আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পঞ্চ মাত্রা

শিক্ষিত মূর্খ। আকিবুকি। গননা করবার শখ আর জাগেনা আগের মত। মাথাটাকে না খাটাতে খাটাতে তেলের ড্রাম হয়ে যাচ্ছে।

রাজিন, বনিকে ভালবাসে।

ভালবাসা একটি ক্রিয়া। এর বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবে বনিও রাজিনকে ভালবাসে। চলতে ফিরতে আমরা যে সব ভালবাসা দেখি তা দিয়ে এদের দুজনের ভালবাসাকে সংজ্ঞায়িত করা যাবেনা মোটেও। একটা ছেলে আরেকটা মেয়ে হল গিয়ে চুম্বকের দুই মেরু। আলাদা থাকুক তাতে কোন প্রকার সমস্যা নেই।

কাছাকাছি আসলেই বিস্ফোরন ঘটে। ভালবাসার টানে অনেক ছেলে মেয়েই কাছে এসে পরে। এরপর যা হয় তা আর বলার মত না। ঘনবসতির এই দেশে নির্জন জায়গা অথবা চিপা চাপা খুজে না পেয়ে অসভ্যতামি করে বসে কখনো রিকশায়, কখনো মানুষ ভর্তি পার্কে, কখনো টি এস সি-র আশে পাশে সন্ধ্যার পর গণ ভাবে, কখনো বা কে এফ সি তে ছেলে মেয়ে নিয়ে খেতে আসা কোন বাবা মা কে চরম ভাবে বিব্রত করে। যা বলছিলাম রাজিন আর বনির ভালবাসাকে মোটেও এসব দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা যাবেনা।

কেউ যদি সুইট রিলেশনশিপ দেখতে চায় অথবা তথাকথিত সুস্থ ভালবাসা দেখতে চায় (তথাকথিত বললাম কারণ চলতে ফিরতে ওদের সম্পর্ক বেশ সুস্থই দেখা যায়। কিছু করে থাকলেও কাউকে দেখিয়ে করেনি) তাহলে রাজিন আর বনিকে দেখতে হবে। কোন কিছুতেই বাড়াবাড়ি নেই দুজনের। কম্প্রোমাইজ করে চলছে দুজনই। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় ছেলে পিলেরা বেশ সখ আর জোশের সাথে প্রেম করা শুরু করে।

কয়েকদিন বাদেই বলা শুরু করে লাইফে অনেক পেইন। এক্ষেত্রে রাজিন, বনি আলাদা। এই দুজনকে দেখলে মনে হয় তারা যে একজন আরেকজন কে ভালবাসছে তা দুজনই বেশ উপভোগ করছে। প্রথম মাত্রাঃ প্রফেশন নিয়ে রাজিনের চিন্তা ছিলনা কোন কালেই। কিন্তু বনিকে ভালবাসার পর থেকেই মাথার চুল ধীরে ধীরে কমতে শুরু করল।

দুজনেই সেম এইজ। চিন্তার কারণ প্রধানত এটাই। দুজনের বয়সই ২৪। মেয়েদের জন্য এটা বিবাহের যাকে বলে একেবারে আদর্শ সময় আর ছেলেদের জন্য বলা যায়, বাপু তুমি মিনিমাম ৪-৫ বছর অপেক্ষা কর, এখনই মন কলা খাইয়ো না। রাজিন, বনির ব্যাপারটা দুজনের বাসাতেই মোটামুটি জানে।

তেমন আপত্তি না থাকলেও রাজিনের পক্ষে ২ বছরের আগে কিছু করা সম্ভব না যদি সব কিছু ভাল মত এগোয়। পড়ালেখা যতদিন চলেছে চিন্তা ছিলনা। কিন্তু এখন মাথায় রাজ্যের চিন্তা। কেমনে কিভাবে সব ম্যনেজ করবে। হাতে সময় কম।

দেরী করলেই উলোট পালোট হয়ে যেতে পারে সব কিছুই। বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে দেখলেই মুরুব্বি গোছের লোকেরা ঘটকালি করাটাকে নিজের পবিত্র দায়িত্ব মনে করে। এখন বনির বাসা থেকে এটা সেটা বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু আর কতদিন? সমস্যা মনে হয়েছিল প্রথম প্রথম। কিন্তু পরে দেখা গেল সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যায় সব কিছুই।

রাজিন স্মার্ট ছেলে। প্রথমে চাকরি পেতে একটু ঝামেলা পোহাতে হলেও একসময় জুটিয়ে ফেলল। কজে কর্মে পটু বিধায় দুই এক ধাপ প্রমোশন ও জুটে গেল। এক্সপেরিয়েন্স কে কাজে লাগিয়ে ভাল কোম্পানিতে জয়েনও করে ফেলল। ২ বছর তিন মাসের মাথায় রাজিন, বনির ধুম ধাম করে বিয়ে।

বিয়েতে রাজিন শেরওয়ানি, পাগড়ি পরে এসেছে। ফুটফুটে বনির পাশে রাজকুমারের মত রাজিন। সবার মুখে একই কথা, বেশ মানিয়েছে দুজনকে। একবারে মানিকজোড়। রিসিপশানের দিনতো আর বর পাগড়ি পরেনা।

রাজিন সব কিছু ঘুরে ঘেরে দেখছে ঠিক আছে নাকি। ওদিকে বিয়ে বাড়ির অতিথীদের মধ্যে কানাকানি। হায় হায় বরের মাথায় তো চুলই নেই………… দ্বিতীয় মাত্রাঃ রাজিন, বনির সম্পর্ক প্রায় ৩ বছর ধরে। রাজিন এক অফিসে চাকরি করে, বনি আরেক অফিসে। সারা দিনের কাজের ক্লান্তি ওরা দূর করে বাসায় এসে মোবাইলে কথা বলে।

আজকাল দুজনের দেখা হয় না তেমন। এই যে সামান্য একটা দূরুত্ব এটাই যেন ভালবাসার আগুনে আরো ঘি ঢেলে দিয়েছে। দিনের পর দিন যেতে থাকে। ভালবাসা ধূসর না হয়ে তার উপর আরো রঙ চড়াতে থাকে। ভবিষ্যতের দিনগুলোকে সাজিয়ে তুলবার কল্পনা নিয়ে ওদের গল্প চলতেই থাকে।

একসময় একজন আরেকজনের হয়। ছোট খাটো সুখি সংসার। বিয়ের আগের রঙিন স্বপ্ন গুলো যে বাস্তবতার দাপটে রঙিন থাকবে না তা ভালভাবে জানত দুজনেই। পূর্ণিমার রাতে রাজিনের বুকে শুয়ে চাঁদ দেখা হয়না কখনো বনির কিংবা হয়না দুজনেরই হঠাৎ কোথাও হারিয়ে যাওয়া। যেগুলো হয় তা হল সারাদিন খাটুনির পর বাসায় ফিরে বনির রান্না ঘরে ঢোকা।

একহাতে বাসের হ্যান্ডেল ধরে আরেক হাতে বাজারের ঠোঙ্গা নিয়ে রাজিনের বাড়ি ফেরা। সারাদিনের খাটুনি শেষে শোয়া মাত্রই দুজনের ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া। সারা সপ্তাহ কলুর বলদের মত খেটে ছুটির একটা দিনে শখ করে থিয়েটারে নাটক দেখতে যেতে ইচ্ছে করে না দুজনের কারোই। বাস্তবতা শখ, আহ্লাদ, রোমান্স খেয়ে ফেললেও দুজনেই জানে এমনটাই হবার ছিল। তাই এ নিয়ে দুজনের কোন আক্ষেপ নেই।

আট দশটা সাধারণ মানুষের মত ওদের জীবনটাও পার হয়ে যেতে থাকে……… তৃতীয় মাত্রাঃ বনির বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। রাজিনের প্রায় পাগল হবার মত অবস্থা। ঘটনা শোনার পর থেকে ঘুম সসম্মানে স্যালুট দিয়ে চলে গিয়েছে। চোখের নিচে কালির পুরুত্ব বাড়ছে। চেহারা হয়েছে দেখার মত।

বনির সাথে কথাও বলতে পারছেনা। ফোন দিলে শুধু কান্নাকাটি করে। আসলে বেচারী করবেটা কি? রাজিন জানে সে যদি বনিকে না পায় তবে জীবনটা পুরোই উলোট পালোট হয়ে যাবে। যা মাথায় আসল ওটা ছাড়া আসলে কিছুই করার নেই। লোকে যা বলার বলুক, করার মত এখন এটাই একমাত্র কাজ।

মজা লুটার জন্য তো প্রেম করিনি। প্রথম থেকে মনের মধ্যে এটাই ছিল একজন কে ভালবেসেছি ওকে নিয়েই সারা জীবন কাটাবো। বেজায় শান্ত শিষ্ঠ বনির উপর একটাই ভরসা। সেও আমাকে পাগলের মত ভালবাসে। কথাটা বলা মাত্রই বনি চুপ হয়ে গেল।

তারপর ফোন কেটে দিল। আধা ঘন্টা পর ফোন দিয়ে বলল আমি রেডি তুমি এসে আমাকে নিয়ে যাও। রাজিনের ৪ বন্ধুর সাক্ষী। কাজী অফিসে রাজিন, বনির বিয়ে হয়ে গেল। পরে যা হবার তাই হল।

দ্বিতীয়বার কাজীর উপস্থিতিতে, ধুমধাম করে রাজিন, বনির বাবা মা আবার অনুষ্ঠান করে ওদের বিয়ে পড়িয়ে দিল। চতুর্থ মাত্রাঃ এক্ষেত্রে ভুমিকার অংশটুকু বাদ দিতে হবে। রাজিন, বনির কখনও দেখাই হয়নি। রাজিন ইউ এস এর ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করে এখন ওখানেই পি এইচ ডি করছে। পাত্র হিসেবে একেবারে খাসা।

নেহায়েৎ লাজুক টাইপের ছেলে। মেয়েদের দেখলেই গাল লাল হয়ে যায়। ছেলে মেয়ে দুজনই দুজনকে পছন্দ করেছে। বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর মিয়া বিবি আম্রিকা উড়াল মারে।

সারা জীবন মেয়েদের থেকে ১০০ হাত দূরে থাকা রাজিন বনিকে ঘোরতর ভাবে ভালবেসে ফেলে। পারলে বউয়ের ঘোমটার নিচেই থাকে সারাদিন। একসময় ওদের পরিবারে অতিথী আসবার সময় হয়। বনি নিজের জীবনটা দিয়ে অতিথী কে পৃথিবীতে নিয়ে আসে। পড়ালেখা ছাড়া বাকি সব কাজে ভীষনভাবে অপটু রাজিনকে বড্ড বিপদে ফেলে দিয়ে চলে যায় বনি।

পঞ্চম মাত্রাঃ দেড় বছর হতে চলল রাজিনের চাকরি হবার কোন লক্ষন নেই। বেকারদের জীবনে প্রেম অভিশাপ হিসেবে এসে থাকলেও রাজিনের জন্য অন্তত আসেনি। বনি কে সে ঠিক আগের মতই ভালবাসে। আগে ছোট খাটো গিফট কিনে দিতে পারত। এখন আর সেই সামর্থ্য নেই।

এখান থেকে ওখান থেকে টাকা বাঁচিয়ে ফোনে কথা বলে যাচ্ছে কোন রকমে। আর মেয়েটাও না একদমই অন্যরকম। একটা দিনের জন্যও কোন দাবী দাওয়া পেশ করেনি। মেয়েরা তো অন্তত মাঝে মধ্যে খেতে টেতে চায়। কিচ্ছুনা।

১৩ই এপ্রিল। রাজিন, বনির ভালবাসার তৃতীয় বর্ষপূর্তী। অনেক দিন ঘোরার পর এই দিনটাতেই বনি, রাজিনের ভালবাসায় সায় দিয়েছিল। প্রথম বারের মত আই লাভ ইউ বলেছিল। রাজিন, বনির জন্য এটাই ভালবাসা দিবস।

রাজিনের খুব খুব ইচ্ছে করছিল বনিকে সুন্দর দেখে একটা গিফট কিনে দিতে। বেচারী অনেক খুশী হত। মানিব্যাগ একেবারেই ফুটো। রাজিন বনিকে নিয়ে একটা কবিতা লিখল। বিশাল কবিতা।

অনেক দিন ধরে লিখা একটা কবিতা। ১৩ তারিখ সকালে কবিতাটা প্রিন্ট করেই ছুটল বনির বাড়ির দিকে। বাসে করে নেমে রিকশায় করে যেতে হয়। রিকশা ভাড়া দেবার সামর্থ্য নেই বিধায় হেটেই যেতে হল। বাসার সামনে এসে কল দিয়ে বনিকে নিচে নামতে বলল।

দুজন দুজনকে দেখা মাত্রই সম্পূর্ন অন্যরকম এক অনুভূতি। ভালবাসার যে উত্তাপ তা চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসে। এক কি দু মিনিট রাজিন দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর কবিতার পাতা কয়টি বনির হাতে ধরিয়ে দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে চলে আসে। এরকম টা অনেক বারই হয়েছে রাজিনের।

বনিকে অনেক দিন পর দেখলেই কেন জানি চোখ ভিজে যায়। দুঃখের কোন অনুভূতি নয় এটা। নিখাদ ভালবাসার অনুভূতি। এরপর অনেকটা সময়ই ঘোরের মধ্যে থাকে রাজিন। হেটে হেটে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত আসল রাজিন।

রাস্তা পার হতে যেয়ে এক বেপরয়া বাসের নিচে পড়ল। স্পট ডেড। সেলে একটা ভালবাসার বার্তা টাইপ করছিল। শেষ হয়নি তখনও। বুক ভরা ভালবাসা নিয়ে একটা মেসেজ টাইপ করছিল সে।

রাজিন প্রায়ই বলত বনিকে, আমার ঈশ্বরে তেমন বিশ্বাস নেই তবুও মাঝে মধ্যেই ঈশ্বরের কাছে চেয়ে বসি তোমাকে যেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভালবেসে যেতে পারি আর বুক ভরা ভালবাসা নিয়েই যেন মরতে পারি…… রাজিনের লিখা কবিতা পড়ে বনির চোখ দিয়ে অঝর ধারায় অশ্রু বর্ষণ শুরু হয়েছিল..... বনির চোখের পানি কখনও শু্কোয়নি………

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।