আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাদম্বরী

মামুন বিশ্বাস

মামুনবিশ্বাস কাদম্বরী যখন ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন তখন ফুলতলির ভবতারিনী মাত্র বালিকা মাত্র। কাদম্বরীকে তথা নতুন বৌঠানকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের লেখা অসংখ্য গান, কবিতার কারনে অনেকের মাঝেই একটা কৌতুহল কাজ করে, তাহলে কবিগুরু আর কবিপত্নীর মাঝে সম্পর্ক কেমন ছিল? কবিগুরু কি তাহলে তার স্ত্রীকে সবসময় অবহেলা করে গেছেন? ঠাকুর স্টেটের কর্মচারী বেনীমাধব রায়ের বড় মেয়ে ভবতারিনীর সঙ্গেই বিয়ে ঠিক হলো রবীন্দ্রনাথের। গুরুজনরা তার জন্য যে সম্পর্ক ঠিক করেছিলেন রবি বিনা দ্বিধায় তা মেনে নিয়েছিলেন। বিয়ে করতে তিনি অন্য কোথাও যাননি, জোড়াসাকোর বাড়িতেই বিয়ে হয় তার। বেশী জাক জমকের বিয়ে তার হয়নি।

পারিবারিক বেনারসী “দৌড়দার” আর জমকালো শাল গায় দিয়ে তিনি বিয়ে করতে গেলেন নিজেদের বাড়ির পশ্চিমের বারান্দা ঘুরে। বিয়ে করে আনলেন জগত সম্পর্কে অজ্ঞ বালিকা ভবতারিনীকে। কবির বাসরের সুন্দর বর্ননা আছে হেমলতার খাতায়, বাসরে বসেই কবি দুষ্টুমী আরম্ভ করে দিলেন, ভাড় খেলার বদলে তিনি সব ভাড়্গুলোকে উলটে পালটে দিচ্ছিলেন। তাতে তার ছোট কাকিমা বিরক্ত হয়ে বললেন, তোর বাসরে কে আর গান গাইবে, তুই এমন গাইয়ে থাকতে, তুই একটা গান ধর। তখন তিনি ওড়নাঢাকা জড়সড় বধূর দিকে তাকিয়ে কৌতুকভরে গান ধরেছিলেন, আ মরি লাস্যমইয়ী ............।

গানটি তার ন’দিদি স্বর্নকুমারীর লেখা। অনেকের মতে কবিগুরু তার স্ত্রীর পিতৃপ্রদত্ত নামটি পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। হ্যা সেটা হয়তো সত্যিই তাই যে নামটি তিনিই পছন্দ করেছিলেন, কিন্তু সেসময় ঠাকুরবাড়ির প্রায় সমস্ত বউদের জন্যই এই রীতি প্রযোজ্য ছিল। রবীন্দ্রনাথ আলাদা কিছুই করেননি। শোনা যায় কথায় যশুরে টান থাকায় মৃনালিনী প্রথমে কিছুদিন কথাই বলেননি।

সেই তিনিই অচিরে রবীন্দ্রনাথের “রাজা ও রানী’ নাটকে “নারায়নী” সেজে মেজো ভাশুর সত্যেন্দ্রনাথের বিপরীতে নজরকাড়া অভিনয় করেছিলেন। ঘরোয়া অভিনয় নয়, বেশ বড় মাপের আয়োজন হয়েছিল। পরে অবশ্য “সখিসমিতি”র দু- একটা নাটকে অভিনয়, কিংবা “মায়ার খেলা”র ছোট খাটো চরিত্রে অভিনয় করা ছাড়া তাকে কিছুতেই অংশগ্রহন করতে দেখা যায় নি। স্বামীর আগ্রহের মর্যাদা দিতেই তার এসমস্ত কর্মকান্ডে জড়ানো। কিন্তু একথা স্বীকার করতেই হবে এসব ব্যাপারে মৃনালিনীর নিজে অংশগ্রহন করার কোন আগ্রহই ছিল না।

তিনি ভালোবাসতেন রান্না - বান্না, সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকতে। কবি ছিলেন সৌখীন মানুষ। খাবার দাবারের ব্যাপারেও তার প্রচণ্ড শখ কাজ করতো। জোড়াসাকোতে যেদিন ঘরোয়া আসর বসত সেদিন কবি তাকে ফরমায়েশ করতেন, মামুলী কোন খাবার যেনো মেন্যুতে না থাকে, সবই হতে হবে আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ন। সেই সময়ের সকলেই কবি পত্নীর রন্ধনপটুতার কথা স্বীকার করতেন।

স্ত্রীর রান্নার পারদর্শিতায় উৎফুল্ল হয়ে কবি প্রায়ই সব উদ্ভট রেসিপি এনে এক্সপেরিমেন্ট করতেন, যা শেষে মৃনালিনীকেই সামলাতে হতো। পত্নীকে রাগানোর জন্য তিনি বলতেন, “দেখলে তোমার কাজ তোমাকেই কেমন একটা শিখিয়ে দিলুম”। মৃনালিনী চটে গিয়ে বলতেন, “তোমার সঙ্গে পারবে কে? সব ব্যাপারেতো জিতেই আছো। গত হয়ে যাওয়ার পরে তিনি পুত্রবধূ প্রতিমার সাথে গল্প করে বলতেন,”তোমার শাশুড়িকে আমি কতো রান্না শিখিয়েছিলাম”। প্রতিমা বলতেন, “কিন্তু তিনিতো ভালো রাধিয়ে ছিলেন বলে শুনেছি।

“ কবি হেসে বলতেন, “তিনি ভালো রাধিয়ে ছিলেন বলেই, আমার মেনুগুলো সব উতরে যেতো”। কবির নির্দেশে রামায়নের সহজ ও সংক্ষিপ্ত অনুবাদের কাজে হাত দিয়েছিলেন তিনি। শেষ করে যেতে পারেননি। অন্য একটি খাতা পাওয়া গিয়েছিল রথীন্দ্রের কাছে যাতে, তিনি মহাভারতের কিছু শ্লোক, মনুসংহিতা, উপনিষদের শ্লোকের অনুবাদ করেন। কবির নির্দেশে এগুলো ছাড়াও তিনি বাংলার রূপকথা সংগ্রহের কাজে হাত দিয়েছিলেন।

অবনীন্দ্রনাথ তার খাতা থেকেই “ক্ষীরের পুতুল” গল্পটি সংগ্রহ করেছিলেন। মৃনালিনী ঠিক যেভাবে গল্পটি বলেছিলেন, তেমনি হুবহু লিখেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। এই রূপকথার জাদুকরের হাতেখড়ি হয়েছিল মৃনালিনীর কাছে। তিনি প্রচন্ড আমোদপ্রিয় ছিলেন। তার পরিহাসপ্রিয় মনটির খোজ পেতে হলে আমাদেরকে যেতে হবে তার লেখা চিঠিগুলোর কাছে।

কিছু কিছু চিঠি এমনিই ভাষার অলংকরনে বাধানো যে সাহিত্যকেও হার মানায়। কিছু চিঠি সুধীন্দ্রনাথের স্ত্রী চারুবালা যত্ন করে রেখেছিলেন। সহধর্মিনীর কাছে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাশা কি ছিল??? একথা জানতে হলে মৃনালিনীকে লেখা কিছু চিঠির আশ্রয় আমাদেরকে নিতে হবে। চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ তাকে “ভাই ছুটি” সম্বোধন করতেন। “তোমাতে আমাতে সকল কাজ ও সকলভাবেই যদি যোগ থাকত খুব ভালো হতো।

তোমাকে কোন বিষয়ে আমি ছাড়িয়ে যেতে ইচ্ছে করিনে, কিন্তু জোর করে তোমাকে পীড়ন করতে আমার শঙ্কা হয়। সকলেরই স্বতন্ত্র রুচি অনুরাগ এবং অধিকারের বিষয় আছে, আমার ইচ্ছা ও অনুরাগের সঙ্গে তোমার সমস্ত প্রকৃতিকে সম্পূর্ন মেলাবার ক্ষমতা তোমার নিজের হাতে নেই। সুতরাং সে সম্বন্ধে কিছুমাত্র খুতখুত না করে ভালোবাসার দ্বারা যত্নের দ্বারা আমার জীবনকে মধুর, আমাকে অনাবশ্যক দুঃখকষ্ট থেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করলে সে চেষ্টা আমার পক্ষে বহুমূল্য হবে। “ কবির আশা পূরন করেছিলেন মৃনালিনী। জীবনের সবক্ষেত্রে তিনি স্বামীর পাশে থেকেছেন।

এমনকি কোলকাতার ঠাকুরবাড়ির আরাম আয়েশ ছেড়ে কবির সাথে তিনি শান্তিনিকেতনে যেতেও পিছপা হননি। এইধরনের কান্ডজ্ঞানহীন অসাংসারিক কাজের জন্য আত্মীয় স্বজনদের বিদ্রূপ, উপহাস সবই তিনি সহ্য করেছেন কিন্তু স্বামীর পাশ থেকে সরেননি। পাশে থেকে শুধু মানসিকভাবেই নয়, নিজের সমস্ত গয়নাও হাসিমুখে কবির হাতে তুলে দিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের কাজের জন্য। নিজেও আশ্রমের বিভিন্ন অংশের কাজের দেখাশোনা করতেন তিনি তারমধ্যে ব্রক্ষচর্য আর ছোট শিশুদের বিভাগ ছিল তার নিয়মিত কাজের তালিকায়। মৃনালিনী আরো কিছুদিন বেচে থাকলে রবীন্দ্রনাথের আশ্রম বিদ্যালয়ের পরিকল্পনা আরো সার্থক হতে পারতো।

“চারিত্রপূজা” গ্রন্থের এক জায়গায় কবি লিখেছেন, “মহাপুরুষের ইতিহাস বাহিরে নানা কার্যে এবং জীবন বৃত্তান্তে স্থায়ী হয়, আর মহৎ নারীর ইতিহাস, তাহার স্বামীর কার্যে রচিত হইয়া থাকে, এবং সে লেখায় তাহার নামোল্লেখ থাকে না”। এরই মধ্যে মৃনালিনী সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের মনোভাব অনুভব করা যায়। সাধারন ভাবেও বোঝা যায়, স্ত্রীকে নিয়ে মানসিকভাবে শান্তি ও স্বস্তিতে না থাকলে কবি এতো এতো মূল্যবান লেখা আমাদেরকে উপহার দিতে পারতেন না। শান্তিনিকেতন স্থাপনের মাত্র এগারো মাসের মাথায়, এই কঠোর পরিশ্রম সহ্য করতে না পেয়ে মৃনালিনী বিদায় নেন। যাকে “স্বর্ন মৃনালিনী” হওয়ার আর্শীবাদ দিয়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ।

মৃনালিনীকে হারিয়ে রবীন্দ্রনাথ অকূল পাথারে পরেন। প্রতি পদে তার প্রিয়তমা “ভাই ছুটির” অভাব বোধ করতে থাকেন। তার আশ্রম বিদ্যালয় অসম্পূর্ন থেকে গেছে মৃনালিনীর অভাবে। কবির জীবনের যখন সবচেয়ে কঠিন সময় চলছে তখনই তার পত্নী বিয়োগ হয়। সব কথা খুলে বলা যায় এমন লোকের তখন কবির খুবই অভাব।

“স্মরনে” কবিতায় সেই আকুলতাই প্রকাশ পেয়েছে, “তোমার সংসার মাঝে হায় তোমাহীন এখনো আসিবে কত সুদিন - দুর্দিন তখন এ শূন্য ঘরে চিরাভ্যাস টানে তোমারে খুজিতে এসে চাব কার পানে??? “

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.