আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কিছু অর্থহীন স্বপ্ন নিয়ে অনন্তকাল ছুটে চলার অস্বস্তি কাটিয়ে ওঠার ব্যস্ততা: ১ম পর্ব

স্বপ্নেরা থাকুক স্বপ্নের মাঝেই

আজকে আমি যা লিখছি তা আর কারও সাথে শেয়ার করার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না কোনদিনও । এমনকি এখনও নেই । তারপরও কেন লিখছি জানিনা । প্রথমেই বলে নিই, এটা আমার ভালবাসার গল্প । একমাত্র ভালবাসার গল্প ।

গল্প? না, না তো! গল্প তো এটা নয় । একদম সত্যি ঘটনা । আমার জীবনের সবচাইতে ইম্পর্টেন্ট এবং কষ্টদায়ক ঘটনা । তারপরও এখন মাঝে মাঝে এটাকে গল্প বলে ভ্রম হয় । কেন? কে জানে.... অনেক ছোটবেলার কথা ।

তখন আমার বয়স খুব বেশী হলে ৮ কিংবা ৯ । আর আমার প্রিয়তমার বয়স তখন হবে ২ কিংবা ৩ । সম্ভবতঃ ১৯৯৩ বা ৯৪ সালের ঘটনা । প্রতিদিন আমি ভাইয়া আর আপুর সাথে সকালে উঠে উঠানে বসে থাকতাম । মা উঠানের কোনের মাটির চুলাতে রুটি তৈরী করতেন ।

আমরা তিন ভাইবোন গোল হয়ে বসে বসে রুটি খেতাম । কখনও কখনও আব্বাও আমাদের সাথে বসতেন । তবে অধিকাংশ সময় আব্বা থাকতেন না । আগেই খেয়ে নিয়ে অফিসে চলে যেতেন । এমনই এক সকালে আমরা বসে বসে রুটি খাচ্ছি আর গল্প করছি, হঠাৎ করে একটা লোক ২/৩ বছর বয়সি একটা ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েকে কোলে করে নিয়ে আসল ।

লোকটার চেহারা এখনও আমার আবছা আবছা মনে আছে । কিন্তু বড় হওয়ার পর সেই চেহারাটা আর কারও সাথে আমি মেলাতে পারিনি । সেদিন অবশ্য ওই লোকের চেহারার চেয়ে আমার আগ্রহ বেশী ছিল মেয়েটার প্রতিই । কিছুক্ষনের মধ্যেই আমি তার নাম জেনে ফেললাম । অনিবার্য কারন বশতঃ এখানে তার আসল নামটা উল্লেখ করতে পারছি না বলে দুঃখিত ।

সেই ছোট্ট মেয়েটার একটা নাম দেওয়া যাক । ধরি তার নাম ছিল অর্ণা । মজার বিষয় হল যখন তাকে প্রথম দেখি তখন তার চোখে ছিল শুকিয়ে যাওয়া অশ্রু । অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল তাকে !! আপনারা হয়ত ভাবছেন ৮/৯ বছরের একটা ছেলে কিভাবে এত কিছু লক্ষ্য করল, আবার মনেও রাখল । সেইটা আমার নিজের কাছেও রহস্যময় ।

মানুষের মস্তিষ্ক বড়ই রহস্যময় এবং জটিল পদার্থ । কখন যে কোন স্মৃতিকে সযত্নে সংরক্ষন করে আর কখন কোন স্মৃতিকে মুছে ফেলে সেইটা অন্তত আমি একটুও বুঝতে পারি না । অর্ণাকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসার কারন ছিল ও প্রচন্ড কান্নাকাটি করছিল । কিছুতেই ওর কান্না থামানো যাচ্ছিল না । তাই কান্না থামানোর জন্যই ওকে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে হয়ত আমাদের বাসায় চলে এসেছিলেন সেই আনআইডেন্টিফাইড লোকটা এবং আমাদের কাছে ওকে রেখে উনি চলে গিয়েছিলেন ।

আমি অবাক চোখে নেড়েচেড়ে দেখছিলাম ছোট্ট পুতুলের মত মেয়েটাকে । কিছুক্ষনের মধ্যেই ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল । ওকে কোলে নিয়ে খেলতে শুরু করলাম আমি । মজার বিষয় হল ও তখন তোতলা করে কথা বলত । অবশ্য ওই বয়সের বাচ্চারা একটু তোতলা হতেই পারে ।

সেটা কথা নয়, কথা হল ও সবাইকেই আপু বলে সম্বোধন করত । এমনকি ভাইয়াকে বা আব্বাকেও আপু বলত । ওর অভিধানে হয়তো 'আব্বু' আর 'আম্মু' ছাড়া আর একটা সম্বোধনই ছিল । ওর সাথে আমার প্রথম দেখার দিনটা সম্পর্কে আমার এতটুকুই মনে আছে । তারপর ওর সাথের আরও অনেক অনেক রঙিন স্মৃতি ভীড় করে আসছে আমার মনের ভিতরে ।

প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমার প্রথম কাজ ছিল অর্ণাদের বাসায় গিয়ে ওকে ঘুম থেকে জাগানো । তারপর ওর আম্মু ওকে রেডি করিয়ে আমার কোলে তুলে দিতেন । আমি ওকে কোলে করে নাচতে নাচতে বের হতাম । অর্ণাও আমাদের বাসাতেই বেশী সাচ্ছন্দ বোধ করত । ওকে রেখে স্কুলে যেতাম ।

তখন স্কুলে ক্লাস হত সকাল ৯টা থেকে ১টা পর্যন্ত । স্কুল থেকে ফিরে আবার মেতে উঠতাম খেলায় । বলতে গেলে আমার অধিকাংশ সময় কাটত ওর সাথে খেলা করে । প্রায় প্রতিদিনই ওর আব্বু অনেক রাত্রে এসে ঘুমন্ত অর্ণাকে নিয়ে যেত আমাদের বাসা থেকে । তখনকার প্রতিটা দিনই ছিল রঙিন, ওর সাথের প্রতিটা মূহুর্ত ছিল আনন্দদায়ক ।

অদ্ভুত একটা টান ছিল ওর প্রতি । কিরকম একটা টান!! আমি ঠিক বলে বুঝাতে পারব না । আসলে ওই বয়সের এই টানটাকে ঠিক প্রেম বলা যায় না । আবার অন্য কিছুও বলা যায় না । কি ভাবে সংজ্ঞায়িত করব এটাকে? আদৌ সংজ্ঞায়িত করা যাবে কি? সব কিছুরই একটা শেষ আছে ।

তাছাড়া সুখের সময় কেন জানি বেশীক্ষন স্থায়ি হয় না । কিছুদিন পরেই ওদের ফ্যামিলির সাথে আমাদের ফ্যামিলির কি যেন একটা গন্ডগোল হল । এই বিষয়টা আমার মস্তিস্ক মুছে ফেলেছে । কিছুতেই মনে করতে পারি না কি বিষয়ে গন্ডগোলটা হয়েছিল । কাউকে জিজ্ঞাসাও করতে পারি না, অন্য একটা কারনে ।

অর্ণাকে আর আমাদের বাসায় আসতে দেওয়া হত না । কিন্তু আমাদের অপরিপক্ক কচি মন কি পারিবারিক গন্ডগোল মানতে চায়? যথারীতি আমি প্রতিদিন ওকে নিয়ে আসতাম । ওর আম্মু হয়ত আসতে দিতে চাইতো না । কিন্তু ওর কান্নার কাছে হার মানতেই হত । ঝামেলা হত আমাদের বাসায় এসে ।

সবাই আমাকে বকাঝকা করত ওকে নিয়ে আসার অপরাধে । এমনই একটা দিনের কথা আমার স্পষ্ট মনে পড়ে । আমি অর্ণাকে কোলে করে নিয়ে এসে দরজা দিয়ে ঢুকছি, ভাইয়া আমাকে দেখে ভয়ানক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বকা দিচ্ছে । বজ্রকন্ঠে জিজ্ঞাসা করছে 'ওকে এনেছিস কেন?' আমি অর্ণাকে কোলে নিয়ে শক্ত করে ধরে আছি আর অর্ণা আমার গলা জড়িয়ে ধরে আছে । ওর চোখের কোনে অশ্রু ।

আমিও কাঁদছি । দৃশ্যটা এতটা স্পষ্ট যে আমার মনে হয় এই কিছুক্ষন আগের ঘটনা । শেষে দু'জনে মিলে একটা বুদ্ধি বের করেছিলাম । ওকে দরজার সামনে দাড় করিয়ে রেখে আমি আগে বাসায় ঢুকতাম । কিছুক্ষন পরে ও ঢুকত ।

কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলত ও একা একা এসেছে । কিন্তু বড়রা তো আর আমাদের মত বোকা ছিল না । সবাই ঠিকই ঘটনা বুঝে ফেলত । তারপর আবার অর্ণাকে ওদের বাসায় রেখে আসত । আমাদের দু'জনের কান্নাকে মোটেও পাত্তা দিত না ।

প্রথম দিকে খুব কষ্ট হত । কিন্তু সময় এমন একটা শক্তি যে সকল দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দিতে পারে । আর আমাদের ঘটনা তো সামান্যই ছেলেমানুষি ছাড়া আর কিছুই ছিল না । তারপর একসময় ভুলে গেলাম দু'জনেই দু'জনকে । অর্ণা হারিয়ে গেল আমার কাছ থেকে ।

তবে হৃদয়ের মনিকোঠায় যে আবদ্ধ হয়ে ছিল সেটা বুঝেছি আরও অনেক পরে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।