আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সীমান্ত শহরে তিনটা দিন

আ মা র আ মি

আবার ঘুরে এলাম বর্ডার টাউন 'সাতক্ষীরা' থেকে। তবে এবার উপলক্ষ ছিলো ভিন্ন। পৌছেছিলাম দশমীর দিন, বিসর্জন দেখতে। সাথে সুন্দরবন ঘুরে এসেছি খানিকটা। যাত্রা: আমার বাস রাত সাড়ে দশটায়।

কিছু কেনাকাটা বাকি থাকায় খানিকটা আগেই বাসা থেকে বেরুলাম। কিন্তু যা কিনবো তা পেলাম না, বন্ধু আমিন অপেক্ষা করছিলো ক্যাম্পাসে, ওর ও যাওয়ার কথা ছিলো আমার সাথে, যেতে পারছে না বলেই টিকিট কাটার ঝামেলাটা ওই করেছে। ক্যাম্পাসেই আড্ডা মারলাম সাড়ে নয় পর্যন্ত। তারপর আমিনকে নিয়েই কলাবাগানের জন্য রওনা, আমার সাথে না যেতে পারার কারনে খানিকটা অপরাধ বোধ থেকেই বোধহয় আমাকে এগিয়ে দিতে চাইলো। যেহেতু খাওয়া হয়নি, কলাবাগান বাস স্ট্যান্ডের কাছে এক হোটেলে বসে পড়লাম, চাইলাম পরাটা-গরুর মাংশ।

বাসস্ট্যান্ডের হোটেলের মানুষগুলোর একটু তাড়াতাড়ি কাজ করার অভ্যাস থাকার কথা, কেননা খদ্দের সবাই এখানে ব্যস্ত। কিন্তু এ হোটেল দেখলাম একদম উল্টা। যাইহোক, পেটের শান্তির পর এবার নতুন টেনশন 'পাশের সহযাত্রী না জানি কেমন'! কল্যানপুরে বাস বদলের পর আসল বাসটায় উঠতে পারলাম, যেটা আমাকে সাতক্ষীরা নিয়ে যাবে। তবে তার আগে কল্যানপুর বাসস্ট্যান্ডের পাশে একটা দারুন জিনিস দেখলাম, সেটা হলো বাসের চাকা থেকে টায়ার খোলা। জিনিসটা নিয়ে আমার খানিকটা কৌতুহল ছিলো, তা মিটলো।

শুরুটা তো অনেক লম্বা হয়ে যাচ্ছে, মূল কাহিনীতে যাই। ও আচ্ছা, সহযাত্রী কোন জামাত-শিবির বা হুজুর বা মুরব্বি কেউ ছিলো না। কোন ঝামেলার মনে হয় নাই। কানে হেডফোন লাগিয়ে ঘুম দিয়েছি। একঘুমে রাত পার, আর আমি সাতক্ষীরা।

দশমীর ইছামতি: বাংলাদেশ-ভারত মিলন মেলা: নদীর নাম ইছামতি। বয়ে গেছে বাংলাদেশ আর ভারতের সীমানায়। নদীও আধা আধি ভাগ। শুধু এই দশমীর দিন দেবী বিসর্জন দিতে এখানে দু দেশের মানুষ মিলিত হয় সীমানা ছেড়ে। এপারে টাউন শ্রীপুর, ওপারে টাকি।

সকালে খানিকটা ঘুম দিয়ে তাড়াতাড়ি রওনা দিলাম দেবহাটা যাওয়ার জন্য। ওখান থেকেই ট্রলার নিয়ে নদী ধরে এগুলাম টাউন শ্রীপুরের দিকে। যেতে যেতে দেখছিলাম ওপার থেকেও নৌকা-ট্রলার এগুচ্ছে একই পথে। আর এপারে নদীর পার ঘেষে পায়ে হাটা পথ দিয়ে অসংখ্য মানুষ যাচ্ছে একই উদ্দেশ্য, যারা নদীর পারে থেকেই দেখতে চায় এই মিলন মেলা। ট্রলারে প্রায় আধা ঘন্টা যাওয়ার পর অবশেষে পৌছালাম সে মেলায়, যেখানে অসংখ্য নৌকা সেজে আছে, কোনটায় বাংলাদেশের পতাকা, কোনটায় ভারতের।

এসেছে নানা সংগঠন, মন্দির কমিটি তাদের দেবী বিসর্জনে, কোনটা আবার নানা রংয়ের মানুষ নানা ধরনের ভাড়া নৌকায়। আবার কোনটায় পরিবার, যাদের উদ্দেশ্য মূলত বেড়ানো, চেয়ার, মাদুর, বালিশ বিছিয়ে একেবারে নৌ ভ্রমণ। কোনটায় বন্ধুরা আড্ডায়। আমরা এপার ওপার করলাম বেশ কয়েকবার, যায়গাটা নিয়ে ঘুরলাম কয়েক পাক। যখন দু দেশের নৌকা পাশাপাশি, তখন চলছে নানা রকম শুভেচ্ছা বিনিময়, ইশারায়, হাত নেড়ে।

কেউ কেউ এগিয়ে দিচ্ছে নাড়ু, কোন ফল, সিগারেট। ওরা খুব খুশি হল আমাদের বেনসন পেয়ে, যতগুলো ছিলো ওদের দিলাম, আগে মনে থাকলে আরও বেশি করে নিয়ে আসতাম। বিডিআর - বিএসএফ টহল দিচ্ছিলো এর মধ্যেই, যেন এক দেশের নৌকা অন্য দেশে ভিরাতে না পারে। দু-পারের অসংখ্য মানুষ দাড়িয়ে ছিলো গ্যালারীর মত, আমরা ভারতের পারের মানুষদের সাথে হাতে হাত মিলিয়েছি, কিন্তু নৌকা থামাইনি পারে। যদিও শুনেছি, এ মেলা চলবে রাত পর্যন্ত।

অন্ধকার নামলে চলবে পারাপার। একটু অন্ধকার হলেই ওপারে শুরু হলো আতশ বাজির খেলা। প্রথমে খানিকটা ছবিতে ধরে রাখার চেষ্টা করে বুঝলাম এ চেষ্টা বৃথা। তাই আর চেষ্টা না করে দেখতে থাকলাম শুধু। এবং অবশেষে আমাদের ফেরার সময় হলো।

দুপুর থেকে ধীরে ধীরে জমা মানুষরা সন্ধ্যায় যখন ফিরছে তখন তা এক মিছিলে পরিনত হয়ে গেছে, এবং আমি নিশ্চিত এর মধ্যে কিছু হলেও ভারতের মানুষ আছে। আমরাও সে মিছিলে মিশে ফিরে এলাম। নলতা মাজার: দেবহাটা থেকে আরও খানিকটা সামনে সখিপুর পেড়িয়ে নলতা। সেখানে মাজার আছে একটা, যাকে ঘিরে আমার ছেলেবেলার কিছু স্মৃতি আছে। এ মাজারটা জনাব আহসানুল্লার।

যতদুর জানি, তিনি তথাকথিত পীর ছিলেন না, আধুনিক শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। আহসানিয়া মিশন বা এর সাথে যুক্ত সব সংগঠনই তার নামে। তিনি তার উত্তরসূরি রেখে গেছেন তার এক খাদেম কে। তিনিও একজন অসাধারণ মানুষ। তিনিই এ মাজারের পরিচালক, একই সাথে দেখাশুনা করেন পাশের মাদ্রাসা, এতিম খানার।

কিন্তু থাকেন খুব সাধারণ। তার থাকার রুমটা দেখতে গিয়ে অবাক হলাম। খুবই সাধারণ ঘর, প্লাস্টার ছাড়া দেয়াল, উপরে টিন, মেঝেতে একটা বিছানায় দুটা বালিশ, একটা মিটসেফ, একটা আলমারি, আসবাব বলতে এতটুকুই। পরেন সাদা একটা কাপড়, খালি পা। পাশেই অতিথিদের জন্য তিনটা অতিথিশালায় খুব ভালো থাকার ব্যবস্থা রাখলেও তিনি সাদামাটা থাকতেই পছন্দ করেন।

বৃহস্পতি আর শুক্রবার গরিবদের খাওয়ান, নিজেই রান্না ও খাওয়ার তদারকি করেন, নিজে যদিও সারা বছরই রোজা রাখেন (কয়েকটা দিন ছাড়া)। নলতা বেড়ালাম, ওখানে খেলাম, দু-একটা ছবি তুললাম। তারপর আবার রওনা দিলাম বুড়িগোয়ালিনীর দিকে। ওদিকে সুন্দরবন। জোছনা মাখা সুন্দরবন: সুন্দরবন যাবার সিদ্ধান্ত নিতে নিতে দেরি হয়ে গেল আমাদের।

নলতা থেকে রওনা দিতে তিনটা। শ্যামপুর থানা থেকে এসি (ল্যান্ড) সাহেবকে জানালাম আমাদের সুন্দরবন যাবার ইচ্ছের কথা। উনি নিজেও রাজি হয়ে গেলেন আমাদের সাথে যেতে। নীলডুমুর রেঞ্জে পৌছাতে আমাদের বিকেল হয়ে গেল, ট্রলার ভাড়া করে রওনা হতে সন্ধ্যে প্রায়। মাঝে আরেকটা সাব -রেঞ্জ অফিস থেকে গার্ড নিতে হলো।

শেষ পর্যন্ত যখন সুন্দরবন খালে ঢুকলাম তখন সূর্য ডুবে গেছে, আকাশে অর্ধেক চাঁদ। আধো অন্ধকার আর অর্ধেক চাঁদের আলোয় আমরা যতটা সম্ভব ভিতরে ঢুকতে থাকলাম। কিন্তু ফেরার তাড়া ছিলো, ফিরতে হবে সাতক্ষীরা আবার প্রায় ৭০-৮০ কিঃমিঃ পেড়িয়ে মটর সাইকেলে। খালের এক বাঁকে শেষে ট্রলার থামিয়ে বসে থাকলাম খানিকটা, শান্ত পানি, সুন্দরবনের নির্জনতা, ঘরে ফেরা কিছু পাখির ডাক আর জোছনা মাখা বন খানিকক্ষণের জন্য হলেও অন্য এক জগতের স্বপ্ন দেখালো আমাদের। বিশ্রামের দিন: সাথে বোনাস আড্ডা: গত দু'দিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত ছিলাম খুব।

একটা দিন তাই বিশ্রামে কাটালাম। সারাদিন টিভিতে বাংলাদেশের ক্রিকেটের হেরে যাওয়া দেখলাম, দুপুরে দাওয়াত খেলাম এক বাসায়, বিকেলে আড্ডা দিতে গেলাম এক বন্ধুর সাথে। আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। এখন এখানে ব্যবসা করে। শ্যামনগর এক বন্ধু চাকরি করে।

সেও এলো। রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে ফিরলাম সেদিন। এবং মায়া: সাতক্ষীরা এবার ছিলাম ডরমেটরিতে। প্রতিদিন সকালে ছাদে উঠে সিগারেট খেতাম। এ ডরমেটরীর বাসিন্দা খুব কম, গড়ে ৪/৫ জন থাকে।

প্রথমদিনই ছাদে উঠে বুঝেছিলাম এখানে তেমন কেউ আসে না। অনেকদিনপর আমাকে দেখতে পেয়ে ছাদে বেড়ে ওঠা আগাছাগুলো যেন খুশি হয়েছিলো। আমার সকালে ফিরতি বাস। প্রতিদিনের মত ছাদে উঠলাম, সিগারেট খেলাম, নেমে আসার সময় হঠাৎ খুব মায়া হল এ জায়গাটার জন্য, আগাছাগুলোর জন্য, এ নির্জনতার জন্য। আবার আমাকে ফিরতে হবে ধুলো-বালি মাখা শহরের জঞ্জালে।

মায়াটা তবু থেকেই যায়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।