সুখ চাহি নাই মহারাজ—জয়! জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ। ক্ষুদ্র সুখে ভরে নাকো ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা কুরুপতি! দীপ্তজ্বালা অগ্নিঢালা সুধা জয়রস, ঈর্ষাসিন্ধুমন্থনসঞ্জাত,সদ্য করিয়াছি পান—সুখী নহি তাত, অদ্য আমি জয়ী।
গিয়াছিলাম নিকটস্থ ঈদগাহে ঈদের সালাত হাসিল করিতে। হরেক রংয়ের পাঞ্জাবীতে সারা ঈদগাহে যেনবা টিউলিপ বাগানের ঢেঊ খেলিয়া যাইতেছে। দেখিয়াই মনটা আর্দ্র হরষে আপ্লুত হইলো।
কিন্তু প্যান্ডেলের নীচে স্থান না পাইয়া রৌদ্রকরোজ্জ্বল খোলা ময়দানে ঘামিতে ঘামিতে জায়নামাজ বিছাইয়া উপবেশন করতঃ মেজাজটা কিঞ্চিৎ খিচরাইয়া গেল। উপরন্তু পড়িয়াছি আমার খুব আপন এক মানুষের দেওয়া কালো বাহারী পাঞ্জাবী। কাপড়ের সেই কৃষ্ণবিবর ভেদ করিয়া রবিরশ্মি তাহার সমস্ত তাপদাহ যেন গাত্রে লেপন করিয়া কহিতে লাগিল, “বৎসে, জানিও এ তোমার ঈমান ও আকিদার পরীক্ষা”! খোদার এই পাপী বান্দা তাই ঘামিতে ঘামিতে হাসিমুখেই নুতন ইমাম সাহেবানের খুদবা শ্রবণ করিতে লাগিলো। পুরাতন ইমাম সাহেব গত ত্রিশ বৎসর ধরিয়া পাড়ার তাবৎ মুসলমানগনের খেদমত করিয়া ৮৪ বৎসর বয়সে এবারই অবসর গ্রহণ করিয়াছেন।
স্বেদনিঃসৃত মুখে নুতন ইমাম হুজুরের কুহুসম সুমিষ্ট সুরেলা ধ্বনি আমার শ্রুতি আকর্ষণ করিল।
তিনি তখন জান্নাতের ফজিলত ও ভোগবিলাসের বর্ণনাকরতঃ মুমিনদিগকে এই নশ্বর পাপী ইহলোকের মোহজালে প্রলুব্ধ না হইয়া পরকালে জান্নাতের টিকেট পাইবার বয়ান ফরমাইয়া যাইতেছেন, যাহার সারসংক্ষেপ আমার স্মৃতি হইতে আপনাদিগের উপকারার্থে তুলিয়া ধরিতেছিঃ
ইমাম হুজুর বলিতে লাগিলেন(সম্ভবত নোয়াখালীর আঞ্চলিক উচ্চারণে, ঈষৎ সুর করিয়া টানিয়া টানিয়া), আমাদের পেয়ারা নবী করীম (সঃ) কে হযরত ওমর (রাঃ) একদিন আসিয়া পুছ করিলেন, “হে পেয়ারা নবী, ইয়াহুদী নাসারা কাফেরেরা দোজাহানের মুসলমানদের উপর এই যে এমন ছড়ি ঘুরাইতেসে, এই যে তাহাদের এতো শানশওকত, আল্লাহ পারওয়ারদিগার কি এর কোনই বিহিত করিবে না?”
পেয়ারা নবী উত্তর করিলেন, “ওমর, তোমাকে তো আমি বুদ্ধিমান বলিয়াই জানিতাম। তবে এতো নির্বোধের মতো প্রশ্ন করিলে কেন? আরে নাসারা কাফেরদের এইসব হম্বিতম্বি তো দুইদিনের এই পিরথীবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ! আখেরাতে তাদের জন্য অপেক্ষা করতেসে অনন্ত দোজখের কারাবাস। আর আল্লাহর পেয়ারা মুমিন মুসলমান বান্দাদের জইন্য থাকিবে জান্নাতের অফুরন্ত ভোগবিলাস। তুমি এতো বিচলিত হইয়ো না, ওমর। ”
ইমাম সাহেব এবার কিঞ্চিৎ হুঙ্কার দিলেন, জান্নাতের সবচে’ স্পেশাল মেহমান হইবে কারা? আপনারা, আপনারা... দ্বীনের পথে থাকা এই মুসলমানেরা! কি ভাবে? বলি শুনেন।
(এবার সুর করিয়া) মাছের কলিজা খাইতে তীতা। কিন্তু জান্নাতে এই মাছের কলিজা খুশবুদার! পাতলা সুবাসিত রুটির সাথে মাছের কলিজা সহযোগে উত্তম নাস্তার ব্যবস্থা রাখা হইবে আপনাদের জন্য, হে মোমিন মুসলমানো! নদীর মাছ আইসা আপনারে সালাম করবে। আপনি সালামের জবাব দিবেন। তারপর মাছ আপনারে শুধাইবে, “আমি আল্লাহর সুস্বাদু মাছ। আপনি কি আমারে খাইতে চান?” আপনি কহিবেন, “হা”।
মাছ শুধাইবে, “আপনার বাজারে গিয়া মাছ কিনবার কুনো প্রয়োজন নাই। আমারে কাটতে হবে না, ছুলতে হবে না, আল্লাহর অশেষ কুদরতে মশলাপাতি মাখানোই আছে আমার শরীলে। ভাজি বলেন, দোপেয়াজা বলেন- যেমনে খাইতে চান আমি তেমনেই রান্না হয়ে যাবো ইনশাল্লাহ্!”
হুজুরানে ইমাম বলিয়া চলিলেন, পাখির গোস্ত অনেক সুস্বাদু। কিন্তু আমরা কয়জনে এই পাখির গোস্ত খাইতে পারি, কন? একটা চড়ুই পাখিরে ধরতে যাবেন, কিন্তু ধরতে পারবেন না। কুন দিক দিয়া যে পলাইবো, হের হদিশ মেলা ভার! কিন্তু জান্নাতে... (ইমাম সাহেব এবার একটু দম নিয়ে আবার সুর ধরলেন)... জান্নাতে আকাশের পাখি আপনা আপনি আইসা ধরা দিবো।
আল্লাহর এই কুদরতী পাখির গোস্ত খাইয়া আপনি ঢেকুর তুলবেন। আর পাখির হাড্ডি-গুড্ডি আপসে আপ জোড়া লাইগা আবার আকাশে উড়াল দেবে। আপনার এক ঢেকুরে সমস্ত খাওয়া হজম হইয়া যাবে। ঢেকুরের খুশবুদার গন্ধে অন্য মোমিন জান্নাতী বান্দাদের পেটেও আবার ক্ষুধার উদ্রেক করিবে।
আরো শুনেন দ্বীনের ভাইয়েরা আমার, ইমাম সাহেব বলিয়া চলিলেন, জান্নাতে আছে মনি মুক্তা খচিত সোনার তৈরী দরজা, সেই স্থানে দালানের ইট সোনা রুপায় তৈরী, মাটি জাফরানের, কাঁকর হইলো মনিমুক্তা আর ইয়াকুত পাথর, আবে রহমতের নদী বইয়া চলে সেখানে, যার পানি দুধের চেয়ে সাদা, বরফের চেয়ে ঠান্ডা, মধুর চেয়ে মিষ্টি; জান্নাতের গাছগুলা সোনা আর রুপার, ফলগুলি নিকটবর্তী, বাতাস মোলায়েম... জান্নাতে ইচ্ছা করিলেই সোনা রুপার পাত্রে আসে কুদরতী সুস্বাদু খাবার, আসে ফল-ফলাদি, আসে শীতল সুরা ভর্তি পান পাত্র।
সেিখানে আরো আছে নূর দিয়া তৈরী হুর, নব্য কুমারী, অতিশয় সুন্দরী, নম্র ও নরম। হুরবালিকার হাসিতে চাইরদিক আলোকিত হয়, এক বিন্দু থুথুতে মিঠা হইয়া যায় দরিয়ার পানি...
শুনিতে শুনিতে আমার আবেগাশ্রু চক্ষু বাহিয়া পড়িতে লাগিল। এতদসাথে জান্নাতে যাইবার তীব্র মাদকীয় ললুপতাও ঘিরিয়া ধরিলো। স্বেদমিশ্রিত গাত্রে আমি চক্ষু মুদিয়া যেইনা জান্নাতের অলীক সুন্দর বাগানে হুরবালিকার সন্ধানে পা বাড়াইলাম, ওমনি নমাজে দাঁড়াইবার আহ্বান আসিল।
সকলকে ঈদ মুবারাক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।