আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গাঁও গেরামের গল্প (ঝরু পর্ব)

পুরনো আমিটাই ভাল ছিলাম...

আজ কতদিন পর এই প্রত্যন্ত দখিনা লঞ্চঘাটে নামলাম, দিন-তারিখ গুনে বলতে পারবোনা। কখনো হিসেব রাখার প্রয়োজন মনে হয়নি। তবে মাঝখানে দুই-দুই-বার দেশে ক্ষমতা-বদল হয়েছে এটা মনে আছে। অনেকদিন পর সেই চেনা পরিচিত কাঁদামাটির ঘ্রাণ, নদীর খোলা বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে। যাত্রী নামিয়ে দিয়ে ছোট একতলা লঞ্চটি ভেঁপু বাজিয়ে চলে যাচ্ছে দক্ষিণমুখী।

নদীর পার ধরে একটু কাঁদাপানি পার হতেই উঁচু রাস্তাটায় উঠলাম। যে জনা-পাঁচেক যাত্রী নামল, যে যার মতো বাড়ির পথ ধরেছে। সন্ধ্যা পার হয়ে অনেকক্ষণ কেটে গেছে। ন’দশ দিন বয়সী পোয়াতি জ্যোৎস্নায় চারপাশ মৃদু আলোকিত হয়ে আছে। অনেক দিনের ইতস্তত অনভ্যাসে পথঘাট অচেনা মনে হতে থাকে আমার।

গ্রামের এই একমাত্র হাঁটে সপ্তায় দুইদিন অনেক দূর থেকে মানুষজন সওদা করতে আসে। সারিসারি ডিঙ্গি নৌকা আর তালের ডোঙ্গা দেখে সহজেই আঁচ করা যায় জোয়ারের পানি এদের বাড়িঘর প্রতিদিন নিয়ম করে তলিয়ে দিলেও ক্ষমতা-বদল আর বাজিকরের স্বপ্নের জোয়ার এসব মানুষের কাছে কখনোই পৌঁছেনা; যুগের পর যুগ এদের চলার পথে কোন পরিবর্তন হয়না। একটা দোকানে বসে চা খেলাম। কেউ কেউ একটু কৌতূহলী দৃষ্টি ফেলে রাত বেশি হয়ে যাওয়া তাড়াহুড়ায় বাড়ির পথ ধরল। অল্প কিছু নদীতে/বিলে মাছ ধরা আর রাত জেগে তাস/জুয়া খেলা মানুষ এদিক সেদিক বসে আছে।

হাঁটের মাঝখানটায় একটা নিম গাছ, তখন ছোটমতো ছিল; এখন ডালপালা ছড়িয়ে বেশ বড় হয়ে গেছে। সুনসান ফাঁকা আধো-আলো-অন্ধকার গাছটার তলায় চোখ আটকে যায় আমার। স্মৃতিগুলো একে একে এসে হাজির হতে থাকে আর্দ্র হয়ে ওঠা ভাবনায়। এই গাছতলায় বসা ফেরিওয়ালার কাছ থেকে একদিন ফুলিকে চুলের ময়ূর-ক্লিপ কিনে দিয়েছিলাম। উজ্জ্বল হয়ে ওঠা সেই কিশোরী-মুখ মনে করে বুকের ভেতরে লুকিয়ে থাকা কোন একটা ব্যাথা জেগে ওঠে সন্তর্পণে।

ঝাপসা চোখে ভেসে ওঠে কাদের মুন্সীর নয়া বউ-এর মুখে অশ্রাব্য গালাগালি-দৃশ্য আর মেঝেতে ভেঙ্গে পড়ে থাকা সেই দ্বিখণ্ড ময়ূর-ক্লিপ। দোকানীর উসখুস দেখে বুঝতে পারলাম আমার জন্য বন্ধ করতে পারছেনা। ‘ন্যাভাই কি দোকান বন্দ করবেন?’ ‘হ বাড়তেতো যাওন লাগে। ম্যালা রাইত অইছে। আম্মে ক্যাগো বাড়ির অতিত।

যাইবেন কোম্মে?’ ‘কাদের মুন্সীগো বাড়ি যাইতে চাইলহাম। ওনারে কি পামু এহন বাড়ি গেলে?’ ‘কাদের মুন্সীর বাড়ি যাইবেন? আম্মের নাম কি কন দেহি? গলাডা চেনা চেনা ঠ্যাহে য্যান! আর কাদের মুন্সীতো আইজগো বচ্ছর দুই অয় মইর‍্যা গেছে। হ্যার ভিডায় এহন আর কেউ থাহেনা। মুন্সী মইর‍্যা যাওনের পর হ্যার য্যারের ঘরের বউ বাড়ি-বুড়ি তাদাম বেইচ্যা হিকদার কান্দা হ্যার বাহের বাড়ি গেছিগ্যা। ’ কাদের মুন্সী মরে গেছে শুনে অনেকদিন পর এই মানুষটার প্রতি একটা মায়া অনুভব করি।

নিজের বাবাকে দেখিনি কখনো। একটা সময় পর্যন্ত এই মানুষটাকেই বাবা জেনে এসেছি আমি। সেই মানুষটাকে আর কখনোই দেখতে পাবোনা ভেবে বুকের ভেতরটা কেমন শূন্য মনে হয়। পাছে আমার এই আবেগ অচেনা দোকানদারের কাছে প্রকাশ হয়ে যায় এই ভেবে একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করি। ‘মোর নাম মতিন।

মুই ম্যালাদিন আগে কাদের মুন্সীর বাড়ি আছেলাম। ’ দোকানী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর হঠাৎ কোন এক কারণে দোকান থেকে নেমে আমার দিকে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাল সামলাতে না-পেরে দোকানের আধভাঙ্গা বেঞ্চিটাসহ পেছনে পড়ে গেলাম দু’জনে। ‘মইত্যা, ছ্যামড়া, তুই কোম্মে গেছিলি ক’দেহি মর্দ।

এই রহম ডাহাইত্যা কামও মাইনষে হরে? হেই যে গেলি আর কোন খোঁজ খবরও দিলিনা। আছস না মরছস হ্যাও কইতারিনা। মনডায় কয় তোরে ঢকমতো লাইত্থ্যাই, হারামজাদা’ আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম কয়েক মুহূর্তে ঘটে যাওয়া এরকম আচরণে। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম দোকানীর চোখের পানিতে আমার ঘাড়ের এক পাশ ভিজে গেছে। আমার চোখের সামনে সারাদিন রৌদ্রে ঘুরতে ঘুরতে পোড়া-চামড়া তের-চৌদ্দ বছরের এক কিশোর-মুখ ভেসে উঠল।

যাকে ভাই বলি বন্ধু বলি আপনজন বলি কোন সম্বোধন দিয়েই প্রকাশ করা যাবেনা। আমি যা-যা বলতাম তা-তা করতে পারাই ছিল তার জীবনের ব্রত। মনে পড়ছে ক্লাস ফোরে তখন, আমি কোন এক কারণে রেগে গিয়ে গুলতি মেরে এক ছেলের কপাল ফাটিয়ে দিয়েছিলাম। গলগল করে রক্ত পড়া শুরু করল। আমি ভয় পেয়ে বাড়ির পথে ছুট।

ভয়ে আমার হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছিল। পরে জানলাম এই গাধা ছেলেটা নিজে দোষ স্বীকার করেছে স্যারের কাছে। বিনিময়ে খেয়েছে ইচ্ছামতো উত্তম মধ্যম। বিকেল বেলা আমাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে, ‘দোস্ত খেলাবিনা আয়? পিডে ম্যালা ব্যাতারে। এইহানে ইট্টু খাউজাইয়্যা দ্যাসনা!’ ‘ঝরু তুই?’ - এটুকু বলে আমি আর কথা বাড়াতে পারলাম না।

দু’জনে বেশ ক’পাক গড়াগড়ি খেয়ে উঠে বসলাম। ঝরু আরো কিছুক্ষণ আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকল। সেই ট্রেডমার্ক কান্নাই ওর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিল জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো। আমার আত্মার খুলে যাওয়া একটি অংশ যেন আবার জোড়া লেগে গেল নীরবে এইসব উচ্ছ্বাসের এক ফাঁকে। ডিঙ্গি নৌকায় করে যখন ঝরুর বাড়িতে যাচ্ছি, অনেকদিন পরে ফিরে পাওয়া বন্ধুর কাছে জমানো সব কথার ঝুড়ি খুলে বসেছে সে।

কিন্তু সেই উচ্ছ্বাসের খুব কমই আমাকে স্পর্শ করছে। আমি চুপচাপ শুনে যাচ্ছি। ঝরুর বৈঠার আঘাতে বিলের বুকে চাঁদের বিম্বটার কেঁপে কেঁপে কেটে যাওয়ার রুপালি দৃশ্য আর ছলাৎ ছলাৎ সেই জলের শব্দ ছাড়া আমার চারপাশে আর কিছু আছে বলে মনে হচ্ছেনা। একটা কিশোরী মুখ, একটা ভাঙ্গা ময়ূর-ক্লিপ আমার চেতনাকে তাড়া করে ফিরছে প্রতিনিয়ত। ঝরু মাঝপথে বিলে পেতে রাখা কৈয়্যা জাল থেকে খালুই ভরে মাছ তোলে, আমাকে সাপ দেখায়, এবছর মাছ বেশ ভালই পড়েছে এসব তথ্য জানায়।

উত্তর পাড়ার ছাদেক মিয়া মাছ ধরতে এসে জীনের সাথে ধস্তাধস্তি করে একটা জীন মেরে ফেলেছিল, আর পরের দিন সেই জীনের মরা-কাক হয়ে পড়ে থাকার খবরও জানায়। আমি হু-হা করি, কিছু বলার আগ্রহ পাইনা। স্নান করে ঝরুর দেয়া লুঙ্গি আর বাটা-কোম্পানির স্যান্ডো-গেঞ্জি পরে খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়ি। দু’জনের কারোর চোখেই ঘুম নেই। ঝরুর কথা যেন আর থামেইনা।

সে জানায় আসছে পূর্ণিমার দিন তার বিয়ে। সব ঠিকঠাক। আয়োজন শেষ প্রায়। দক্ষিণের ভিটার ঘরখানা ভাল করে মেরামত করে ঐখানে নতুন বউ নিয়ে উঠবে বিয়ের পরে। ঝরু আরো জানায়, এবার চেয়ারম্যানকে বলে বেশ কিছু টিন সে এনে রেখেছে নতুন ঘরটার ছন ফেলে টিনের ছাউনি দেবে এই জন্য।

গেলো বন্যায় ভেসে যাওয়া অনেকের বাড়ি মেরামতের জন্য সরকার অনেক টিন দিয়েছে এলাকায়। চেয়ারম্যান তার বাড়িতে বড় দুইখান আটচালা টিনের ঘর তুলেছে। সামনের নির্বাচনে ঝরুকে মেম্বরের পদ দেবে বলেও চেয়ারম্যান আশ্বাস দিয়েছে। কথা বলতে বলতে ঝরু ঘুমিয়ে পরে এক সময়। ভোর হয়ে আসে।

নদীর পারে কেউ একজন ফজরের আজান দেয়। আমার চোখে ঘুম আসে একটু একটু করে। আমি ঝরুর মুখের দিকে তাকাই। ভোর হয়ে আসা নরম আলোয় তৃপ্ত-সুখী একটা মুখ দেখে আমার ভাল লাগে কিনা বুঝতে পারিনা। ঝরুর সুখের কথা আর নতুন ঘর বাঁধার স্বপ্নের উচ্ছ্বাস আমাকে কতটুকু ছুঁয়ে যায় হিসেব করতে ইচ্ছে করেনা।

বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠি। কোথাও ঘুরতে বের হব এমন ইচ্ছে নিয়ে আসিনি। কিন্তু তবুও যার জন্য আসা সেই তার কোন খোঁজ এখনো জানতে পারিনি এটা ভেবে কেমন হতাশা পেয়ে বসে আমাকে। ঝরুকেও জিজ্ঞেস করতে পারছিনা কোন এক আজানা দ্বিধায়। ঝরু সারাদিন নতুন ঘরের কাজ করে।

আমার সাথে কথা বলে ফাঁকে ফাঁকে। খাওয়া দাওয়া হয়। বিকালে তিন মাইল দূরের বুচির হাঁটে যায় রাজহাঁস কিনে আনতে। আমাকে ভাল মন্দ খাওয়াবে এই তার ইচ্ছা। সন্ধ্যা হয়-হয় এমন সময় বাড়ি থেকে বের হই।

নদীর ঘাটে বাঁশ দিয়ে বানানো বসার মতো একটা চৌকি পাতা। নামাজের সময় নামাজ পড়ে কেউ কেউ আর অন্য সময় বসে গায়ে নদীর খোলা বাতাস লাগায়, গল্প করে। কাছাকাছি যেতে ঘাট থেকে একটা মেটে শাড়ি পরা অবয়ব উঠে আসে। চুড়ির মৃদু শব্দ পাই, যেরকম শব্দ আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে কাদের মুন্সীর বাড়িতে আমার ঘরের জানালার পাশে শুনেছিলাম এক রাতে, যে রাতে ফুলির বিয়ে হয়ে যায় আর আমি জীবনে প্রথমবার কাপুরুষ হই। সন্ধ্যার এই মিইয়ে যাওয়া আলোয় আমি খুব চেনা একটা মুখ দেখে চমকে উঠি।

মুখের একদিকে বড় একটা কাটা দাগ। বাম কাঁখে ধরা কলশীর পানি একটু বুঝি ছলকে ওঠে। হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি মুখোমুখি দু’টো মানুষ। কিছু একটা বলতে চাইলাম; বলতে পারিনি অথবা রুদ্ধ হয়ে থাকা সেই কণ্ঠ থেকে কোন শব্দ বের হয়নি। ফুলি সামলে নিয়ে বলে, ‘মতি ভাই কেমন আছেন?’ এতদিন পর দেখা হওয়া মুহূর্তে এই স্বাভাবিক প্রশ্নটাই আমার কাছে খুব বেশি অচেনা, অস্বাভাবিক লাগে।

আমি কোন উত্তর না দিয়ে নির্বোধের মতো চেয়ে থাকি। ‘মুই যাই মতি ভাই। ’ -- ‘ফুলি তুমি এহন কই থাহ?’ আমার কণ্ঠে অপরাধবোধের কাঁপন টের পাই। ‘বিয়ার পর ঝরু ন্যাভাইর লগে হ্যার নতুন ঘরে উটমু। ’ যাওয়ার সময় ফুলির এই কথা বলায় তার কণ্ঠ কাঁপল কিনা আমি ধরতে পারিনা।

সেই সন্ধ্যা-ঘোর আলোতে আমি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকি। পাশেই কাঠবাদাম গাছটার ডালে দূর-দূর থেকে উড়ে আসা বাদুড়গুলো একটা একটা করে ঝুলে পড়তে থাকে। বাঁ হাতের তর্জনীতে বাদাম কাটতে গিয়ে কাটা-দাগটায় হাত বুলাই। আমার স্থির হয়ে থাকা চোখে একটা কাটা দাগের মুখ ভেসে থাকে। অদৃশ্য ক্ষতস্থানে একটা চিনচিনে অনুভূতি বয়ে যায় কোথাও।

সন্ধ্যার চাঁদ-উঠি-উঠি আলোয় আমি সামনে হাত বাড়াই; সদ্য ঘোমটা-খোলা-জ্যোৎস্না আর অপার্থিব সান্ধ্য প্রকৃতির শূন্যতা আমাকে ছুঁয়ে যায়। পরের পর্বে সমাপ্ত... গাঁও গেরামের গল্প (ফুলি পর্ব)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।