আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বান্দরবনে বড় বিলাই (তখন ছোট ছিল) - ৫

বান্দরবনে বড় বিলাই (তখন ছোট ছিল) - ১ বান্দরবনে বড় বিলাই (তখন ছোট ছিল) - ২ বান্দরবনে বড় বিলাই (তখন ছোট ছিল) - ৩ বান্দরবনে বড় বিলাই (তখন ছোট ছিল) - ৪ প্রায় দুই সপ্তাহ ছিলাম বান্দরবনে। অনেক কিছুই ভুলে গিয়েছি। কিছু স্মৃতি আবছা আবছা মনে পড়ে। কিন্তু কিছু স্মৃতি আছে, যা এখনও মনে পড়ে স্পষ্ট। মামাবাড়ির পাশের বাড়িতে আমাদের বয়সী একটা মেয়ে ছিল।

তার সাথে পরিচয় হবার সাথে সাথেই বুড়ো আঙ্গুল ঠেকিয়ে ভাব করে আমাদের সখী করে নিলাম। খুব হাসিখুশি আর মিষ্টি ছিল মেয়েটা। আর অনেক কথা বলত। মজাই লাগত ওর সাথে গল্প করতে। যতক্ষণ সখী সাথে থাকত, ততক্ষণ সময় কাটানো নিয়ে কোন চিন্তাই ছিল না।

খুব দুরন্ত ছিল আমাদের এই সখী। তরতর করে গাছ বেয়ে উঠে যেত। আমরা লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। একটা অদ্ভুত মালা বানানো শিখিয়েছিল সে। কলাগাছের কচি পাতার আগায় একটা সুতার মত অংশ থাকে।

ঐটুকু ছিঁড়ে নিয়ে ওটাকে আস্তে আস্তে টুকরো করে নিলে ভিতর থেকে মাকড়সার জালের মত সাদা সুতা বের হয়ে টুকরোগুলোকে আটকে রাখে। এইভাবেই তৈরী হয়ে যায় মালা, টুকরোগুলো পুঁতির মত দেখা যায় তখন। এটা শিখে নেয়ার পর মামার কলাবাগানে যত কলাগাছ আছে, কোনটারও একটা পাতাও আর বাকী ছিল না মালা বানানো থেকে। মাঝে মাঝে পাতার ঐ অংশটা ছিঁড়তামও না। পাতার সাথে মালা তৈরী করে দিতাম।

সখী খুব ভালো সাঁতার জানত। মামাবাড়ির পিছনে একটা ছোট পুকুর ছিল। সখী সেখানে সাঁতার কেটে দেখাত। আমরা সাঁতার জানি না, তাই হিংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করার থাকত না। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখতাম।

ছোট বোনের আবার সাহস বেশি, আসলে দুঃসাহস বেশি বলা দরকার । সে একেবারে ঘাটে নেমে দাঁড়িয়ে থাকত। একবার এমন করে ঘাটের উপর দাঁড়িয়ে সাঁতার দেখছে। সখী মনের সুখে সাঁতার কাটছে। ছোট বোন বেশি সাহস দেখাতে গিয়ে একটু ঝুঁকে পড়ল।

ভেজা ঘাটে পা পিছলে সোজা গিয়ে পড়ল পুকুরে। আমি ভয় পেয়ে ছুটে গেলাম ঘাটে, কিন্তু কী করব বুঝে ওঠার আগেই সখী ওকে টেনে তুলল। ছোট বোন চুবানি খেয়ে উঠেই বলে, আমার স্যান্ডেল ভেসে গেছে। সখী সাথে সাথে পানি হাতড়ে একটা স্যান্ডেল খুঁজে বের করল। আরেকটা খুঁজে পাওয়া গেল না।

এক হাতে একটা স্যান্ডেল নিয়ে থপ থপ করতে করতে চলল বাসায়। মামীকে বলার পর মামী আতংকে কাঁপতে শুরু করলেন। বললেন, তোমার মামা আসার আগে জামা পাল্টে ফেল শিগগির, নইলে বাড়ি মাথায় করে ফেলবে। মামার আসার তখনও আরও দেরী ছিল। কিন্তু কপাল খারাপ থাকলে যা হয়, ছোট বোন পেছনের দরজা দিয়ে বাসায় ঢুকল জামা পাল্টাতে, আর ঠিক তখুনি সামনের দরজা দিয়ে মামা ঢুকলেন।

সেইদিন কেন যেন মামা আগে আগে চলে এসেছিলেন বাসায়। ছোট বোন একেবারে মামার সামনে পড়ে গেল। মামা ওকে এক নজর দেখেই বুঝে ফেললেন কী ঘটেছে। আর কী? মোটামুটি ঘন্টাখানেক ধরে আমাদের দুই বোন আর মামীর উপর ঝাড়ির বন্যা বয়ে চলল। ছোট বোনের দোষ, সে কেন পুকুরের এত কাছে গেল।

আমার দোষ, আমি কেন বাধা দিলাম না। মামীর দোষ, মামী কেন আমাদেরকে দেখে রাখল না। কিন্তু যাকে নিয়ে এত ঘটনা তার মাথায় তখন একটাই চিন্তা, তার স্যান্ডেল তো একটা ভেসে গেল। এক পাটি স্যান্ডেল নিয়ে সে কিভাবে থাকবে। বাসায় তার সাইজের আর কেউ নেই যে তার স্যান্ডেল পরবে।

যা হোক, খালাত ভাইকে বলে দেয়া হল যেন পুকুরে গোসল করতে গেলে একটা অনুসন্ধান চালায়। ভাইয়া ঠিকই সফল হলেন। গোসল করে আসতে আসতেই দেখা গেল তার হাসিমুখ, আর হাতে একটা পিচকি স্যান্ডেল। গোসল করতে গিয়ে না কি তার পায়ে আটকে গিয়েছিল স্যান্ডেলটা। ছোট বোন আবারও দৌড়াদৌড়ি করার সুযোগ পেল।

আমাদের এই মামাটা সেই সময় খুবই হালকা-পাতলা গড়নের ছিলেন। তাকে দেখলে খুব বেশি হলে বিশ বছরের ছোকরা মনে হত। এজন্য তার অধীনে কাজ করা লোকেরা তাকে খুব একটা মানতে চাইত না। মামার এটা নিয়ে আক্ষেপ ছিল। একজন তাকে পরামর্শ দিয়েছিল যেন মামা রোজ সকালে ব্যায়াম করে আর প্রতিদিন কাঁচা ছোলা ভিজিয়ে খায়।

এতে তার স্বাস্থ্য বাড়বে, কিন্তু মেদ হবে না। মামা সেরকমই করতেন। রোজ সকালে দেখতাম মামা ব্যায়াম করছেন। এরপর মামী আগের রাতে ভিজিয়ে রাখা ছোলা খেতে দিতেন। এই সময় আমরা চার ভাই-বোনও তার পাশে বসতাম।

আমরা তো কাঁচা ছোলা খাই না, মামাত ভাইরা মামার সাথে খেত। এই খাওয়াটাও ছিল একটা দেখার মত দৃশ্য। বড় জন একটা একটা করে ধীরে সুস্থে খেত। আর পিচ্চিটা কোন ব্রেক দিত না। একসাথে একগাদা ছোলা মুখে ঢুকিয়ে দিত।

চাবাত না, গিলতও না, শুধু ঢুকিয়ে রাখত। মামা একটু পর দিতেন একটা বকা, এই এতগুলো ছোলা মুখে দিয়েছ কেন? খেতে পারবা না কি? বকা খেয়ে পিচ্চি ভ্যাঁ করে কেঁদে দিত আর তার মুখে জমে থাকা সব ছোলা গড়িয়ে পড়ত। মামী এবার মামাকেই একটু বকে দিতেন, ছোট মানুষ, বুঝে নাকি? এইভাবে বকা দেয়? মামা এবার পিচ্চিকে আদর করে কান্না থামিয়ে বলতেন, একটা একটা ছোলা খাও, ঠিক আছে? পিচ্চি ঘাড় নেড়ে শুরু করত একটা একটা করে ছোলা মুখে নেয়া। এই নেয়াতে কোন ব্রেক থাকত না। একটা একটা করে ঢুকাতেই থাকত।

ফলাফল, আবারও মুখ ভর্তি ছোলা। মামা আবারও ধৈর্য্য হারিয়ে ধমক লাগাতেন। পিচ্চি আবারও ভ্যাঁ, সব ছোলা মুখের বাইরে। এই দৃশ্য চলত প্রতিদিন। আর আমরা দুই বোন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিতাম।

মনে করেছিলাম লেখাটা এই পর্বে শেষ করব। কিন্তু আমাদের বান্দরবন থেকে ফিরে আসার যাত্রাটাও একটা বড়-সড় কাহিনী, সেই কাহিনী দিয়েই না হয় শেষ করা যাবে। অতএব, চলবে................... (ছবি কৃতজ্ঞতা: রেজোওয়ানা আপু) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।