আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খোলা কলাম--- ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নয়---- রাহাত খান (বাংলাদেশ প্রতিদিন - ১৯/০৩/২০১১ )



গ্রামীণ ব্যাংক সংক্রান্ত নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মামলা এখন সুপ্রিমকোর্টে। ১৫ মার্চ থেকে দুই সপ্তাহের জন্য সুপ্রিমকোর্ট মামলার শুনানি মুলতবি করেছেন। বিচারাধীন কোনো মামলার বিষয়ে কথা বলার এখতিয়ার কারো নেই। আমার ও নেই। এই নিবন্ধে আমি শুধু ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছি।

খুবই বড় মাপের একজন মানুষ ড. ইউনূস। শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার জয় করে গোটা দেশকেই বিশ্ব দরবারে সম্মানিত করেছেন। তার জন্য বাংলাদেশি হিসাবে অবশ্যই গৌরববোধ করি। তবে একটি ভুল তথ্য তার ওপর আরোপ করা হয়। বলা হয়, গ্রামীণ ব্যাংকের তিনি প্রতিষ্ঠাতা।

কথাটা সত্য নয়। ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশ সরকার। দেশের প্রচলিত আইন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রবিধান ও তদারকির আওতায় একটি বিশেষায়িত ব্যাংক হিসাবে ১৯৯০ সালে এর প্রতিষ্ঠা। ড. ইউনূসকে প্রতিষ্ঠাতা ম্যানেজিং ডাইরেক্টর পর্যন্ত বলা যেতে পারে। তবে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা তিনি নন কোনোক্রমেই।

গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা না হলেও ব্যাংকের সর্বেসর্বা ব্যক্তি তিনিই। ব্যাংকটির প্রসারে ও প্রচারে তার বিশাল ভূমিকাকেও খাটো করে দেখা যায় না কিছুতেই। শুধু একটা ব্যাপারে অনেকের মতো আমার মনেও খট্কা আছে। জানতে ইচ্ছে হয়, ব্যাংক পরিচালনা এবং নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ড. ইউনূস দ্বিতীয় ব্যক্তি তৈরি করেননি কেন? খালেদ শামসের মতো অসাধারণ এক ব্যক্তি গ্রামীণ ব্যাংকের দ্বিতীয় নেতা হিসেবে তৈরি হচ্ছেন বলে বহুকাল আমরা শুনেছিলাম। হঠাৎ একদিন শুনি খালেদ শামস আর গ্রামীণ ব্যাংকে নেই।

তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরিয়ে দিয়ে খালেদ সাহেবকে গ্রামীণের অন্য কোন প্রকল্পে দেওয়া হয়েছে তা আমার ঠিক জানা নেই। গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা-নেতৃত্বে এরপর দ্বিতীয় স্থানে দীপাল বড়ুয়া নামে এক ব্যক্তির নাম শুনেছিলাম। তিনিও এখন নেই বলে জানি। অর্থাৎ ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনায় অসাধারণ দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন ঠিকই।

তবে কোনো সংস্থাকে প্রতিষ্ঠানে (ইনস্টিটিউশন) পরিণত করতে হলে সেখানে যে দ্বিতীয়, তৃতীয় নেতৃত্ব তৈরি করতে হয় এ ব্যাপারে কোনো মনযোগ দেননি ড. ইউনূস। কেন দেননি তা তিনিই জানেন। তবে আমার মতো অনেকে মনে করেন এটা শুধু যে ড. ইউনূসের এক ব্যর্থতা তা নয়, এর পেছনে আজীবন গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনার এবং গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে যা খুশি করার একটা নেতিবাচক প্রবণতা কাজ করছে। বয়স হলে মানুষ সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেবে, এটাই তো আইন। এটাই তো নিয়ম।

কিন্তু দেখে-শুনে আমার ধারণা জন্মেছে যে সারা দুনিয়ায় তোলপাড় তুলে হলেও ড. ইউনূস যেন আমৃত্যু গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে ন্যস্ত থাকতে চান। ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি না থাকলে ৮০ লাখ দরিদ্র মানুষের এই ব্যাংক নাকি মুখথুবড়ে পড়বে। এমন কথাও ইউনূস সমর্থক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কাছ থেকে শোনা যায়। ইউনূস সাহেব ব্যাংকের (গ্রামীণ) এমডি না থাকলে ব্যাংক অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে_ এমনটাই যদি হয়, তাহলে এখনই তো তার বয়স ৭১ বছর, নোবেল পুরস্কার জিতলেও মৃত্যু তো তাকে রেহাই দেবে না। যথাসময়ে দেশ ও জাতিকে শোকসাগরে ভাসিয়ে তিনি প্রাণত্যাগ করবেন_ তখন গ্রামীণ ব্যাংকের কি হবে? তাহলে তো ব্যাংকের (গ্রামীণ) স্বার্থে ড. ইউনূসকে অমর থাকতে হয়।

সেটা কি সম্ভব? গ্রামীণ ব্যাংকে ড. ইউনূসকে থাকতেই হবে। এটা যে নোবেল বিজয়ীর শুধু একটা আত্ম-সম্মানের প্রশ্ন তা মোটেও নয়। গ্রামীণ ব্যাংকে তার এমডি পদে থাকার উপর নির্ভর করছে আমার জানা মতে, বিশ্বের বহু আন্তঃমহাদেশী বাণিজ্যগোষ্ঠীর ব্যবসায়িক স্বার্থ। বাণিজ্য-স্বার্থ থাকতেই পারে, সেটা কোনো বেআইনি বা অবাঞ্ছিত বিষয় নয়। তবে অনেকে বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের ন্যায় কোনো বিশেষায়িত ব্যাংকের প্লাটফরমে কাজ করার কতগুলো সুবিধা পাওয়া যায়।

যেমন কো-লেটারাল বা ইক্যুইটি দিতে হয় না। ট্যাক্স দিতে হয় না। এসব সুবিধা ব্যবহার করতে পারলে বিশ্ব ও দেশীয় বাজারে পণ্যমূল্য প্রতিযোগিতামূলক রেখেও লভ্যাংশ কতটা উচ্চহারে পাওয়া সম্ভব, সেটা নিশ্চয়ই বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। শান্তির জন্য নোবেল বিজয়ী একটা বিশাল মাপের মানুষ। নিজের সম্মান তিনি নিজেই রক্ষা করবেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অব্যাহতিপত্র পাওয়ার পর সসম্মানে নিজেই সরে যাবেন, এটাই তো কাম্য ছিল।

কিন্তু তেমনটি হয়নি। সারা বিশ্ব বিশেষত পাশ্চাত্য ভূখণ্ডে তার পদচ্যুতি নিয়ে নানা প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছে। নানা হৈচৈ হয়েছে। ইউনূস সাহেবকে যেন গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি রাখতেই হবে। তা না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

কার সর্বনাশ? এ বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলাম। সবকিছু পরিষ্কার করে বলার তো দরকার নেই। ৩৫ থেকে ৪০ পার্সেন্ট সুদ নিয়ে কোনো ব্যাংক দারিদ্র্যমোচন করতে পারবে, এটা মুর্খের স্বর্গে বাস করার মতোই অলিক কল্পনা। বাংলাদেশে শোচনীয় দারিদ্র্য-দশা মোচন, শিশু-মৃত্যুর হার কমানো, প্রসূতি মায়ের মৃত্যুহার কমানো, নারীর ক্ষমতায়ন, জন্মহার কমানো, গ্রামে ও বস্তিতে স্যানিটেশন ব্যবস্থার বহুল উন্নয়ন_ এসব ব্যাপারে এরই মধ্যে বাংলাদেশের ব্র্যাক, প্রশিকা, নিজের করি, কারিতাস প্রভৃতি এনজিও'র অনেক সাফল্যের রেকর্ড (সাক্সেস স্টোরী) রয়েছে_ গ্রামীণ ব্যাংকের এসব কার্যক্রমের কোনো বালাই-ই ছিল না। তারা দেয় গরিব মানুষদের উচ্চহারে শুধু ঋণ।

এক হিসাবে সুদের ব্যবসাই বলা যায়। তাই গ্রামীণ ব্যাংককে দিয়ে দেশের দারিদ্র্যমোচন খুব একটা হয়েছে বলে মনে করার কারণ নেই। তবু দারিদ্র্যমোচন, সমাজে দারিদ্র্যের দরুন অস্থিরতা সৃষ্টির ভয়াবহতা ঠেকানো, দরিদ্র মানুষের ঘরে ঘরে সুখ ও স্বস্তি উপচেপড়া_ এসব মহান কর্ম ও কীর্তির স্বীকৃতি হিসাবেই শান্তিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি অনেকের কাছেই তাজ্জবের বলে মনে হয়েছে। সমাজে সামান্য কিছু ক্ষেত্র ছাড়া যিনি গ্রামীণ ব্যাংকের উচ্চহারের ক্ষুদ্র ঋণে দারিদ্র্যমোচনের তেমন সফল হননি, যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গণহত্যাকারী পাকিস্তানের বিপক্ষে কোনো প্রতিবাদ জানাননি, আমেরিকায় নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে যিনি আত্মরক্ষায় সচেষ্ট ছিলেন, দেশের নানা প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সময় যিনি সর্বদা তার নেপথ্যচারিতা ও নিষ্ক্রিয়তা রক্ষা করেছেন নির্লিপ্তভাবে_ সেই তিনি, ব্যবসা-বাণিজ্যের শিরোমণি ড. মুহাম্মদ ইউনূস পেলেন শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার।

শান্তি পুরস্কারের প্রতি নোবেল কমিটির এই দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিহাস ছাড়া আর কি বলা যায়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে একজন প্রতিভাধর উদ্যোগী ও দক্ষ লোক হিসেবে আমি বরাবরই শ্রদ্ধা করে আসছি। তবুও কিছু দুঃখ আমার আছে তার ব্যাপারে। কিছু প্রশ্নও আমার আছে তার বিপক্ষে। বাংলাদেশে তার জন্ম, বাংলাদেশি বলে তার পরিচিতি, অথচ আশ্চর্যের বিষয় ড. ইউনূস কোনোদিন, এমনকি নোবেল প্রাপ্তির পরও বাঙালির গর্ব ও ঐতিহ্যের প্রতীক শহীদ মিনারে যাননি।

কোনোদিন যাননি সাভারের স্বাধীনতা স্মৃতিসৌধে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, জাতির জনক, ড. ইউনূস কোনোদিন জাতির জনকের মাজারে যাননি, কোনোদিন তাকে দেখা যায়নি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কিছু বলতে। বাঙালি জাতির জনক এবং বাঙালির যা কিছু গৌরবময় অর্জন_ সেসবের প্রতি ড. ইউনূসের এই উপেক্ষা এবং নাক-উঁচু ভাব আমাকে খুব দুঃখ দেয়। বাঙালি জাতিকে নিয়ে গর্ব করে না_ এমন লোক লাঠির জোরে প্রতিষ্ঠার যতটা উচ্চতায়ই উঠুন তার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান বজায় রাখা কঠিন। ওয়ান ইলেভেনের পর রাজনীতিবিদদের তিনি ঢালাওভাবে দুর্নীতিবাজ বলেছিলেন।

কেন বলেছিলেন ড. ইউনূস? গণতান্ত্রিক বিশ্ব তো পরিচালনা করে রাজনীতিবিদরাই_ সুশীল সমাজ নয়। ড. ইউনূস আপনি দশ বছর থাকার শর্তে দেশ শাসন করতেও রাজি ছিলেন। এসবই মানুষের কাছে আপনার মর্যাদাকে খাটো করে। মামলায় কি হয় জানি না। সময়েই সেটা জানা যাবে।

তবে ইতোমধ্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ের মাধ্যমে অর্জিত বিশাল ভাবমূর্তির অনেকটাই আপনি খুঁইয়েছেন। এটা জাতিগতভাবে আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক। লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।