আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সীমান্ত- ছোটগল্প



বুবুনের কথা স্কুলে থাকতে প্রায়ই মনে হতো, আচ্ছা, আমি কেন এমন হলাম?! কেন আমি রাতুল, মিঠু কিংবা সজলের মতো হলাম না। রাতুল সব পরীক্ষায় বরাবর প্রথম হতো; ডিবেটে মিঠুকে হারায়, এমন কেউ- অন্য কোন স্কুলে কেন, কলেজগুলিতেও ছিল না! সজল কতোবার স্কুল গেইমসে চ্যাম্পিয়ন হলো। আচ্ছা, এতো চটপটে নাহয় নাইবা হলাম; কিন্তু তাই বলে এতো বোকা হলাম কেন? ইতু আপা আমাকে সবসময় বুবনা গাধাটা বলেই ডাকে। এমনকি, এই যে এখন ভার্সিটিতে পড়ছি, তাতেও তার কোন বিকার নেই। ইতু'পাটা এত্তো ঠোঁটকাটা! একসময় খুব ফ্রাস্টেটেড হয়ে পড়েছিলাম।

প্রায়ই কলেজে যেতেই ইচ্ছে করতো না। যেদিন ইতু'পার ক্লাশ থাকতো না, সেসব দিনে তো যেতামই না। বাসায় বসে বই পড়ে , নয়তো নোট্‌স ঘেটেই সময় কাটিয়ে দিতাম। সেকেন্ড ইয়ারে যখন অ্যাটেনডেন্সের ঝামেলাটার কথা ইতু'পার কানে গেলো; কি যে রাগ!! তবে এতে একটা লাভ হয়েছিলো; ক্লাশ থাক না থাক লাইব্রেরী ওয়ার্ক এর জন্য হলেও সে কলেজে যেতো, পেছন পেছন আমি! তবে বোকাসোকা আর সাধারন মানের স্টুডেন্ট হয়েও যে ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছি, তার পুরো কৃতিত্বটাই ইতু'পার। ও না থাকলে, আমাকে ঠেলে ধাক্কা দিয়ে ভার্সিটিতে পড়ানোর- আর কারো দায় পড়েনি ।

বাসা থেকেও ধরে নিয়েছিলো, বোধহয় কলেজেই কোন একটা সাবজেক্টে, অনার্সে ঢুকে যাবো। ছোটাপ্পি তো ভার্সিটির রেজাল্ট শীটে আমার নাম দেখতে পেয়ে প্রায় ভিমড়ি খেয়ে গেছিল! সে তো ঘোষনা দিয়েই দিলো- " বুবুন যদি সিজিপিএ ৩ এর উপরে রাখতে পারে তাহলে ওকে বিদেশে মাস্টার্স করার খরচ আমি দিবো। " ভাবখানা এমন যেন কাড়ি কাড়ি টাকা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ! অবশ্য দুঃখের ব্যাপার হলো; আমি পাশ করতে করতে যে- সে, অনেক টাকা পয়সা কামাবে- তাতে কোন সন্দেহ নেই। থার্ড ইয়ারে উঠেই পড়াশোনার বাইরে কিসের কিসের সব কন্সাল্টেন্সি করে ইদানীং বেশ ভালোই টাকা পয়সা কামাচ্ছে দেখি! আচ্ছা! দেখা যাবে সময় হলে! চোখ উল্টাতে কিন্তু খুব ওস্তাদ ছোটাপ্পিটা! ইতু'পাটা নিজে কিন্তু এতো ভালো রেজাল্ট নিয়েও ভার্সিটিতে ঢুকলো না। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে।

নয়তো কলেজে কি আর ওর দেখা পেতাম? আমি ভার্সিটিতে ঢুকার পরপরই ইতু আপার সাথে দেখা হওয়াটা কমে যাচ্ছিল। ক্লাশ, টিউটোরিয়াল এর ফাঁকে মাঝে মাঝেই ইতু'পার সাথে দেখা করতে মনটা এমন করতো! ছুটির দিন গুলিতে থাকতাম খুব মজায়। সারাদিন ইতু'পাদের বাসায়। আমি, ইতু'পা আর আংকেল মিলে খুব মজা করি। কখনো মুভি দেখা; কখনো ব্রিজ খেলা কখনো ক্যারাম।

আংকেল তো আমাকে খুবই পছন্দ করেন। ঔনি খুব মজার মানুষ। কখন কি করেন, কোন ঠিক নেই। এতো সুন্দর করে ছবি আঁকতে পারেন। শুনেছি আনটির সাথে নাকি অনেকদিন ধরে বনিবানা হচ্ছেনা।

আন্টি অবশ্য পি এইচডি করতে বেশ কিছু সময় ধরেই স্টেটস এ আছেন। ক্যারামে হেরে গিয়ে আংকেল মাঝে মাঝে আমাকে অনেক খোঁচায়- আংকেল বলে, " কিরে তুই কি আমার মেয়ের জামাই হবি নাকি?! আমার কিন্তু অমত নেই । " শুনে আমি যে কই লুকাবো বুঝে উঠতে পারিনা। কিন্তু শুনতে ভালও লাগে! আর ইতু'পা বলে, "বাবা তুমি যে কী!! খালি খালি ছেলেটাকে বিব্রত করো কেন?!" একদিন আমি বলে ফেলেছি- " হ্যাঁ, হবো!" শুনে ওরা দুজন কি যে হাসি!! আমি পুরো একটা সপ্তাহ আর ঐ মুখো হয়নি। শেষে ইতু'পা বাসায় এসে আমার হাত ধরে স্যরি ট্যরি বলে গেলো।

আরে, আমি কি রাগ করেছি নাকি?! ইতুপাটাও এতো সিধা টাইপ না! বুবুনের শুনতে ভালোই লাগে। ইশতিয়াক ভাইয়াকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। ইতু'পার কাজিন। ছোটবেলা থেকেই দেখছি। বেশ আমুদে লোক, আমারও খুব ভালো লাগতো ভাইয়াকে।

তাই যেদিন শুনলাম ইশতিয়াক ভাইয়ার সাথে নাকিই ইতু'পার বিয়ে হতে যাচ্ছে, খুব একটা অবাক হইনি, কিন্তু যতোটা খুশী হবার কথা ছিল; সেই উচ্ছাসটুকু কেন যেন মনের ভেতর থেকে আসছিলো না। এরপর যেদিন বিয়ের ডেট ফিক্স হয়ে গেলো, কেমন যেন অচেনা একটা কষ্ট আমাকে ঘিরে ধরতে শুরু করলো। মনে পড়ে খবরটা শোনার পর তিন দিন আমি আর ইতু'পার মুখমুখি হতে পারিনি। শুধু মনে হচ্ছিল ও যদি কিছু টের পেয়ে যায়! ঠিক এই সময়ে অঘটনটা ঘটলো। আন্টি ইউএস এ থেকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিলেন।

ইতু'পা ব্যাপারটা কিভাবে নিতো বলতে পারবো না। কিন্তু ইশতিয়াক ভাই এর ফ্যামিলি বিয়েটা ভেঙ্গে দিলো। কারণ তারা ছিল ইতুর বাবার সুত্রের আত্মীয়। তারা এখন আর অগ্রসর হবেনা জানিয়ে দিলো স্পস্ট। ইশতিয়াক ভাইয়াকে আমি নিজে অনুরোধ করেছিলাম।

কিন্তু তার কথাগুলি এখনও আমার কানে বাজে। " বুবুন, তুমি বুঝবে না; আমি আমার পরিবারের মতের বাইরে কিছু করতে পারবো না। তুমি পারলে ইতুকে একটু বোঝাও। ও তোমার কথা অনেক শোনে, তোমাকে অনেক পছন্দ করে, তুমি বললে হয়তো ও কিছুটা সামলে উঠতে পারবে"। সেই মুহুর্তে আমি কিছু বলতে পারছিলাম না তাকে।

তবে রাগের তীব্রতায় আমার মাথা ঝনঝন করছিলো! এমন মেরুদন্ডহীন লোককে ইতু'পা ভালো বাসতে পারলো কিভাবে? রাগটা সামলানো গেলোনা। অঘটনটা ঘটানোর পর কেউই ভাবতে পারেনি কাজটা আমি বা আমাদের গ্রুপের কেউ করেছে। কিন্তু পরদিন সকালে ইতু'পা ঠিকই চলে আসলো আমাদের বাসায়। আমাকে ছাদে ডেকে নিয়ে গেলো। কথা নেই বার্তা নেই ঠাশ করে একটা চড় বসিয়ে দিলো আমার গালে।

" ভেবেছিস কী? খুব মাস্তান হয়ে গেছিস? কেউ টের পাবেনা, কারা ইশতিয়াককে পিটিয়েছে?! খুব বাহাদুরের মতো কাজ করেছিস, নিরীহ একটা লোকের গায়ে হাত তুলে?" আরেকটা চড় তুললো ইতু`পা। আমি ঠেকানোর কোন চেষ্টা করলাম না। শুধু তাকিয়ে ছিলাম তার চোখের দিকে। আমার দৃষ্টির ভেতর জানিনা কি ছিল। ইতু`পার জন্য কষ্ট, নাকি ইশতয়াক ভাইয়ের জন্য ঘৃণা!? জানিনা।

কিন্তু বিয়ে ভেঙ্গে যাবার পর এই প্রথম ইতু`পাকে কাঁদতে দেখলাম। অনেকক্ষণ আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। পুরো সময়টায় আমি একটা কথাও বলিনি। বলতে ইচ্ছে হয়নি। শুধু মনে হয়েছিলো, অনন্তকাল যদি এভাবে থাকা যেতো! আমাদের আড্ডাটা ভেঙ্গে গেলো।

ইতু`পাদের বাসায় আর যাওয়া হলোনা আমার। মাঝে মাঝে ইতু`পা আমাকে ডাক দিয়ে বাসা থেকে বের করে নিয়ে যেতো। বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশ দিয়ে নদী পার ঘেষে অনেকদূর হেটে যেতাম আমরা। ইতু`পা আমার হাতটা ধরে রাখতো। কোন কথা বলার প্রয়োজন পড়তোনা কেন যেন।

বোকাসোকা আমার ছোট্ট পৃথিবীর সবটুকু চাওয়া দিয়ে ঐ সময়টুকুকে ধরে রাখতে চেয়েছিলাম অনন্তকাল। কিন্তু...................। পরিশিষ্ট শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়দের কাছ থেকে নীলা কখনো খুব বেশী কিছু আশা রাখতো না। জাহেদের সাথে তার বনিবনা না হওয়ার অনেক কারণের মধ্যে সেটাও একটা। ডিভোর্সের পরে তাই ইশতিয়াকের সঙ্গে যখন ইতুর বিয়েটা ভেঙ্গে গেলো, সে মোটেই অবাক হয়নি।

কিন্তু মেয়েটার কথা ভেবে তার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। মা, মেয়ের দুজনেরই হয়তো জাহেদের উপর ক্ষোভ ছিল। নীলা মেয়েকে ইউ এস এ তে নিজের কাছে আনার ব্যবস্থা করলো। ইতু জানেনা সে বুবুনকে ভালোবাসে কিনা। কিন্তু ইশতিয়াকের জন্য তার কষ্ট হচ্ছিলো সেটা ঠিক; আর বুবুন সাথে থাকলে সেই কষ্টের কথাও ভুলে থাকা যায় সেটাও ঠিক।

কিন্তু, এ হয়না। সে কাছে থাকলে বুবুন আরো কষ্ট পাবে। সবার কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়াটাই হয়তো ঠিক হবে। ঢাকা এয়ারপোর্টে কেবল বুবুন আর জাহেদ এসেছিলো। চেকইনের আগে বিদায় নেবার পালা।

ইতুর চোখটা ছলছল করে উঠলো । "তোকে কাছে টেনে ধরে রাখার ক্ষমতা যে আমার নেইরে বুবনা! তাই দূরে সরে যাওয়াই ভালো। জানি, কষ্ট পাবি; অনেক কষ্ট হবে তোর। আমি যে যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে গেছি, তার চাইতে অনেক বেশী কষ্ট হয়তো তুই পাবি। তুই যে অনেক সহজ সরল রে।

মনে কর, ভালোবাসার এই কষ্ট টুকু আমি তোকে দিয়ে গেলাম। আমার সাধ্যের সীমান্তের ভেতরে এর চাইতে আপন কিছু যে আর দেবার ক্ষমতা নেই............" স্পীকারের তীক্ষ্ণ কর্কশ শব্দে তার শেষ কয়টা কথা অস্পষ্ট মতো শোনালো। কিন্তু বুবুন জানে কান্না চেপে কথা বলতে গেলে, ইতুর কথা বরাবর এমন নিশ্চুপ হয়ে আসতে থাকে। বোর্ডিং এর জন্য শেষবারের মতো অ্যানাউন্স করা হলো। বুবুনের ধরে রাখা হাতটা আলতো ভাবে ছেড়ে দিলো সে।

তার বাবার দিকে একবারও আর তাকালো না। ইমিগ্রেশন পার না হওয়া পর্যন্ত ওকে দেখা যাচ্ছিল। ফিরে তাকায়নি সে। পিতার উপর অভিমানটা কাটবে না সহজে, সেটা জানে বুবুন। কিন্তু তাকে ফিরে কেন দেখলো না?! অকারন অভিমানে তার চোখে বাস্প জমে উঠে।

জাহেদ ও সে হেটে যেতে থাকে কার পার্কিং এর দিকে। ভিন্ন রকম ভালবাসার সীমান্তে আটকে পড়া দুইজন, কোথায় যেন একটা অদৃশ্য সম্পর্কের সুতোয় বাঁধা পড়ে গেছে অজান্তেই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।