আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বান্দরবনে বড় বিলাই (তখন ছোট ছিল) - ২

আগের পর্ব মামার বাসার সামনে রিকশা থেকে নেমে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। একেবারে ছবির মত সুন্দর বাড়ি। টিনের চাল আর বেড়ার দেয়ালের এক তলা বাড়ি, সামনে ছোট বাগান, সেখানে নানান রকম ফুল ফুটে আছে, বাগানের মাঝখান দিয়ে ইট বিছানো রাস্তা চলে গেছে বাড়ির দিকে। বাগানের চারদিকে বাঁশের বেড়া। আর সবচেয়ে সুন্দর যেটা, তা হল বাড়ির সামনে দিয়ে একটা খাল বয়ে চলেছে, খালের উপর একটা কাঠের সেতু।

রিকশা থেকে নেমে সেতুর উপর দিয়ে গিয়ে বাড়িতে ঢুকতে হয়। সেতুর শেষ অংশটুকু অবশ্য ভয়ংকর, একটা মাত্র কাঠের তক্তা দেয়া, অ্যাক্রোবেটদের মত ভারসাম্যের খেলা দেখিয়ে যেতে হয়। অবশ্য সেটা হয়ত আমার মত পিচ্চির জন্যই ভয়ংকর। বড়রা তো অনায়াসে চলে যায় দেখি। যতবার ঐ কাঠের তক্তা দিয়ে পার হয়েছি, মনে হয়েছে আমি যদি পা হড়কে খালে পড়ে যাই, কেমনে বাঁচব? আমি তো সাঁতার জানি না।

যা হোক, আমরা মামার বাসায় ঢুকলাম। ঢুকেই বসার ঘর, এরপর দুইটা শোবার ঘর। তারপর ভিতর দিকে একটা ছোট উঠান। উঠানের একপাশে রান্নাঘর, একপাশে গোসলখানা, আর একটু দূরে বাথরুম। ঘরে ঢুকে দেখি বসার ঘরের মেঝেতে মাদুর পেতে দুই পিচ্চি ভাই ঘুমাচ্ছে।

আর মামী ওদের বাতাস করে দিচ্ছেন। আমাদের দেখে মামী খুশিতে চিৎকার করে উঠলেন। পিচ্চিদের ডেকে তুললেন, দেখ দেখ কারা এসেছে, তোমার দুই আপু। পিচ্চিরা উঠে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে। বিশেষ করে ছোটজন।

সে তো আমাদেরকে আগে দেখেনি। আর অবাক হয়ে দেখলাম, পিচ্চিটার আসলেই ঠোঁট দুটো একটু চোখা চোখা। ছোট বোন বলল, আমি স্বপ্নে যেমন দেখেছিলাম, ও দেখতে একদম ঐরকম। এর পরের অংশটুকু খুব কষ্টের। মামী খুব উৎসাহের সাথে ছেলেদের বলছিলেন, এই যে আপুরা চলে এসেছে, এরপর আমরা আপুদের সাথে ঢাকায় যাব, এরপর যাব তোমাদের দাদা বাড়ি, তোমাদের দাদার কাছে যাবে তোমরা।

এইটুক বলতেই মামা কান্নায় ভেঙে পড়লেন, ওদের দাদা আর নাই। এর কিছু দিন আগেই ওদের দাদা, মানে আমাদের নানা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। কিন্তু মামা-মামীকে কেউ জানায়নি কষ্ট পাবে বলে। মামা ঢাকায় গিয়ে খবরটা শুনেছেন। মামা অবশ্য খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন যেন আমাদেরকে কিছু খেতে দেয়।

আমরা পরিবেশ ভারী দেখে বাগানে চলে এলাম। সুন্দর সুন্দর ফুলগুলো দেখে খুব লোভ হচ্ছিল। আমি সাহস পাচ্ছিলাম না। ছোট বোন মামাকে গিয়ে বলল, আমি একটা ফুল নিই? মামা ভাবলেন ছোট মানুষ একটু ফুল চাইছে, কি আর হবে এতে, বললেন, হ্যাঁ নাও। ছোট বোন সম্মতি পেয়ে প্রথমে গোলাপ নিল।

আমিও একটা গোলাপ নিলাম। কিছুক্ষণ গন্ধ শোঁকার পর কী করব ফুল নিয়ে বুঝতে পারলাম না। পরে মামার বসার ঘরে বড় করে বাঁধাই করে রাখা মামার বসের ছবির দুই পাশে গুঁজে রাখলাম। বসের ছবি এত বড় করে বাঁধাই করে রাখার কারণ বুঝলাম না। অবশ্য বোঝার চেষ্টাও করিনি।

মামা তো সরল মনে ফুল নেবার অনুমতি দিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি তো আর জানেন না আমরা কী বস্তু। পরদিন অন্য একটা গাছে আমাদের হামলা চলল। হলুদ রঙের ফুলের দুইটা বড় বড় ঝাড় ছিল বাড়ির সিঁড়ির দুই পাশে। ঝাড় ভরে ফুল ধরেছিল গাছ দুটোয়। ফুলটার নাম ভুলে গেছি।

কেউ জানলে মনে করিয়ে দিয়েন। তো আমরা করলাম কি, মনের সুখে ঐ দুই গাছের সবগুলো ফুল নিজেদের মনে করে তুলে নিলাম। ফ্রকের কোচর ভরে শুধু হলুদ ফুল আর ফুল। নেয়ার সময় তো মজাই লাগছিল। হাতের নাগালের মধ্যে যেগুলো আসেনি ওগুলোর জন্য আফসোস হতে লাগল।

কিন্তু এরপর এই ফুল দিয়ে কী করব সেটা আর ভেবে পেলাম না। ফুলের মালা গাঁথার ধৈর্য্য আমাদের কারুর নেই। কোচর ভরে ফুল রাখতে বিরক্তও লাগছিল, কতক্ষণ এভাবে ধরে রাখব। ছোটবোন বুদ্ধি দিল, চল আমরা এগুলো খালে ভাসিয়ে দিই। কোচর ধরে রাখা থেকে মুক্তি পাব এই খুশিতেই রাজী হয়ে গেলাম।

সেই কাঠের সেতুর মাঝামাঝি গিয়ে ওখান থেকে সব ফুল খালে ভাসিয়ে দিলাম। কি যে সুন্দর লাগছিল তখন খালটা। মামা বাসায় এসে তার প্রিয় গাছ দেখে থমকে দাঁড়ালেন। তারপর বুঝে নিলেন এগুলো কার কাজ। আর্ত চিৎকার দিয়ে মামীকে ডেকে মোটামুটি একটা হল্লা লাগিয়ে দিলেন, দেখছ নাকি এই দুইটার কাজ, ফুল নিতে বলছি দেখে আমার গাছ পুরা ন্যাড়া করে দিছে, হায় হায় রে আমার সাধের ফুল গাছ।

আমরা চুপচাপ ভালো মানুষের মত বসে বসে আধ ঘন্টা ধরে চলতে থাকা মামার বিলাপ শুনলাম। পরদিন আবারও বিলাপ শুরু হল। এইবার অবশ্য কোন গাছ ন্যাড়া করিনি। ছোট বোন শুধু একটা নতুন ধরণের ফুলগাছ দেখে একটা ফুল ছিঁড়েছিল। কিন্তু গাছটা একটু দামী ছিল, মামা অনেক শখ করে কিনে এনে লাগিয়েছিলেন।

তাই এই বিলাপ। খুব সম্ভবত ফুলটার নাম ছিল মোরগ ফুল। আমি অবশ্য শুনেছিলাম মোরব্বা ফুল। আমি এই গবেষণাই অনেক দিন করেছি যে ফুলের নাম মোরব্বা কেন রাখতে গেল। যা হোক, এরপর আমাদের জন্য ফুলগাছে হাত দেয়া নিষিদ্ধ করে দেয়া হল।

ব্যাপার না। ততদিনে ফুলের মোহও কেটে গেছে। আমার মোহ তখন বাগানের কোণায় কোণায় থাকা লজাবতী গাছের প্রতি। রোজ নিয়ম করে ওগুলোকে লজ্জা পাইয়ে দিতাম। যখনই মনে পড়ত তখনই।

এক সময় লজ্জা পেতে পেতে তারা এতই কাহিল হয়ে পড়ল যে বেশরম হয়ে গেল। এরপর যতই তাদের ছুঁয়ে দিই না কেন তারা লজ্জা শরমের পরোয়া না করে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। আমিও হতাশ হয়ে ওদেরকে ছোঁয়া বন্ধ করে দিলাম। একদিন মামা বাগানে নতুন কিছু ফুলগাছের বীজ বুনছিলেন। কী কী গাছ তা জানি না।

খুব যত্ন করে মাটিতে নিড়ানি দিয়ে তাতে বীজ ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। আমরা চার ভাই-বোন মনযোগ দিয়ে দেখছি। হঠাৎ মামাত ভাইদের বড়জন নিজে একটা বীজ নিয়ে মাটিতে পুতে দিল। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম মামা রেগে না যায়। কিন্তু মামা বললেন, ঠিক আছে, একটা দিলে কিছু হবে না, তোমার লাগানো এই গাছ অনেক বড় হবে, অনেক ফুল ধরবে, সবাই তখন তোমার কথা বলবে যে ঐ যে ঐ ছেলেটা এই গাছ লাগিয়েছিল।

ওহ হো, মামার বাগানের আসল অংশের কথাই এখনও বলা হয়নি। এটা তো ছিল বাসার সামনের ফুলের বাগান। বাসার পাশে ছিল বাগানের মূল অংশ। এটা ছিল কলাবাগান। সারি সারি কলাগাছ লাগিয়েছিলেন মামা এখানে।

প্রতিটা গাছের গোড়া থেকে আবার ছোট ছোট কলাগাছের চারা গজাত। এরকম চারা কলাগাছের মাঝখানে একটা শাসের মত বের হত। মামাত ভাইদের ছোটজন এই জিনিসটা খুব পছন্দ করত। আমরা মাঝে মাঝে বাগানে হাঁটতে যেতাম পিচ্চিদের নিয়ে। ছোট ভাইটার চোখে এরকম চারাগাছ পড়লেই সে শাসটুকু ভেঙে কচ কচ করে খেয়ে ফেলত।

আমরা প্রথমে মনে করেছিলাম এটা মনে হয় স্বাভাবিক। কিন্তু এই ভাইটার পেট প্রায়ই খারাপ হত দেখে আমি একদিন মামাকে ওর এই কাহিনী বললাম। মামা সাথে সাথে বলে উঠলেন, বল কী? আগে বলবা না? আমি আরও চিন্তা করি যে পেট খারাপ হয় কেন ওর, আর খেতে দিও না ওকে ঐ জিনিস। আমি বললাম, ও তো এত তাড়াতাড়ি ওটা খেয়ে ফেলে যে আটকানো যায় না। মামা এবার পিচ্চিকে নিষেধ করে দিলেন।

কে শোনে কার কথা। পিচ্চির পেট খারাপ লেগেই থাকে। মামা ডাক্তারের পরামর্শে ওর হাগু পরীক্ষার জন্য মামীকে বলে রাখেন যেন হাগু করলে সেটা রেখে দেয় কোন কৌটায়। কিন্তু সেইখানে আরেক বিপত্তি। পিচ্চি তো আর বাথরুম ব্যবহার করতে পারে না, সে উঠানের এক কোণায় বসে হাগু করে, আর সেটা মামী দেখার আগেই কুকুর কিংবা মুরগী এসে খেয়ে ফেলে।

এরপর মামী আমাদেরকে পাহাড়ার কাজে লাগান। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয় না। আমরা মামীকে ডাকতে ডাকতেই মুরগী ঝটপট তার কাজ সেরে ফেলে। এই অংশুটুকু মনে হয় না লিখলেও পারতাম। আজকে বরং থাক।

পরে আবার লিখব। আরও অনেক কিছু মনে পড়ছে লিখতে লিখতে। চলবে.............. ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।