আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বান্দরবনে বড় বিলাই (তখন ছোট ছিল) - ১

ব্লগ লিখতে লিখতে মাঝে মাঝে এমন হয় যে মনে মনে কোন একটা বিষয় নিয়ে লেখার কথা চিন্তা করি, মনে মনে কিছুটা সাজিয়েও ফেলি। এরপর হয়ত ভুলে যাই। অনেকদিন পর আবার সেই বিষয়টা মাথায় এলে মনে হয়, আমি তো লিখেই ফেলেছি এই কথাগুলো। কিন্তু পুরনো পোস্টগুলো ঘেঁটে দেখি যে ওরকম কোন লেখা নেই। মনে মনে যে সাজিয়েছিলাম, ওতেই মনে হয় যে লিখে ফেলেছি।

এরকমই একটা লেখা আজকে লিখব। প্রথমবারের মত বান্দরবন বেড়াতে গিয়েছিলাম যখন ক্লাস টু-তে পড়ি। বান্দরবন বলতে এখন সবাই যেখানে বেড়াতে যায়, সেখানে না। ছোট মামা বান্দরবনের বাইশারিতে একটা রাবার বাগানের ম্যানেজার ছিলেন। মামী আর দুই ছেলেকে নিয়ে ওখানেই থাকতেন, মামাত বোনটা তখনও হয়নি।

জায়গাটা হল মায়ানমার সীমান্তের একেবারে কাছে, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়। পরে বড় হয়ে আরেকবার গিয়েছিলাম ওখানে। সেই ভ্রমণের বর্ণনা আগেই দিয়েছি। আচ্ছা অনেক হল বকর বকর। এইবার ভ্রমণের কথায় আসি।

অবশ্য সব কথা ঠিকমত মনে নেই। প্রায় ২৪ বছর আগের কথা। দেখা যাক কতদূর মনে করতে পারি। আমি পড়তাম ক্লাস টু-তে, ছোট বোন কেজি-তে। আমাদের দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা শেষ হয়েছে মাত্র।

ছোট মামা অফিসের কাজে ঢাকায় এসেছেন, আমাদের বাসায় উঠেছেন। সব সময় তা-ই করতেন। এবার যাবার সময় মামা আমাদের দুই বোনকে নিয়ে যেতে চাইলেন। পরীক্ষা শেষ, তাই আম্মাও রাজী হয়ে গেলেন। আমরাও খুব খুশী, নতুন জায়গায় বেড়াতে যাব, পাহাড় দেখব প্রথমবারের মত।

নাইট কোচে দুইটা সিট নিয়ে আমরা রওনা দিলাম। দুইটা সিটের একটাতে আমরা দুই বোন জড়াজড়ি করে বসলাম। বাসে ওঠার আগেই মামা একটা কি জানি ওষুধের সিরাপ কিনে নিলেন। আর আমাদের দুই বোনকে দুই চামচ করে খাইয়ে দিলেন। ইয়াক্, তিতা! পরে শুনেছি এটা নাকি ম্যালেরিয়ার ওষুধ, পাহাড়ী এলাকায় যাওয়ার আগে খেতে হয়।

ওষুধ আমার ব্যাগেও একটা ছিল, ফ্ল্যাজিল সিরাপ। আম্মা দিয়ে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন পেট ব্যথা করলে যেন খেয়ে নিই। খাওয়া লাগেনি শেষ পর্যন্ত। আমি তো বাসে উঠলেই যা করি, কিছু দেখা যাক বা না যাক, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। রাতের বেলায়ও ঐরকমই তাকিয়ে আছি।

ছোট বোনটা আবার ঘুমিয়ে গেছে খুব তাড়াতাড়ি। আমার কাঁধে তার মাথাটা এসে পড়ছে বারবার। আমার কি আর তখন অত শক্তি যে ওর মাথার ভার বহন করব। আমি কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছিলাম। তাতে ওর সমস্যা হচ্ছিল না, কারণ আমি সরিয়ে দিতেই মামা তার কাঁধে ওর মাথা নিয়ে নিচ্ছিলেন।

এক সময় অবশ্য আমিও আর জেগে থাকতে পারলাম না। কখন যেন ঘুমিয়ে গেলাম। একটু পর ঘুম ভেঙে গেলে খুব অবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম বাস দাঁড়িয়ে আছে, আশে-পাশে আরও অনেক বাস আর ট্রাক একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তারপরও সবকিছু থরথর করে কাঁপছে।

ভয় পেলেও মামাকে জিজ্ঞেস করতে পারলাম না, ঘটনা কী? মামা আমার অস্বস্তি দেখে বললেন, কি হয়েছে? বাথরুমে যাবা? আমার তখনও বাথরুম পায়নি, তবু বললাম, যাবো। মামা আমার হাত ধরে বাস থেকে নামিয়ে সারি সারি বাসের চিপা-চাপা দিয়ে গিয়ে একটা বাথরুমে নিয়ে গেলেন। ওখানে গিয়ে দেখি প্যানের ছিদ্র দিয়ে নদী দেখা যায়। তখন বুঝলাম আমরা ফেরীতে আছি। কি বোকা আমি, এটাই বুঝিনি এতক্ষণ।

তখন ঢাকা-চিটাগাং রোডে একটা ফেরী পার হওয়া লাগত। এরপর সারা রাত মোটামুটি ভালোই ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর জানালা দিয়ে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। রাস্তার দুই পাশে ক্ষেত, আর দূরে সারি সারি পাহাড়। সেই পাহাড়ের কোল থেকে সূর্য উঁকি দিচ্ছে।

ঐ দৃশ্য দেখে চোখ ফেরাতে পারিনি আর। ছোট বোনটাকে ডেকে দেখাতে চাইলাম, সে ঘুম থেকে উঠলই না। পুরো দৃশ্যই মিস করল বেচারী। চট্টগ্রামে ঢুকেও শুধু পাহাড় আর পাহাড়। এখন পাহাড় আরও কাছে, একেবারে রাস্তার ধার দিয়ে।

এইবার ছোট বোনের ঘুম ভাঙল আর বলে উঠল, ঐ যে কত পাহাড়। আমি বললাম, কত পাহাড় তো তুমি দেখইনি। চট্টগ্রামে এসে বাস পাল্টাতে হল। তখন সরাসরি বাস ছিল না। লক্কর-ঝক্কর মার্কা একটা বাসে উঠে গাদাগাদি করে বসে বান্দরবন রওনা হলাম।

মামা ছোট বোনকে কোলে নিয়ে বসেছেন আমার একপাশে, আরেক পাশে একজন ভদ্রলোক। উনি বাস ছাড়া মাত্রই চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে গেলেন। আর ঢুলতে ঢুলতে আমার উপর এসে পড়তে থাকলেন। মামা কয়েকবার সরিয়ে দেয়ার পরও যখন তার ঢুলুনি বন্ধ হল না, তখন মামা মেজাজ খারাপ করে ঝাড়ি দিলেন, আপনি কেমন মানুষ ভাই? একটা বাচ্চা পাশে বসা আর আপনি তার উপর এভাবে পড়ে যাচ্ছেন। লোকটা স্যরি ভাই বলে একটু সামলে বসলেন, কিন্তু একটু পর আবারও তার ঢুলুনি শুরু হয়ে গেল।

কি আর করা, ঐভাবেই সহ্য করতে করতে এলাম বান্দরবন। বান্দরবনে বাস থেকে নেমে গ্রামের ভিতর দিয়ে ১২ মাইল লম্বা মাটির রাস্তা দিয়ে যেতে হবে রিকশায় করে। মামা ৯০ টাকা ভাড়া দিয়ে একটা রিকশা ঠিক করলেন। শুরু হল আমাদের রিকশায় দূর পাল্লার যাত্রা। কিন্তু কপালই খারাপ, রিকশাটা গেল নষ্ট হয়ে।

সেই ১২ মাইল না গেলে বাজারও নেই, রিকশা ঠিক করার কোন ব্যবস্থাও নেই। আশে-পাশে অন্য রিকশাও নেই যে আরেকটা ভাড়া করব। অতএব, নষ্ট রিকশা দিয়েই চল। কিভাবে? মামা রিকশার হ্যান্ডেল ধরলেন, আর রিকশাওয়ালা পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে চলল। আমরা দুই বোন কোনমতে রিকশার হুড ধরে বসে রইলাম।

১২ মাইল এভাবে যাওয়ার অভিজ্ঞতা যে কেমন, সেটা আর না-ই বলি। আমি আশে-পাশের দৃশ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকলাম। আর ছোট বোনতো আছেই পটর পটর করার জন্য। সে দুই মিনিট পর পর মামাকে জিজ্ঞেস করতে থাকল, আর কতদূর? আর কতক্ষণ লাগবে পৌঁছাতে? মামার ধৈর্য্যও অপরিসীম। প্রতিবার জবাব দিয়ে চললেন।

একবার অবশ্য একটু অধৈর্য্য হয়ে দূরে অন্য একটা বাসা দেখিয়ে বলে দিয়েছিলেন, ঐ যে আমাদের বাসা। ছোট বোন তখন খুব খুশী, তার মানে তো প্রায় পৌঁছেই গেছি। আমার কেমন যেন সন্দেহ হতে লাগল। পরে আমার সন্দেহই সত্যি হল, ঐটা আসলে মামার বাসা ছিল না। ছোট বোনের পটর পটর অবশ্য বন্ধ হয়নি এক মিনিটের জন্যও।

সে বলে চলছিল, আমি বাসে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মামাত ভাইদের স্বপ্নে দেখেছি। মামাত ভাইরা তখন অনেক ছোট, একজনের আড়াই, আরেক জনের দেড় বছর বয়স। এর মধ্যে বড় জনকে আমরা দেখেছি, ছোট জন হওয়ার পর তখনও দেখিনি। ছোট বোন বলল, ছোট ভাইকে আমি সত্যি সত্যি না দেখলেও স্বপ্নে দেখেছি, খুব মজার দেখতে, ঠোঁটগুলো চোখা চোখা। কোন কার্টুনের চরিত্র হিসেবে দেখেছে কে জানে।

সারাদিন ধরে ঠেলা রিকশায় ঝাঁকুনি খেতে খেতে আর ছোট বোনের পটর পটর শুনতে শুনতে অবশেষে দুপুরের শেষ বেলায় গিয়ে আমরা বাসায় পৌঁছালাম। চলবে........... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।