা বলছিলেন। আব্বার কাছে নিয়ে গিয়ে ধরে দেখিয়ে বলল, এইতা আব্বা। মানে আব্বাও ঠিক আছে। সবকিছুই দেখে-শুনে রেখেছে সে, বাড়ির পুরুষ মানুষ হিসেবে একটা দায়িত্ব আছে না? (ছবি কৃতজ্ঞতা: রেজোওয়ানা আপু) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।