আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার: সংগ্রাম ও বিপ্লবের নাম প্রীতিলতা। একটি নাম। বিপ্লব ও সংগ্রামের। যে নামটি শুনলে চেতনা মুহূর্তের মধ্যে অসাড় হয়ে যায়।

কিন্তু কিয়ৎক্ষণ পরেই চেতনা তার তন্দ্রা ভেঙ্গে বিদ্রোহ করে বলে, মানুষের জন্য দেশের জন্য কিছু একটা করা দরকার বা করতে হবে। এ এক অদ্ভুদ অনুভূতি। অবশ্য উপলব্দি করার মত চেতনা থাকতে হবে। যে মানুষের চেতনায় দেশপ্রেম নেই, মানবতা-মনুষ্যত্ববোধ নেই, সে প্রীতিলতা কেন; কোনো সংগ্রামী ও বিপ্লবীকে বুঝতে পারবে না। চুট্টগ্রামের সূর্য সেন ও প্রীতিলতা ছিল ব্রিটিশরাজের আতঙ্ক।

অগ্নিযুগের বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা থেকেই অনেক নারী পরোক্ষভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। অনুশীলন, যুগান্তর প্রভৃতি বিপ্লবী দলের সঙ্গে ঘরে ঘরে মা, বোন, মাসিমা, কাকিমা, দিদি, বৌদিরা যুক্ত ছিলেন। যেমন ছিলেন অগ্নিযুগের প্রথম পর্বে স্বর্ণ কুমারী দেবী, সরলা দেবী, আশালতা সেন, সরজিনী নাইডু, ননী বালা, দুকড়ি বালা, পরবর্তীকালে ইন্দুমতি দেবী, (অনন্ত সিংহের দিদি) লীলা রায়, পটিয়া ধলঘাটের সাবিত্রী দেবী প্রমুখ দেশপ্রেমিক নারী। তারই ধারাবাহিকতায় সেই অগ্নিযুগের অগ্নিকন্যা, বীর কন্যা _প্রীতিলতার আবির্ভাব। প্রীতিলতার জন্ম ১৯১১ সালের ৫ মে।

চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে। বাবা জগবন্ধু ওয়াদ্দার। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল অফিসের প্রধান কেরানি। মাতা প্রতিভা ওয়াদ্দাদার। তিনি ছিলেন গৃহিণী।

প্রীতিলতার ডাক নাম ছিল রানী। পড়াশুনার হাতেখড়ি বাবা, মা’য়ের কাছে। তার স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। যে কারণে জগবন্ধু ওয়াদ্দার মেয়েকে (১ম ও ২য় শ্রণিতে ভর্তি না করে) সরসরি তৃতীয় শ্রেণিতে স্কুলে ভর্তি করে দেন। ডা. খাস্তগীর উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয় ওই সময়ে অন্যতম নারী শিক্ষালয়।

এই নামকরা স্কুলে প্রতিটি শ্রেণিতে তিনি প্রথম কিংবা দ্বিতীয় ছিলেন। ৮ম শ্রেণিতে প্রীতিলতা বৃত্তি পান। ওই স্কুল থেকে ১৯২৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা ইডেন কলেজে। এখান থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাস করার পর কলকাতা বেথুন কলেজ হতে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ পাস করেন।

কর্মজীবনের শুরুতে চট্টগ্রাম অপর্ণাচরণ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন। ১৯২৪ সাল। প্রীতিলতা তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। বড়দা মধুসূদনের কাছে প্রীতিলতা শুনলো এক দুর্ধর্ষ ডাকাতির কথা। রেল শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন দেয়ার জন্য বিপুল অংকের টাকা ব্রিটিশ কর্মচারীরা ঘোড়ার গাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছে।

ওই গাড়িতে দুজন পুলিশও ছিল। কিন্তু হঠাৎ দিনের বেলায় বড় রাস্তায় চারজন লোক পিস্তল হাতে সামনে দাড়িয়ে গাড়ি থামালো। তারা গাড়ি থেকে সবাইকে নামিয়ে দিয়ে টাকাসহ গাড়ি নিয়ে চম্পট। পরে জানা গেলো ওই লোকগুলো ডাকাত নয়, স্বদেশী আন্দোলনের কর্মী। তারা দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করে।

তারা তাই মৃত্যুকে পরোয়া করে না। এই ঘটনাটি প্রীতিলতাকে দারুণভাবে নাড়া আলোড়িত করে। ইতোমধ্যে প্রীতিলতা উমাতা স্কুলের শিক্ষক বিপ্লবী সূর্যসেনের কথা বহুবার শুনেছেন। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীকে ভারত উপমহাদেশ থেকে উৎখাত করার জন্য সশস্ত্র বিপ্লববাদীরা একেকটি অঞ্চলের দায়িত্ব নেন। সূর্য সেন চট্টগ্রামের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।

তাঁর নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী দল গঠন হয়। যার মধ্যে ছিলেন নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, ধীরেন চক্রবর্তী, উপেন চক্রবর্তী, নগেন সেন, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, বিনয় সেন, মধু দত্ত, রাজেন দে, লোকনাথ বল প্রমুখ। ওই সময় পর্যন্ত দলে কোনো মেয়ে সদস্য ছিল না। সচ্চরিত্র, স্বাস্থ্যবান, সাহসী যুবক ও স্কুল-কলেজের ছাত্রদেরই নেয়া হতো এই বিপ্লবী দলে। ১৯২৮ সালে প্রীতিলতা প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করার পর ভর্তি হলেন ঢাকায় ইডেন কলেজে।

থাকেন কলেজের ছাত্রীনিবাসে। তখন প্রীতিলতা বিপ্লবী লীলা নাগের সংগঠন ‘দীপালী সংঘ’-এ নাম লিখিয়েছেন। আইএ পরীক্ষা শেষ করে প্রীতিলতা চট্টগ্রামে চলে আসেন। ওই সময় মাষ্টারদা সূর্যসেন চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক। সূর্যসেনের সাথে প্রীতিলতার ভবিষৎ কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা হয়।

এ সময় প্রীতিলতার আইএ পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়। তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। মাসিক ২০ টাকা বৃত্তিও পাবেন তিনি। ঠিক হলো কলকাতার বেথুন কলেজে পড়াশুনা করবেন। ইংরেজী সাহিত্যে অনার্স ভর্তি হলেন প্রীতিলতা।

থাকেন ছাত্রীনিবাসে। এখানে মাষ্টারদার নির্দেশে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড শুরু করলেন প্রীতিলতা। গড়ে তুললেন এক বিপ্লবী চক্র। এই বিপ্লবী চক্রে অনেক মেয়ে সদস্য যোগ দিলেন। তাদের মূল কাজই হলো অর্থ সংগ্রহ।

অর্থ সংগ্রহ করে প্রীতিলতা চট্টগ্রামে পাঠাতে লাগলেন। কলকাতার এক গোপন কারখানায় তখন তৈরি হয় বোমার খোল। মাষ্টারদার নির্দেশ অনুযায়ী সে বোমার খোল সংগ্রহ করে প্রীতিলতা। ১৯২৯ সালে পূজার ছুটিতে প্রীতিলতা- কল্পনা দত্ত, সরোজিনি পাল, নলিনী পাল, কুমুদিনী রৰিতকে নিয়ে চট্টগ্রাম আসেন। বোমার খোলগুলো পৌঁছে দেন বিপ্লবীদের হাতে।

মাষ্টারদার নির্দেশ অনুযায়ী প্রীতিলতা এরপর থেকে প্রকাশ্য বিপ্লবী কাজেও যুক্ত হয়ে পড়েন। অনেক দায়িত্বপূর্ণ কাজের ভারও তাকে তখন নিতে হয়। কলকাতায় যে বিপ্লবী চক্র গঠন করা হয়েছে, তাদের সকল প্রকার প্রশিক্ষণও প্রীতিলতাকে দিতে হতো। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের লৌহকঠিন দুঃশাসনের পাঁজর গুড়িয়ে দিয়েছে চট্টগ্রামের স্বাধীনতাকামীরা। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মহানায়ক সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে দখল হলো।

কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চট্টগ্রামে ইংরেজ শাসন অচল হয়ে গেলো। টেলিগ্রাফ-টেলিফোন বিকল। সরকারি অস্ত্রাগার লুন্ঠন। রিজার্ভ পুলিশ ছত্রভঙ্গ। রেললাইন উপড়ে ফেলা হলো।

১৯৩০ সালের ১৯ মে এপ্রিল প্রকাশিত দৈনিক কাগজ ‘নায়ক’ কি ছাপিয়েছে? স্বদেশী বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম শহর দখল করে ফেলেছে। এ সময় প্রীতিলতা কলকাতায়। চট্টগ্রামে আসার জন্য ব্যাকুল। সশস্ত্র বিপ্লবে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু তখনো পর্যন্ত মাষ্টারদার অনুমতি মেলেনি।

বিএ পরীক্ষা শেষে মাষ্টারদার নির্দেশে স্থায়ীভাবে চট্টগ্রামে চলে আসেন। বিপ্লবী কাজে আরো বেশি সক্রিয় হওয়ার তাগিদে দিল সর্বাধিনায়ক মাষ্টারদা সূর্যসেন। প্রীতিলতার জন্মস্থান ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে মাষ্টারদাসহ সহযোদ্ধাদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক শুরু হয়। এই বৈঠক চলাকালীন সময়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের সাথে বিপ্লবীদের উক্ত বন্দুক যুদ্ধ শুরু হয়। ইংরেজ ক্যাপ্টেন ক্যামেরুন ও তার এক সঙ্গী মারা যায়।

বিপ্লবীদের মধ্যে অপূর্ব, নির্মল সেন মারা যান। অল্পের জন্য মাষ্টারদা ও প্রীতিলতা বেঁচে যান। সাবিত্রি দেবীর বাড়িটি পুলিশ পুড়িয়ে দেয়। এই ঘটনার পর ব্রিটিশ সরকার প্রীতিলতাকে সন্দেহ করা শুরু করে। মাষ্টারদার নির্দেশে তিনি আত্মগোপনে চলে যান।

অন্য একটি বিপ্লবী গ্রুপ ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে ব্যর্থ হয়। যার কারণে মাষ্টারদা প্রীতিলতাকে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে বলেন। এই জন্য কাট্টলি সমুদ্র সৈকতে বিপ্লবী দলকে মাষ্টারদা সামরিক প্রশিক্ষণ দেন। ১৯৩২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মাষ্টারদার প্রীতিলতাকে বললেন, পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের নেতৃত্ব তোমাকে নিতে হবে। প্রশিক্ষণ শেষে বীরকন্যা প্রীতিলতার নেতৃত্বে বিপ্লবীরা ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাত্রে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে সফল হন।

আক্রমণ শেষে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। এ অবস্থায় ধরা পড়ার আগে সঙ্গে রাখা সায়ানাইড বিষ খেয়ে আত্মাহত্যা করেন। কারণ ধরা পড়লে বিপ্লবীদের অনেক গোপন তথ্য ব্রিটিশ পুলিশের মারের মুখে ফাঁস যেতে পারে, তাই। দেশমাতৃকার জন্য নিজেকে আকুণ্ঠভাবে উৎসর্গ করলেন।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.