আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বান্দরবনে বড় বিলাই (তখন ছোট ছিল) - ৩

বান্দরবনে বড় বিলাই (তখন ছোট ছিল) - ১ বান্দরবনে বড় বিলাই (তখন ছোট ছিল) - ২ এত বছর আগের ঘটনা বর্ণনা করতে গেলে সমস্যা যেটা হয়, কোনটা আগে, কোনটা পরে সেই হিসাব আর মেলানো যায় না। যখন যেরকম মনে পড়তে থাকে লিখে যাই, আগে-পরের হিসাব যার যার মত বুঝে নিলেই হবে। মামাত ভাইদের বড় জনের বয়স তখন আড়াই বছর। প্রতিদিন সকালে মামা মটর সাইকেল চালিয়ে বাগানে যান। সেটা দেখে তারও মটর সাইকেলের খুব শখ।

একটা পুরনো তেলের গ্যালনকে সে বাইক বানিয়ে চালায়। চালানোর সময় শব্দও বের করে মুখ দিয়ে, জিহ্বাটা বের করে কিভাবে যেন ব্রুমমমমমম ব্রুমমমমমমম করত সে। ঐটা দেখে আমরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিতাম। সে পাত্তাও দিত না। কিন্তু একদিন একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যায়।

একটু অসাবধান হওয়ায় তার সাধের বাইক খালে ভেসে যায়। হতভম্ব হয়ে সে বাইকটা খালে ভেসে যেতে দেখে। অধিক শোকে কাঁদতেও ভুলে গিয়েছিল বেচারা সেদিন। পিচ্চি দুইটাকে আমি খুব আদর করতাম। মাঝে মাঝে গল্পও শোনাতাম মনে হয়।

কিন্তু আমার ছোট বোন ছিল একটু রাগী, সে আবার পিচ্চিদের খুব শাসনে রাখত। একটু দুষ্টুমি করলেই বকে দিত, মাঝে মধ্যে দুই-একটা কিলও দিয়ে দিত। আর বলত, এই মামার আদর পেয়ে পেয়েই এরা মাথায় উঠে গেছে। মামা-মামী পিচ্চির মুখে এমন কথা শুনে হাসতে হাসতে হেঁচকি তুলে ফেলতেন। মামা দুপুরবেলা বাসায় এসেই মামীকে ডাক দিতেন, এই শুনছ? মামীও মামাকে এই সম্বোধনেই ডাকতেন।

মামাত পিচ্চি ভাইটা যার বয়স তখন মাত্র দেড়, আধো আধো বুলি তার মুখে, এই নামটা শিখে রেখেছিল। মামী যদি কখনও কিছু নিয়ে বকা দিতেন তো মামার কাছে গিয়ে নালিশ দিয়ে দিত, আমাকে বকা দিতে। মামা যদি বলতেন, কে বকা দিল? বলত, তোমাল তুনত (তোমার 'শুনছ')। বেচারার নালিশ তখন সবার হাসির খোরাকই হত, বিচার আর হয়ে উঠত না। মামার সাথে আমাদের এক খালাত ভাইও থাকতেন।

এই ভাইয়াটাকে যখনই পেতাম বিরক্ত করতাম। ওখানে তখন বিদ্যুৎ এর সংযোগ ছিল না। সন্ধ্যার পর জেনারেটর চালাতে হত। আর জেনারেটরের তেল শেষ হয়ে গেলে ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে যেত, এই ভাইয়ার দায়িত্ব ছিল তখন আবার তেল ভরে জেনারেটর চালিয়ে দিয়ে আসা। একবার আমরা সোফায় বসে সবাই মিলে ভাইয়ার কাছে গল্প শুনছি।

হঠাৎ করে জেনারেটর বন্ধ হয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে দূরে কোথাও শিয়াল ডেকে উঠল। ভাইয়া মজা করার জন্য আমাদের ভয় দেখাল, ঐ যে শিয়াল ডাকে, এক্ষুণি এসে তোমাদের ধরবে। মজা করতে গিয়ে নিজেই ধরাটা খেল। আমরা এমন ভয় পেয়ে গেলাম যে সবাই ভাইয়ার দুই হাত চেপে ধরে বসে রইলাম।

এদিকে মামী বলে যাচ্ছেন, কী রে, জেনারেটর চালাস না কেন? আমরা আর ভাইয়াকে ছাড়ি না। পরে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমাদের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে ভাইয়া জেনারেটরের দিকে যেতে পারলেন। একদিন বিকালে ভাইয়া আমাদের চার পিচ্চিকে নিয়ে বেড়াতে বের হলেন। হাঁটতে হাঁটতে আশে পাশের যত টিলা ছিল সব ঘুরিয়ে দেখালেন। একটা স্কুল ছিল টিলার উপর, বিকাল বলে বন্ধ ছিল।

আফসোস হচ্ছিল, সকালে এলে স্কুলের ভিতরেও ঢুকতে পারতাম। যদিও ঢুকে কী করতাম সেটা জানি না। একটা মাঠে কিছু ছেলেপেলে ক্রিকেট খেলছিল। আমি তখনও ক্রিকেট ভালো বুঝি না। এক জায়গায় তিনটা লাঠি দাঁড় করানো দেখে খুব ইন্টারেস্টিং মনে হল।

একটা ধরে টান দিয়ে উঠিয়ে দেখতে থাকলাম, কিভাবে লাঠিগুলো মাটিতে গেঁথে রাখা হয়েছে। আর সব ছেলেরা চিল্লাপাল্লা শুরু করে দিল। ভাইয়া তাড়াতাড়ি ওখান থেকে আমাকে সরিয়ে আনলেন। ঐ এলাকায় মগ উপজাতিদের সংখ্যা বেশি ছিল। ওদের একটা উৎসব চলছিল সেদিন।

কালো রঙের বড় বড় ফানুস উড়াচ্ছিল ওরা। ভাইয়া ওগুলো আমাদের দেখালেন। আমি বুঝতেই পারিনি যে ওগুলো কাগজের। মনে করেছিলাম কালো কালো তেলের ড্রাম বুঝি। খুব অবাক হয়ে ভাবছিলাম এত ভারী একটা ড্রাম আকাশে উড়াল কিভাবে? আবার ভিতরে দেখি আগুনও জ্বলে।

মনে মনে অবাক হলেও কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। এটাই আমার সমস্যা। কৌতুহল এমনিতেই কম, যেটুকু আছে তা-ও প্রকাশ করি না। যাই হোক, মজাই লাগছিল ফানুস দেখতে। কিন্তু হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল।

ততক্ষণে অবশ্য বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি। ভাইয়া আমাদের বললেন, দৌড় দাও, বৃষ্টি কিন্তু চট করে বেড়ে যাবে, একদম ঠান্ডা লেগে যাবে। আমরা দুই বোন এক দৌড়ে কাঠের সেতু পার হয়ে বাড়ির উঠানে চলে আসলাম। এরপর পিছন ফিরে দেখি ভাইয়া দুই পিচ্চিকে দুই হাতে চ্যাংদোলা করে ঝুলিয়ে দৌড়ে দৌড়ে আসছেন। ঐ দেখে আমরা হি হি হি করতে করতে শেষ।

ইচ্ছা করছিল বৃষ্টিতে আরও ভিজতে, কিন্তু জোর করে বাসায় ঢুকিয়ে দেয়া হল। অবশ্য যেটুকু ভিজেছিলাম ওতেই যা আকাজ হওয়ার তা হয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যায় আমার মাথা এমন ভার ভার লাগতে থাকল যে কাউকে কিছু না বলে বিছানায় চুপচাপ শুয়ে রইলাম। একটু পর মামী খেয়াল করে আমার কাছে এলেন। কপালে হাত দিয়েই চিৎকার করে মামাকে ডাক দিলেন।

আমিও তখন বুঝতে পারছিলাম জ্বর ভালোই বেড়েছে। মামা তাড়াতাড়ি ওষুধ নিয়ে এলেন। ভয় একটাই, ম্যালেরিয়া যেন না হয়। তবে সৌভাগ্যক্রমে ওটা শুধুই বৃষ্টিতে ভেজার জ্বর ছিল। দুই দিন পরেই আমি আবার পূর্ণোদ্যমে লাফ-ঝাঁপ শুরু করে দিলাম।

সেই লাফ-ঝাঁপের কাহিনী আবার আরেক দিন। চলবে............... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।