আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অমীমাংসিত.....

আমি জন্মগত ভাবেই একজন উৎকৃষ্ট পাঠক । তবে একাকীত্ব কাটানোর জন্য মাঝে মাঝে নিকৃষ্ট মানের লেখাও লিখি ।

স্টেশনের ওয়েটিং বেন্ঞ্চিতে বসে আছে মাইশা । তার বসার ভঙ্গিটি বিষণ্ন । সাড়ে এগারোটায় তার ট্রেন ।

সময় প্রায় হয়ে এল । কিন্তু তার ব্যস্ত চোখ এখনো এদিক ওদিক কাকে যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে । সে চোখে স্পষ্ট হতাশা, আশা ভঙ্গের যাতনা । মাইকে লাস্ট এনাউন্সিং টা শোনা গেল । ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল সে ।

ধীর পায়ে এগিয়ে গেল তার কামরার দিকে । তার হতাশা এখন ক্ষোভে রূপ নিয়েছে । 'হারামির এত্তবড় সাহস, আমাকে সি অফ করতে আসে না ! আর জীবনেও বদমাইশটার সাথে কথা বলব না'- দাঁত কিড়মিড়িয়ে উঠে সে । ট্রেনের সিঁড়িতে পা রাখতেই চোখের কোণা দিয়ে কাকে যেন ছুটে আসতে দেখা গেল । সেদিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারল নীল আসতেছে ।

এতক্ষণে ঠোঁটের কোণায় মিষ্টি হাসি দেখা গেল । হাঁদারামটা অলওয়েজ লেট । আর একটু দেরি হলে তো দেখা হওয়াটাই মিস হয়ে যেত । নীল এসেই হাঁফাতে হাঁফাতে বলল- স্যরি স্যরি স্যরিরে... মাইশার কন্ঠে কপট রাগ- তোরে না বলছি ঐ বাজে শব্দটা আমার সামনে আর উচ্চারণ করবি না ? এত দেরি করলি ক্যান ? আর একটু হলেতো দেখাই হত না । যা তোর সাথে আজ আর কথা নাই ! নীল কান ধরে ন্যাকু ন্যাকু স্বরে বলে- এত রাগ করিস ক্যান ? এই যে দেখ- কান ধরছি ।

আর কোনদিনও দেরি হবে না । নীলের মুখের দিকে তাকাতেই মাইশার সব রাগ কর্পূরের মত উবে গেল । ছেলেটার চেহারায় এত মায় কেন ? এই চেহারার দিকে তাকিয়ে কি রাগ করে থাকা যায় ? :- হয়েছে হয়েছে । আর ঢং করতে হবে না । বাকিরা কই ? :- বাকিরা আসবে না ।

:- ওহ । কিন্তু তুই এত দেরি করলি কেন ? :- একটু আটকে গিয়েছিলাম রে... :- তা তো আটকাবিই ! তোর মাথায় কি হয়েছে ? :- আর বলিস না । ছোট খাটো একটা এক্সিডেন্ট । :- এক্সিডেন্ট !? কি হয়েছে ? কেমনে ? মাথা ফাটছে ? বেশী নাকি ? :- উঁহু ! এত ব্যস্ত হইস না । সামান্যই.... :- সত্যি তো ? :- হুম ।

:- তুই যা বেখেয়ালী ! এখনো যে মরছ নাই এটাই ভাগ্য । :- কে বলল মরিনি ? :- তুই মরেছিস ? তাহলে তো ভালই ! বন্ধুদের মাঝে দু একটা ভূত থাকা মন্দ না ! :- একটা কথা বলি ? :- বল... :- তোকে না আজ খুব সুন্দর লাগছে ! :- তোর কাছে আমাকে কোনদিন সুন্দর লাগেনা বলতো ? মাইশা হেসে উঠল । নীলের চেহারায় লজ্জার আভা । আচ্ছা, ছেলেটা এত লাজুক কেন ? প্রচন্ড একটা হুইসেল । তারপর ট্রেন চলতে শুরু করল ।

মাইশা গেইটে দাঁড়িয়ে, নীল প্লাটফর্ম ধরে ট্রেনের সাথে হাঁটছে । :- তোকে আরেকটা কথা বলি ? :- হ্যাঁ বল না.... :- তোকে খুব ভালবাসি রে.... :- জানি তো ! :- না জানিস না তুই । মরিয়া হয়ে উঠল নীল । সে জানে মাইশাকে কিছু বলার এটাই তার শেষ সুযোগ । এই সুযোগ দ্বিতীয় বার কখনো আসবে না ।

তাই সবটুকু সাহস, সবটুকু শক্তি একত্রে করে বলে উঠল- তুই জানিস না । তুই জানিস আমি শুধুই তোর বন্ধু । কিন্তু তুই জানিস না- আমার সবটুকু জুড়েই আছিস শুধু তুই । :- নীল, তুই এসব কি বলছিস ? :- যেটা শুনছিস সেটাই । তোকে আমি ভালবাসি ।

অনেক অনেক বেশী ভালবাসি । এ ভালবাসা বন্ধুর ভালবাসা নয় । তার চেয়েও অনেকখানি বেশী কিছু । ট্রেনের গতি বাড়ছে । এখন আর হেঁটে এর সাথে ভারসাম্য রক্ষা সম্ভব না ।

নীল দৌড়াচ্ছে, তার দৃষ্টি মাইশার দিকে । :- তুই জানিস নীল, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে । দুদিন পরেই আমার বিয়ে । আমি গ্রামে ফিরছিই বিয়ে করার জন্য । তুই এটা জানিস ।

দুইদিন পর তোরা সবাই সেখানে আসছিসও । আর তুই কিনা আজ আমাকে এসব বলছিস ? :- হয়ত আর কখনো বলার সুযোগ পাবো না, তাই বলছি রে.... :- না, এখন আমি কিছু শুনবো না । ভালই যদি বাসতি, তাহলে আগে বলতি ? এখন কেন বলছিস ? এখন আমি কিছু শুনবো না । তুই চলে যা নীল.... তুই চলে যা এখান থেকে.... নীল থমকে দাঁড়িয়েছে । মাইশা দ্রুতগতিতে দূরে সরে যাচ্ছে ।

ভালবাসার মানুষটির এভাবে চলে যেতে দেখা অনেক কষ্টের... অনেক অনেক কষ্টের একটি দৃশ্য । নীলকে চলে যেতে বলেই মাইশা ভিতরে চলে এল । প্রচন্ড কান্না আসছে তার । চেপে রাখার কোন চেষ্টাই সে করল না । ডুঁকরে কেঁদে উঠল ।

কেন কাঁদছে সে ? প্রিয় বন্ধুটিকে ফিরিয়ে দেয়ার কষ্টে ? নাকি পরম আরাধ্য ভালবাসাকে হাতের নাগালে পেয়েও ধরতে না পারার যন্ত্রনায় ? সে জানে না । সে কিছুই জানে না..... (লুতুপুতুর পাঠকরা এখানেই ক্ষ্যামা দেন ! বাকি অংশটা তাদের জন্য না । আর কিউরিয়াস পাঠকরা- যারা বাকিটা পড়তে চান, নিজ দায়িত্বে পড়বেন । পড়েই চুপ মেরে যাবেন । কোন ব্যাখ্যা চাইবেন না !) জানালার পাশেই মাইশার সিট ।

অঝোর ধারায় কাঁদছে সে । এমন সময় তার ফোন বেজে উঠল । বান্ধবী তিশা করেছে । নিজেকে কোনমতে সামলে ফোন ধরল । :- হ্যাঁ বল.... :- কোথায় তুই ? :- এই তো... ট্রেনে ।

:- ট্রেন কি ছেড়ে দিয়েছে ? :- এইমাত্র ছাড়ল । তোরা আমাকে সি অফ করতে আসলি না কেন ? :- তোর কি আজকে যেতেই হবে ? আজ না গেলে হয় না ? :- কেন ? কি হয়েছে ? :- খুব বেশী দরকার না হলে সামনের স্টেশনে নেমে যা । :- আরে আজিব ! কি হয়েছে সেটা তো বলবি ! :- নীল আর নেই । :- নেই মানে ? কোথায় গেছে ? :- মাইশা, নিজেকে একটু শক্ত কর.... নীল মারা গেছে । :- ফাইজলামি করছ ? একটু আগেই তো..... জানালা দিয়ে পিছনে তাকাল মাইশা ।

সেখানে কেউ নেই । থাকার কথাও ছিল না । :- একটু আগে কি ? :- একটু আগেই তো ওর সাথে দেখা হল । আমাকে সি অফ করতে এসেছিল । :- মাথা খারাপ তোর ? সাড়ে দশটায় ওর এক্সিডেন্ট হয়েছিল ।

সাথে সাথেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় । কিন্তু লাভ হয় নি । ব্রেনে প্রচুর ড্যামেজ হয় । রিকভার করা যায় নি । :- কি বলছিস তুই ? আমি.... :- দেখ মাইশা, তোর হয়ত কোথাও ভুল হচ্ছে ।

আমরা সবাই না তোকে সি অফ করতে যাওয়ার কথা ছিল ? ওকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম বলেই তো যাওয়া হয়নি । এক্সিডেন্টের পর থেকেই ওর সাথে আছি । একটু আগে ডাক্তার তাকে অফিসিয়াল ডেড ঘোষণা করে । তোকে অনেকবার ফোন দিতে চেয়েছিলাম । কিন্তু তোর ফোন আনরিচেবল ছিল ।

ও তো তোর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল । ওকে শেষ দেখাটা দেখার জন্য কি তুই থাকবি না ? প্লিজ, তুই চলে আয় না.... তিশা আরো অনেক কথাই বলে চলেছে । কিন্তু সেসবের কিছুই মাইশার কানে ঢুকেছে না । বন্ধু বিয়োগের ব্যথা তাকে এখনো স্পর্শ করছে না । সে বুঝতে পারছে না আসলে তার সাথে কি হচ্ছে ? নিজেকে কেমন যেন অনুভূতি শূন্য মনে হচ্ছে ।

[[পনের বছর পর]] :- স্কুল থেকে ফিরে আন্টিকে একটুও জ্বালাবে না, ঠিকাছে আব্বু ? :- ঠিকাছে আম্মু । :- দুপুরে ঠিকমত খেয়ে নিবে, বিকেলে জুস খেয়ে বাইরে খেলতে যাবে, ভিডিও গেমস নিয়ে একদম বসবা না । মনে থাকবে তো ? :- বললাম তো থাকবে । একই কথা প্রতিদিন বলো কেন ? আমি তো এখন আর বাচ্চা নাই ! :- ওরে আমার পিচ্চিরে..... তিনি তো এখন বড় হয়ে গেছেন ! দেখি তো কত বড় হয়েছেন ? :- ধরবা না আম্মু... ধরবা না... ধরবা না.... মাইশা হৃদয়কে ঝাপটে জড়িয়ে ধরতে যায় । কিন্তু হৃদয় হাত গলিয়ে বেরিয়ে যায় ।

যা দুষ্টু হয়েছে পিচ্চিটা ! সেদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ হাসে মাইশা । তারপর ব্যাগ নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় । মাইশা একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর । অনেক বড় পোস্ট, দায়িত্বও অনেক । সময় মত বাসায় আসা হয় না তার ।

এজন্য বাচ্চাকে নিয়ে টেনশনের শেষ নেই । হৃদয়, তার ছেলে । তাকে দেখাশোনার জন্য একজন গভর্নেস আছে । কিন্তু তারপরও সে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে না । মায়ের মন তো ! পুরো কাহিনী না জানা থাকলে বাইরে থেকে দেখে কেউই বুঝতে পারবে না যে হৃদয় তার গর্ভের ছেলে না ।

তাকে সে একটি অরপানেজ থেকে দত্তক নিয়েছিল । সত্য ঘটনা হচ্ছে- মাইশা কখনো বিয়েই করেনি । সেদিন সামনের স্টেশনে নেমে গিয়েছিল সে । ছুটে গিয়েছিল হাসপাতালের মর্গে, যেখানে তার প্রিয় বন্ধুটি শান্তিতে ঘুমাচ্ছে । লাশেল পাশে বসে ছিল কিছুক্ষণ ।

তারপর তার কি হল কে জানে ? সিদ্ধান্ত নিল সে আর বিয়ে করবে না । বাবা-মা অনেক চেষ্টা করেও তাকে আর বিয়েতে রাজি করাতে পারে নি । সে বিয়ে করেনি এটা সবাই জানে । কিন্তু কেন করেনি এটা কেউই জানে না । সব কথা কি সবার জানতে হয় ? কিছু রহস্য না হয় অমিমাংসীতই থেকে যাক..... (( The End )) অফটপিকঃ বিখ্যাত ব্লগার নাজিম-উদ-দৌলা ভাইয়ের একটা গল্প পড়েছিলাম ।

সেখানে- নায়ক মারা যাওয়ার পরও ফিরে এসে তার বউকে বিপদ থেকে উদ্ধার করে বাসায় পৌঁছে দেয় ! আমার গল্প না হয় নায়ক মারা যাওয়ার পর এসে তার প্রেমিকাকে প্রপোজ করে গেল ! ক্ষতি কি ? প্রথমেই বলেছি, গল্পের কোন ব্যাখ্যা চাইবেন না । পৃথিবীতে সব ঘটনার ব্যাখ্যা থাকতে হয় না । তবে আসল কথা হল- এই গল্পের কোন ব্যাখ্যা আমার কাছেও নেই ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।