আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাকার পর এবার অভিযোগ মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে

সবকিছুতেই আনন্দ খুঁজি।

বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পর এবার জামায়াতে ইসলামী নেতা মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে একাত্তর সালে চট্টগ্রামে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম মহানগরীর টেলিগ্রাফ হিল রোডে তৎকালীন 'ডালিম হোটেল' ছিল মীর কাসেম আলীর টর্চার সেল। নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাসহ নিরীহ বাঙালি লোকজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে তিনতলা এ হোটেলে নির্যাতন করা হতো। নির্যাতনের পর অনেককে হত্যা করে লাশ গুম করারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

কাসেম আলীর বিরুদ্ধে গতকাল শনিবার একাত্তরের মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তদলের কাছে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীসহ অনেকে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য দেন। একাত্তরের মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তদলের সদস্য অ্যাডভোকেট জেয়াদ আল মালুম গতকাল দুপুরে সার্কিট হাউসে সংবাদ সম্মেলনোত্তর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, তদন্তে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত দুই দিনের তদন্তে তাঁদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলোর পক্ষে যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণও পাওয়া গেছে। তদন্ত চলাকালে চট্টগ্রামে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী অবস্থান করার কোনো প্রভাব তদন্তে পড়বে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রভাব-প্রতিপত্তি বা হুমকি-ধমকিতে অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কার্যক্রমকে কেউ বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। যত দ্রুত সম্ভব তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

দুজনকে গ্রেপ্তার করা হবে কি না জানতে চাইলে জেয়াদ আল মালুম জামায়াতের পাঁচ শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, এর আগে পাঁচজনের বিরুদ্ধে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তাঁদের বিরুদ্ধেও একই প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হবে। এর আগে তদন্তদল সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত তিন দফায় নগরীর কাটা পাহাড়ে ডালিম হোটেল (বর্তমানে মহামায়া ডালিম ভবন) টর্চার সেল, পাহাড়তলী বধ্যভূমি ও ফয়'স লেকে মহিলাদের টর্চার সেল এবং গণকবর এলাকা পরিদর্শন করে। সে সময় এসব স্থানে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সন্তান, নির্যাতিত ও নির্যাতিত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তারা কথা বলে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রত্যক্ষদর্শী লোকজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছে তদন্তদল। তিন দিন চট্টগ্রামে অবস্থানের পর গতকাল বিকেলে তদন্তদল ঢাকার উদ্দেশে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে।

ডালিম হোটেল টর্চার সেল পরিদর্শনকালে তদন্তদলের কাছে একাত্তরের সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা তুলে ধরেছেন এই টর্চার সেলে নির্যাতনের শিকার ন্যাপ নেতা সাইফুদ্দিন খানের স্ত্রী প্রত্যক্ষদর্শী নুরজাহান খান। তিনি বলেন, একাত্তরের ২৫ নভেম্বর ভোরে নগরীর পশ্চিম মাদারবাড়ী ৬ নম্বর আজিজ কলোনির বাসায় তাঁর স্বামীসহ অন্তত ৩৫ জন পরদিন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ভোর রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে তাঁর স্বামীসহ সাতজনকে ধরে চোখে কালো কাপড় ও হাত বেঁধে নিয়ে যায় টর্চার সেলে। হানাদারদের সবার মুখে ছিল 'মাংকি ক্যাপ'। তিনি বলেন, সবাই জানে এই টর্চার সেলের নেতৃত্ব দেন মীর কাসেম আলী।

তিনি তখন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা ছিলেন। নুরজাহান খান বলেন, যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি স্বামীর দেখা পাননি। দেশ স্বাধীনের পর ফিরে আসা স্বামীর শরীরে নির্যাতনের অনেক চিহ্ন ছিল। নুরজাহান খানের ভাই রেজা আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, টর্চার সেলে তিনি সাইফুদ্দিন খানকে দেখতে যেতেন। তিনি তাঁর ভগি্নপতিকে সিগারেট দিয়ে গেলে এর আগুন দিয়ে সাইফুদ্দিন খানের মুখমণ্ডলসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছ্যাঁকা দেওয়া হতো।

রেজা সিদ্দিকী বলেন, 'যখনই যেতাম, দেখতাম হাত বাঁধা ও মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা। একেকটা রুম যেন একেকটা টর্চার সেল। তাঁর কাছে শুনেছি, খাওয়ার পানি খুঁজলে প্রস্রাব এনে দিত। ' এরপর তদন্তদল সকাল পৌনে ১০টায় পাহাড়তলী বধ্যভূমি পরিদর্শনে যায়। ১ দশমিক ৭৫ একর জায়গায় অবস্থিত দেশের বৃহত্তম বধ্যভূমি হিসেবে এটি পরিচিত।

এ বধ্যভূমিতে মুক্তিযুদ্ধকালে শত শত মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ বাঙালিকে এনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় বলে তদন্তদলকে গতকাল জানান প্রজন্ম '৭১ চট্টগ্রাম বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. গাজী সালাহউদ্দিন আহমেদ। বধ্যভূমির বিভিন্ন স্থান দেখিয়ে তদন্তদলকে গাজী সালাহউদ্দিন বলেন, 'একাত্তর সালের ১০ নভেম্বর দুপুর দেড়টায় আমার বাবা আলী করিম, সন্ধ্যায় চাচা আলী হোসেন, আবদুল গোফরান ও আবদুল মান্নানকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে এ বধ্যভূমিতে জবাই করে পাকিস্তানি বাহিনী। তাঁদের লাশ পর্যন্ত পাইনি। এ ছাড়া আমাদের পাঞ্জাবি লেন থেকে ১২০ জনকে নিয়ে সেখানে হত্যা করা হয়। একইভাবে ঝাউতলা রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেন দাঁড় করিয়ে চট্টগ্রাম-নাজিরহাট-দোহাজারীগামী এবং ফিরোজ শাহ কলোনি, বিহারি কলোনিসহ বিভিন্ন এলাকার শত শত লোককে ধরে নিয়ে সেখানে জবাই করার অভিযোগ রয়েছে।

' গাজী সালাহউদ্দিন আরো বলেন, এটি একটি নির্জন এলাকা ছিল। ওই সময় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মাহমুদুর নবী চৌধুরীর (বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বাবা) কাছে নিরীহ অনেক লোক গিয়েছিল হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার জন্য। কিন্তু সে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হয়নি। যুদ্ধের পর এখানে কঙ্কালের স্তূপ ছিল। উঁচু-নিচু সব টিলা রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল।

পরে এসব টিলা কেটে সমতল করা হয়। গাজী সালাহউদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এ বধ্যভূমিতেই 'জিয়া বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন' নামে বহুতল একটি ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করা হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের স্মৃতিবিজড়িত এ বধ্যভূমি থেকে কয়েক বছর আগেও অনেক কঙ্কাল পাওয়া গেছে। ভবন নির্মাণকাজ শুরুর সময় রাতের আঁধারে অসংখ্য কঙ্কাল সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখনো মাটি খোঁড়া হলে অনেক কঙ্কাল পাওয়া যাবে।

তাই এ বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও সংস্কারের জন্য অবিলম্বে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাহাড়তলী বধ্যভূমিতে নির্যাতনের শিকার হয়েও বেঁচে যাওয়া কাজী আমিনুল ইসলাম তদন্তদলের কর্মকর্তাদের বলেন, তিনি ও তাঁর বড় ভাই কাজী আনোয়ার হোসেনসহ ৪০-৫০ জনকে পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতাল এলাকা থেকে ধরে এ বধ্যভূমিতে নিয়ে আসা হয়। কৌশলে তাঁরা দুই ভাইসহ তিনজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও অন্যদের জবাই করা হয়েছে। এরপর তদন্তকারী দল সকাল ১০টা ১০ মিনিটে ফয়'স লেকে যায়। একাত্তরের পুরো সময়ে এ ফয়'স লেকের পাশে অবস্থিত রেলওয়ের 'লগ হাউস'-এ অসংখ্য নারীকে নির্যাতন করা হয়েছিল।

অনেককে হত্যার পর আশপাশের পাহাড়সহ ফয়'স লেক এলাকায় গণকবর দেওয়া হয়। তদন্তদল প্রথমে ফয়'স লেকের সিঁড়িসংলগ্ন গণকবর পরিদর্শন করে। তারপর দেখতে যায় সেই নির্যাতন সেল লগ হাউস। এটি বর্তমানে পর্যটন রেস্টুরেন্ট। সে সময় গাজী সালাহউদ্দিন আহমেদ প্রত্যক্ষদর্শী অনেকের উদ্ধৃতি দিয়ে তদন্তদলের কর্মকর্তাদের বলেন, বিভিন্ন এলাকা থেকে নারীদের ধরে নিয়ে এসে এই লগ হাউসে পাকিস্তানি বাহিনীর কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দেওয়া হতো।

নির্যাতনের পর ফয়'স লেকের পানিতে নামিয়ে সে দৃশ্য দেখত কর্মকর্তারা। আবার পানি থেকে তুলে কক্ষে নিয়ে নির্যাতন করত। এভাবে পাশবিক নির্যাতনের পর অনেককে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর লগ হাউসসহ ফয়'স লেক থেকে নারীদের অনেক পোশাক, ভ্যানিটি ব্যাগ, জুতাসহ বিভিন্ন জিনিস পাওয়া যায়। তবে জীবিত অবস্থায় কাউকে পাওয়া যায়নি।

তদন্ত দল ঢাকা ফিরেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তদল কাজ শেষে ঢাকা ফিরে গেছে। দুই দিনব্যাপী তদন্ত শেষে ফিরে যাওয়ার আগে গতকাল শনিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন তথ্য দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস মিলনায়তনে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চট্টগ্রামের রাউজান, পাহাড়তলী বধ্যভূমি, ডালিম হোটেলসহ বিভিন্ন স্থানে খুন, ধর্ষণ, বাড়িঘর জ্বালানো ও লুটপাটের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। সাক্ষীদের বক্তব্যে সব কিছু উঠে এসেছে। এসব তথ্য আদালতে তুলে ধরা হবে।

গত দুদিনে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত হিসেবে যাদের নাম উঠে এসেছে তাদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্তদলের সদস্যরা জানান, এটি আদালতের বিষয়। নিরপেক্ষভাবে আইনকে সামনে রেখে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে ট্রাইব্যুনাল। তাঁরা আরো জানান, ট্রাইব্যুনাল আইনের ১৯ ধারাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। গত ৩৯ বছর নানা রাজনৈতিক টানাপড়েনের কারণে অভিযুক্তদের বিচার হয়নি। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, সদস্য অ্যাডভোকেট মোকলেসুর রহমান।

এতে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্যানেল আইনজীবী রানাদাশ গুপ্ত, তদন্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মতিউর রহমান, সহকারী পুলিশ সুপার নুরুল ইসলাম, পরিদর্শক আবদুর রাজ্জাক খান ও এস এম ইদ্রিস। অ্যাডভোকেট রানাদাশ গুপ্ত কালের কণ্ঠকে জানান, গতকাল বিকেলে বিমানযোগে তদন্তদল চট্টগ্রাম ত্যাগ করে। চট্টগ্রামে মানবতাবিরোধী অপরাধ

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।