আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বর্ণ ব্যবসা পরিচালনার কথা বলে ইউনিপে টু ইউ



ঢাকা: নিউওয়ে, জিজিএন, যুবক----এসবের পর মাল্টিলেবেল মার্কেটিংয়ের নামে এবার দেশজুড়ে নতুন ফাঁদ পেতেছে ইউনিপে টু ইউ (Unipay2U) নামের একটি সংগঠন । ওই চক্রটি মাত্র ১৪ মাসেই ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী এলাকায় ১৫ লক্ষাধিক সদস্য বানিয়ে তাদের কাছ থেকে ‘বিনিয়োগ’ বাবদ হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। চারটি মহানগরীতে দুই হাজারেরও বেশি এজেন্টের মাধ্যমে ইউনিপে এই বিপুল অংকের টাকা নিজেদের ব্যাংক একাউন্টে নিয়ে নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণ ব্যবসা পরিচালনার কথা বলে ইউনিপে টু ইউ সহজ সরল নাগরিকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিজেদের থে নিয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের মানি লন্ডারিং শাখা গত মার্চ মাসে ইউনিপে’র কার্যক্রম বন্ধের উদ্যোগ নিলে সংস্থাটি উচ্চ আদালতের আশ্রয় নেয়।

১৩ জুন আদালতের স্থিতিবস্থা সংক্রান্ত একটি রায়কে পুঁজি করে ইউনিপে টু ইউ তাদের নেটওয়ার্কিং ফাঁদের ব্যবসাটি আরো রমরমা ভাবে চালাচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। ইউনিপে টু ইউ এর দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তার দেখা মেলে না, প্রধান কার্যালয়েও বসেন না সংস্থার নীতি নির্ধারকরা। রাজধানীর হাতিরপুলের মোতালেব প্লাজার ষষ্ঠ তলায় সংস্থাটির বাংলাদেশের প্রধান কার্যালয় বলে ঘোষণা দেওয়া থাকলেও সেখানে ওঠাবসা করেন তাদের মনোনীত এজেন্টরা। ইউনিপে টু ইউ বাংলাদেশের তাদের ফাঁদ পাতার জন্য নির্ধারিত স্লোগান ব্যবহার করে তা হচ্ছে : ‘দশ মাসে টাকা দ্বিগুণ, ১০ বছরে তা পাওয়া যায় ২৪ গুণ বেশি। ’ প্রধান কার্যালয়ের টেলিফোন নাম্বারে যোগাযোগ করে ইউনিপে টু ইউ এর অন্যতম এজেন্ট ইসমাইল হোসেন শাওন জানান, যদি কেউ ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ দিয়ে শুরু করে তাহলে ১০ বছর পর তার পুঁজির পরিমান দাঁড়াবে ৪ কোটি টাকায়।

প্রথম বিনিয়োগের টাকা ইউনিপে টু ইউ এর ব্যাংক একাউন্টে জমা দেওয়ার ১০ মাস পর থেকেই ওই সদস্য দুই লাখ টাকা করে আয় পেতে থাকবেন। গ্রাহকরা (সদস্যরা) প্রতি মাসেও বিনিয়োগের বিপরীতে লভ্যাংশ তুলতে পারবেন। সেক্ষেত্রে প্রতি মাসে ২০ শতাংশ হারে লাভের টাকা তোলা যায়। এছাড়াও সদস্যদের আরো বাড়তি আয় করার ব্যাপক সুযোগ সুবিধার লোভ দেওয়া আছে। একজন সদস্য আরেকজন বিনিয়োগকারী সংগ্রহ করে ইউনিপে টু ইউ কে দিতে পারলে সংগ্রহকারী সদস্য পরবর্তী বিনিয়োগকারীর ১১ শতাংশ লাভ পেতে থাকবেন।

ইসমাইল হোসেন শাওন আরো জানান, ২০০৯ সালের ২৫ জুলাই থেকে বাংলাদেশে ইউনিপে’র কার্যক্রম চলছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, চীন, মালয়েশিয়ায় ইউনিপে টু ইউ এর নেটওয়ার্কিং ব্যবসা ব্যাপকভাবে চলছে বলেও তিনি দাবি করেন। এজেন্ট শাওন জানান, বর্তমানে বেশি চাহিদার কারণে সীমিত বিনিয়োগকারী কাউকে আর সদস্য করা হচ্ছে না। কমপক্ষে ৪২ হাজার টাকা বিনিয়োগ করতে আগ্রহীরাই কেবল সদস্য হতে পারেন। ইউনিপে টু ইউ এর মতিঝিলস্থ এজেন্ট সাজ্জাদুল আহসান জানান, ৪২ হাজার টাকা (অফেরতযোগ্য) জমা দিয়ে একটি বিও একাউন্ট খুলতে হয়।

পরে এই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ব্যবসায় দফায় দফায় ১২ লাখ ৬০ হাজার পর্যন্ত টাকা জমা দেওয়ার সুয়োগ রয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি জানান, তার এই কোম্পানি সদস্যদের টাকা একত্র করে আন্তর্জাতিক বাজারে সোনা কেনাবেচার ব্যবসা করে থাকে। এতে প্রতি মাসে গড়ে কোম্পানিটির লাভ হয় ৮৬ শতাংশ। এ থেকে গ্রাহকদের দেওয়া হয় মাত্র ১০ শতাংশ। তার দেওয়া হিসাব অনুযায়ী লাভের ৮৯ শতাংশেরও বেশি নিয়ে যাচ্ছে কোম্পানিটি।

ফরিদুর রহমান ও মোতালেব হোসেন নামের দুই গ্রাহক জানিয়েছেন, লাভ দ্বিগুণ বলা হলেও মূলধনসহ দ্বিগুণ টাকা ফেরত পাওয়া যাচ্ছে। তারা জানান, দ্বিগুণ লাভ দেওয়ার প্রচার চালালেও লাভ দেওয়া হয় অর্ধেকেরও কম। যে ১০ শতাংশ লাভ দেওয়ার কথা বলা হয় তা থেকেও সাড়ে ১২ শতাংশ কেটে নেয় কোম্পানিটি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইউনিপে টু ইউ কোম্পানিটি বাংলাদেশে একটি ট্রেড লাইসেন্স আর একটি আমদানি রপ্তানি সংক্রান্ত লাইসেন্সের ক্ষমতাবলেই কোটি কোটি টাকা বাংলাদেশের বাইরে পাঠিয়ে আসছে। তারা সোনা ব্যবসায় এতো টাকা বিনিয়োগ করার দাবি জানালেও সেসব টাকা বিদেশে কিভাবে নেওয়া হয় তার কোনো স্বচ্ছতা নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মানি লন্ডারিং শাখা থেকে এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই ইউনিপে টু ইউ এর কার্যক্রম বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ইউনিপে টু ইউ বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করতেই সবচেয়ে বেশি সদস্য সংগ্রহ হয়েছে সিলেট বিভাগে। সেখানে এ পর্যন্ত সাড়ে ৭ লাখ সদস্য সংগ্রহ করা হয়েছে, তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকারও বেশি। সংশ্লিষ্ট একাধিক গ্রাহক-সদস্য জানান, এ মুহূর্ত পর্যন্ত বিনিয়োগের টাকা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কোনো কারণে শীর্ষ কর্মকর্তারা ব্যাংক একাউন্ট বন্ধ করে পালিয়ে গেলে দেশ জুড়ে হায় হায় অবস্থার সৃষ্টি হবে।

সোনা কেনার নামে গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হলেও এর পরিবর্তে তাদের দেওয়া হয় একটি সার্টিফিকেট। বলা হয়, এসব সোনা সরকার অনুমোদিত লন্ডন, জুরিখ ও নিউইয়র্কের মার্কেটের ভল্টে থাকবে। নির্দিষ্ট সময় শেষে গ্রাহকরা ছয় মাসে সর্বোচ্চ ১৫০ শতাংশ ও ১০ মাসে ২৩০ শতাংশ হারে মুনাফাসহ স্বর্ণে বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পাবেন বা ১০ মাসে দ্বিগুণ অর্থ দেওয়ার প্রস্তাব করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে প্রায় অর্ধশতকোটি টাকা রয়েছে ইউনিপের বিভিন্ন হিসাবে। এর মধ্যে বেসরকারি দি সিটি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক ও এনসিসি ব্যাংকে রয়েছে ৩০ কোটি টাকার মতো।

এসব টাকা ইউনিপে টুইউ বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনতাসীর হুসেন এবং কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহীদুজ্জামানের নামে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইউনিপে টুইউ সব ধরনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জব্দ নির্দেশের বিপরীতে ১৩ জুন আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নেয় প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা দুদক’র কাছে সুপারিশ করব। ইতিমধ্যে আমরা সব প্রস্তুতি শেষ করে এনেছি।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।