আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হুমায়ুন আজাদের প্রবচনগুচ্ছ পার্ট -১


আনেকে বলে থাকেন "হুমায়ুন আজাদ বোঝার মতো বুদ্ধি সবার থাকেনা" আমি তা মনে করিনা । আসলে তার কথা গুলো বড্ডবেশি সেজাসাপটা নির্লজ্জের মতে গোপন দূর্বলতায় আঘাত করে । অনেকেই যা সহ্য করতে পারেনা । এখানে তার কিছু কথা বা প্রবচন উল্লেখ করা হলে সংখ্যায় বেশি তাই দুইবা ততোধিক খন্ডে ভাগ করে দেয়া হবে । প্রবচনগুচ্ছ যারা আগেই জানেন অথবা না জানেন আরেক বার পড়া যাক ।

আরেক টা কথা যারা প্রতি অক্ষরে দশ নেকি আশা করেন তাদের পড়ার দরকার নাই । ১। মানুষ সিংহের প্রশংসা করে, কিন্তু আসলে গাধাকেই পছন্দ করে। ২। পুঁজিবাদের আল্লার নাম টাকা, মসজিদের নাম ব্যাংক।

৩। সুন্দর মনের থেকে সুন্দর শরীর অনেক আকর্ষনীয়। কিন্তু ভন্ডরা বলেন উলটো কথা। ৪। হিন্দুরা মুর্তিপূজারী; মুসলমানেরা ভাবমুর্তিপূজারী।

মুর্তিপূজা নির্বুদ্ধিতা; আর ভাবমুর্তিপূজা ভয়াবহ। ৫। ‘মিনিষ্টার’ শব্দের মূল অর্থ ভৃত্য। বাঙলাদেশের মন্ত্রীদের দেখে শব্দটির মূল অর্থই মনে পড়ে। ৬।

আমাদের অঞ্চলে সৌন্দর্য অশ্লীল, অসৌন্দর্য শ্লীল। রুপসীর একটু নগ্ন বাহু দেখে ওরা হৈ চৈ করে, কিন্তু পথে পথে ভিখিরিনির উলঙ্গ দেহ দেখে ওরা একটুও বিচলিত হয় না। ৭। শ্রদ্ধা হচ্ছে শক্তিমান কারো সাহায্যে স্বার্থোদ্ধারের বিনিময়ে পরিশোধিত পারিশ্রমিক। ৮।

আগে কারো সাথে পরিচয় হ’লে জানতে ইচ্ছে হতো সে কী পাশ? এখন কারো সাথে দেখা হ’লে জানতে ইচ্ছে হয় সে কী ফেল? ৯। ব্যর্থরাই প্রকৃত মানুষ, সফলেরা শয়তান। ১০। পরমাত্মীয়ের মৃত্যুর শোকের মধ্যেও মানুষ কিছুটা সুখ বোধ করে যে সে নিজে বেঁচে আছে। ১১।

জনপ্রিয়তা হচ্ছে নেমে যাওয়ার সিঁড়ি। অনেকেই আজকাল জনপ্রিয়তার পথে নেমে যাচ্ছে। ১২। উন্নতি হচ্ছে ওপরের দিকে পতন। অনেকেরেই আজকাল ওপরের দিকে পতন ঘটছে।

১৩। প্রতিটি ধর্ম গ্রন্থ সভ্যতাকে নতুন আলো দেয়। ১৪। বাঙলার প্রধান ও গৌণ লেখকদের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে প্রধানেরা পশ্চিম থেকে প্রচুর ঋণ করেন, আর গৌণরা আবর্তিত হন নিজেদের মৌলিক মূর্খতার মধ্যে। ১৫।

মহামতি সলোমনের নাকি তিন শো পত্নী, আর সাত হাজার উপপত্নী ছিলো। আমার মাত্র একটি পত্নী। তবু সলোমনের চরিত্র সম্পর্কে কারো কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু আমার চরিত্র নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। ১৬। বাঙালি যখন সত্য কথা বলে তখন বুঝতে হবে পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে।

১৭। আধুনিক প্রচার মাধ্যমগুলো অসংখ্য শুয়োরবৎসকে মহামানবরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ১৮। অধিকাংশ রূপসীর হাসির শোভা মাংসপেশির কৃতিত্ব, হৃদয়ের কৃতিত্ব নয়। ১৯।

পাকিস্তানিদের আমি অবিশ্বাস করি, যখন তারা গোলাপ নিয়ে আসে, তখনও। ২০। আবর্জনাকে রবীন্দ্রনাথ প্রশংসা করলেও আবর্জনাই থাকে। ২১। নিজের নিকৃষ্ট কালে চিরশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের সঙ্গ পাওয়ার জন্য রয়েছে বই; আর সমকালের নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গ পাওয়ার জন্যে রয়েছে টেলিভিশন ও সংবাদপত্র।

২২। শৃঙ্খলপ্রিয় সিংহের থেকে স্বাধীন গাধা উত্তম। ২৩। প্রাক্তন বিদ্রোহীদের কবরে যখন স্মৃতিসৌধ মাথা তোলে, নতুন বিদ্রোহীরা তখন কারাগারে ঢোকে, ফাসিঁকাঠে ঝোলে। ২৪।

একনায়কেরা এখন গণতন্ত্রের স্তব করে, পুজিঁপতিরা ব্যস্ত থাকে সমাজতন্ত্রের প্রশংসায়। ২৫। পুরস্কার অনেকটা প্রেমের মতো; দু-একবার পাওয়া খুবই দরকার, এর বেশি পাওয়া লাম্পট্য। ২৬। বেতন বাঙলাদেশে এক রাষ্ট্রীয় প্রতারণা।

এক মাস খাটিয়ে এখানে পাঁচ দিনের পারিশ্রমিক দেয়া হয়। ২৭। কবিরা বাঙলায় বস্তিতে থাকে, সিনেমার সুদর্শন গর্দভেরা থাকে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত প্রাসাদে। ২৮। মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ, তবে বাঙালির ওপর বিশ্বাস রাখা বিপজ্জনক।

২৯। বুদ্ধিজীবীরা এখন বিভক্ত তিন গোত্রে। ভন্ড, ভন্ডতর, ভন্ডতম। ৩০। শিক্ষকের জীবনের থেকে চোর, চোরাচালানি, দারোগার জীবন অনেক আকর্ষণীয়।

এ সমাজ শিক্ষক চায় না, চোর-চোরাচালানি-দারোগা চায়। ৩১। শয়তানের প্রার্থনায় বৃষ্টি নামে না, ঝড় আসে; তাতে অসংখ্য সৎ মানুষের মৃত্যু ঘটে। ৩২। যে বুদ্ধিজীবী নিজের সময় ও সমাজ নিয়ে সন্তুষ্ট, সে গৃহপালিত পশু।

৩৩। পা, বাঙলাদেশে, মাথার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পদোন্নতির জন্যে এখানে সবাই ব্যগ্র। কিন্তু মাথার যে অবনতি ঘটছে, তাতে কারো কোনো উদ্বেগ নেই। ৩৪।

এখানকার একাডেমিগুলো সব ক্লান্ত গর্দভ; মুলো খাওয়া ছাড়া ওগুলোর পক্ষে আর কিছু অসম্ভব। ৩৫। জন্মাতরবাদ ভারতীয় উপমহাদেশের অবধারিত দর্শন। এ অঞ্চলে এক জন্মে পরীক্ষা দিতে হয়, আরেক জন্মে ফল বেরোয়, দু-জন্ম বেকার থাকতে হয়, এবং ভাগ্য প্রসন্ন হ’লে কোন এক জন্মে চাকুরি মিলতেও পারে। ৩৬।

রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার দরকার ছিলো না, কিন্তু দরকার ছিলো বাঙলা সাহিত্যের। পুরস্কার না পেলে হিন্দুরা বুঝতো না যে রবীন্দ্রনাথ বড়ো কবি; আর মুসলমানেরা রহিম, করিমকে দাবি করতো বাঙলার শ্রেষ্ঠ কবি হিশেবে। ৩৭। বাঙলাদেশে কয়েকটি নতুন শাস্ত্রের উদ্ভব ঘটেছে; এগুলো হচ্ছে স্তুতিবিজ্ঞান, স্তব সাহিত্য, সুবিধা দর্শন ও নমস্কারতত্ত্ব। ৩৮।

এখানে অসতেরা জনপ্রিয়, সৎ মানুষেরা আক্রান্ত। ৩৯। টেলিভিশন, নিকৃষ্ট জিনিশের একনম্বর পৃষ্ঠপোষক, হিরোইন প্যাথেডিনের থেকেও মারাত্মক। মাদক গোপনে নষ্ট করে কিছু মানুষকে, টেলিভিশন প্রকাশ্যে নষ্ট করে কোটি কোটি মানুষকে। ৪০।

পৌরানিক পুরুষেরা সামান্য অভিজ্ঞতা ভিত্তি ক‘রে অসামান্য সব সিদ্ধান্ত নিতেন। যযাতি পুত্রের কাছে থেকে যৌবন ধার ক’রে মাত্র এক সহস্র বছর সম্ভোগের পর সিদ্ধান্েত পৌছেন যে সম্ভোগে কখনো তৃপ্তি আসে না! এতো বড়ো একটি সিদ্ধান্েতর জন্যে সহস্র বছর খুবই কম সময় : আজকাল কেউ এতো কম অভিজ্ঞতায় এতো বড়ো একটি সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহস করবে না। ৪১। অভিনেতারা সব সময়ই অভিনেতা; তারা যখন বিপ্লব করে তখন তারা বিপ্লবের অভিনয় করে। এটা সবাই বোঝে, শুধু তারা বোঝে না।

৪২। বাঙলাদেশের প্রধান মূর্খদের চেনার সহজ উপায় টেলিভিশনে কোনো আলোচনা-অনুষ্ঠান দেখা। ওই মূর্খমন্ডলিতে উপস্থাপকটি হচ্ছেন মূর্খশিরোমণি। ৪৩। পৃথিবী জুড়ে প্রতিটি নরনারী এখন মনে ক’রে তাদের জীবন ব্যর্থ; কেননা তারা অভিনেতা বা অভিনেত্রী হতে পারে নি।

৪৪। মৌলিকতা হচ্ছে মঞ্চ থেকে দূরে অবস্থান। ৪৫। এরশাদের প্রধান অপরাধ পরিবেশদূষন : অন্যান্য সরকারগুলো পুরুষদের দূষিত করেছে, এরশাদ দূষিত করেছে নারীদেরও। ৪৬।

বাঙালি একশো ভাগ সৎ হবে, এমন আশা করা অন্যায়। পঞ্চাশ ভাগ সৎ হ’লেই বাঙালিকে পুরস্কার দেয়া উচিত। ৪৭। একজন চাষী বা নদীর মাঝি সাংস্কৃতিকভাবে যতোটা মূল্যবান, সারা সচিবালয় ও মন্ত্রীপরিষদও ততোটা মূল্যবান নয়। ৪৮।

মানুষ ও কবিতা অবিচ্ছেদ্য। মানুষ থাকলে বুঝতে হবে কবিতা আছে : কবিতা থাকলে বুঝতে হবে মানুষ আছে। ৪৯। বাঙালি আন্দোলন করে, সাধারণত ব্যর্থ হয়, কখনোকখনো সফল হয়; এবং সফল হওয়ার পর মনে থাকে না কেনো তারা আন্দোলন করেছিলো। ৫০।

এখন পিতামাতারা গৌরব বোধ করেন যে তাঁদের পুত্রটি গুন্ডা। বাসায় একটি নিজস্ব গুন্ডা থাকায় প্রতিবেশীরা তাঁদের সালাম দেয়, মুদিদোকানদার খুশি হয়ে বাকি দেয়, বাসার মেয়েরা নির্ভয়ে একলা পথে বেরোতে পারে, এবং বাসায় একটি মন্ত্রী পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কৃতজ্ঞতায় : অনন্ত বিজয় দাশ
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.