আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এর জন্মদিন আজ



আজ ৫ মে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের শহীদ বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ৯৮তম জন্মদিন। মাষ্টারদা সূর্যসেনের অন্যতম সঙ্গী ছিলেন তিনি। ১৯৩২ সালে পাহাড়তলী ক্লাব আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেন মাস্টারদা। এই বীরকন্যা ছিলেন ওই দলের নেতৃত্বে। হঠাৎ আক্রমণের সংকেত পেয়ে তিনি দলীয় সঙ্গীদের নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

========================================= প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার : একটি বিপ্লবের নাম আলী হাসান ----------------------------------------------------------------- প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। একটি বিপ্লব, একটি সংগ্রামের নাম। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে এক দ্রোহ। চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল অফিসের হেড কেরানি জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার ও প্রতিভা ওয়াদ্দেদারের ঘরে প্রীতিলতার জন্ম ১৯১১ সালের ৫ মে। প্রীতিলতার ডাক নাম রানী।

এই ‘রানী’ নামটি যে পরবর্তীতে তার নিজের ও সমগ্র ভারতবাসীর ওপর এমন প্রভাব বিস্তার করবে তা কি সে সময় কেউ জেনেছিল। তার স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। বাবা তাকে স্কুলে ভর্তি করেছেন, তাও আবার সরাসরি তৃতীয় শ্রেণীতে। ডা. খাস্তগীর উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয় তখনকার সময়ে থেকেই উন্নতমানের নারী শিক্ষালয়। চট্টগ্রামের সেই নামকরা স্কুলে রানী তখন ক্লাসে প্রথম কিংবা দ্বিতীয়।

১৯২৪ সালের কথা। প্রীতিলতা তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। বড়দা মধুসূদনের কাছে প্রীতিলতা শুনলো এক দুর্ধর্ষ ডাকাতির কথা। রেল শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন দেয়ার জন্য বিপুল অংকের টাকা ঘোড়ার গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। গাড়িতে দুজন পুলিশও ছিল।

কিন্তু হঠাৎ দিনের বেলায় বড় রাস্তায় চারজন লোক পিস্তল হাতে সামনে দাঁড়ালো। তারা সবাইকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে টাকাসহ গাড়ি নিয়ে চম্পট। পরে জানা গেলো ঐ লোকগুলো ডাকাত নয় স্বদেশী আন্দোলনের লোক। তারা কখনো মৃত্যুকে পরোয়া করে না বলে, কাউকে ভয়ও করে না। বিষয়টি প্রীতিলতাকে দারুণভাবে নাড়া দিলো।

ততোদিনে প্রীতিলতা উমাতা স্কুলের শিক্ষক বিপ্লবী সূর্যসেনের কথা জেনে গেছেন। এ সময় সূর্যসেনের নেতৃত্বে বিশাল বিপ্লবী দলও গঠন হয়ে গেছে। যার মধ্যে আছেন নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, ধীরেন চক্রবর্তী, উপেন চক্রবর্তী, নগেন সেন, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, বিনয় সেন, মধু দত্ত, রাজেন দে, লোকনাথ বল প্রমুখ। তখনো পর্যন্ত দলে কোনো মেয়ে সদস্য ছিল না। সচ্চরিত্র, স্বাস্থ্যবান, সাহসী যুবক ও স্কুল-কলেজের ছাত্রদেরই নেয়া হতো দলে।

১৯২৮ সালে প্রীতিলতা প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করার পর ভর্তি হলেন ঢাকায় ইডেন কলেজে। থাকেন কলেজের ছাত্রীনিবাসে। কিছুদিন পর পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসলে প্রীতিলতা তা কঠোরভাবে ফিরিয়ে দিলেন। কারণ পড়ালেখা শেষ না করে বিয়ে নয়। ইতিমধ্যে প্রখ্যাত লীলা নাগের সংগঠন ‘দীপালী সংঘ’-এ নাম লিখিয়েছেন প্রীতিলতা।

এর মধ্যে আইএ পরীক্ষা শেষ করে প্রীতিলতা চট্টগ্রামে এলেন। চট্টগ্রামের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে তখন নতুন রূপ। মাষ্টারদা সূর্যসেন চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক। প্রীতিলতা এ সময়ের মধ্যেই বুঝে ফেলেছেন যে, সশস্ত্র অভ্যুত্থান ছাড়া স্বদেশের স্বাধীনতা সুদূর পরাহত। এরই মধ্যে প্রীতিলতার আইএ পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে।

মেয়েদের মধ্যে সেই প্রথম স্থান অধিকার করেছে। মাসিক ২০ টাকা বৃত্তি পাবে সে তখন থেকে। এরপর কলকাতার বেথুন কলেজে দর্শন শাস্ত্রে অনার্স ক্লাসে ভর্তি হলেন প্রীতিলতা। থাকেন ছাত্রীনিবাসে। এখানে মাষ্টারদার নির্দেশে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড শুরু করলেন প্রীতিলতা।

গড়ে তুললেন এক বিপ্লবী চক্র। এই বিপ্লবী চক্রে অনেক মেয়ে সদস্য যোগ দিলেন। তাদের মূল কাজই হলো অর্থ সংগ্রহ। অর্থ সংগ্রহ করে প্রীতিলতা চট্টগ্রামে পাঠাতে লাগলেন। কলকাতার এক গোপন কারখানায় তখন তৈরি হয় বোমার খোল।

মাষ্টারদার নির্দেশ অনুযায়ী সে বোমার খোল সংগ্রহ করে প্রীতিলতা। ১৯২৯ সালে পূজার ছুটিতে প্রীতিলতাÑ কল্পনা দত্ত, সরোজিনি পাল, নলিনী পাল, কুমুদিনী রক্ষিতকে নিয়ে চট্টগ্রাম আসেন। বোমার খোলগুলো পৌঁছে দেন বিপ্লবীদের হাতে। মাষ্টারদার নির্দেশ অনুযায়ী প্রীতিলতা এরপর থেকে প্রকাশ্য বিপ্লবী কাজেও যুক্ত হয়ে পড়েন। অনেক দায়িত্বপূর্ণ কাজের ভারও তাকে তখন নিতে হয়।

কলকাতায় যে বিপ্লবী চক্র গঠন করা হয়েছে, তাদের সকল প্রকার প্রশিক্ষণও প্রীতিলতাকে দিতে হয়। এর মধ্যে পত্রিকায় খবর বেড়োয় যে, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করে নিয়েছে বিপ্লবীরা। বিপ্লবীরা মরণ কামড় দিয়েছে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের লৌহকঠিন প্রশাসনে। দুঃশাসনের পাঁজর গুড়িয়ে দিয়েছে চট্টগ্রামের স্বাধীনতাকামীরা। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল ঘটলো ভয়াবহ এক ঘটনা।

মহানায়ক সূর্যসেনের নেতৃত্বে ঘটলো চট্টগ্রামে বিশাল এক অভিযান। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চট্টগ্রামে ইংরেজ শাসন অচল হয়ে গেলো। টেলিগ্রাফ-টেলিফোন বিকল, সরকারি অস্ত্রাগার দখল, রিজার্ভ পুলিশ ছত্রভঙ্গ, রেললাইন উৎপাটিত, ইংরেজ শাসকের আকাশছোঁয়া দর্পচূর্ণ। এ সময় কলকাতায় অবস্থিত প্রীতিলতা চট্টগ্রামে আসার জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকেন। সশস্ত্র বিপ্লবে অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে আছেন।

কিন্তু তখনো পর্যন্ত মাষ্টারদার অনুমতি মেলেনি। অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার তখনো অনেক দেরি, তাই টেস্ট পরীক্ষা শেষ করেই তিনি চট্টগ্রাম চলে এলেন। চট্টগ্রামে তখন বিপ্লবীদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ ও মিলিটারির তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনি অবস্থায় প্রীতিলতা চট্টগ্রামে কিছুদিন অবস্থান করে আবার কলকাতায় ফিরে গেলেন। কিছু পড়াশুনা করে পরীক্ষা শেষ করলেন প্রীতিলতা।

এরপর আবার চট্টগ্রামে ফিরে এলেন। এই সময়ে চট্টগ্রামে অপর্ণাচরণ নামে একটি ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা পদে নিযুক্ত হলেন প্রীতিলতা। এ সময় প্রীতিলতা মাষ্টারদার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। অনেক কষ্টে শেষ পর্যন্ত শহরের বাইরে এক গ্রামে সাবিত্রি দেবীর বাড়িতে রাতের বেলা প্রীতিলতা মাষ্টারদার সঙ্গে দেখা করলেন। তখন মাষ্টারদা সঙ্গে আছেন নির্মল সেন।

মাষ্টারদাকে অনেকদিন পর দেখে তাকে প্রণাম করতে উদ্যত হতেই মাষ্টারদা বললেনÑ পায়ে ছুঁয়ে প্রণাম নয়। বিপ্লবীরা প্রণাম করবে শুধু মা-মাতৃভূমিকেই। এমন সময় কে যেন হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠলোÑ পুলিশ। মুহূর্তে লাফিয়ে উঠলেন মাষ্টারদা ও নির্মল সেন। এরই মধ্যে রিভলবার হাতে এক সাহেব প্রায় সিঁড়ির গোড়া পর্যন্ত চলে এসেছে।

মাষ্টারদা ও নির্মল গুলি ছুড়তে ছুড়তে দ্রুত পালিয়ে যেতে থাকলেন। এক সময় কচুরিপানার এক পুকুরে গিয়ে পড়লেন দুজন। নির্মল সেন ততোক্ষণে গুলিতে মারা গেছেন। পুকুরের প্রায় পাড় ঘেঁষে পুলিশের দল যাচ্ছে। এ সময় দুজন কচুরিপানা মাথায় দিয়ে শুধু নাকটুকু ভাসিয়ে রেখেছেন।

একটু পরে পুলিশ চলে গেলে দেখা গেলো, যে বাড়িতে তারা সাক্ষাৎ করেছিলেন সেই সাবিত্রি দেবীর বাড়িটি দাউ দাউ করে জ্বলছে। ১৯৩২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মাষ্টারদার সঙ্গে প্রীতিলতার আবার দেখা করার সুযোগ এলো। মাষ্টারদা প্রীতিলতার উদ্দেশে দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করলেনÑ ‘আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর তোমার নেতৃত্বে তুমি পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করবে। ’ এ সময় মাষ্টারদা প্রীতিলতাকে চট্টলার রানী হিসেবে উল্লেখ করলেন। প্রীতিলতা আগেই অস্ত্র শিক্ষা নিয়েছিলেন।

মাষ্টারদার এই অমোঘ নির্দেশ পাওয়ার পর সাগরের বেলাভূমিতে আরো কঠোরভাবে অস্ত্র চালনার শিক্ষা নিতে লাগলেন প্রীতিলতা। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মাষ্টারদা প্রীতিলতার সহযোদ্ধাদের নাম ঘোষণা করলেন। তারা হলেনÑ শান্তি চক্রবর্তী, কালী দে, প্রফুল্ল দাস, সুশীল দে ও মহেন্দ্র চৌধুরী। সকলেই তখন প্রীতিলতার নেতৃত্বে মরণযুদ্ধের সংকল্পে দৃঢ়।

সকলের মধ্যেই যুদ্ধের উন্মাদনা প্রবল। হঠাৎ আক্রমণ করার সংকেত পাওয়া গেলো। লাফ দিয়ে প্রীতিলতা সহযোগীদের নিয়ে পৌঁছে গেলেন শত্র“র সম্মুখে। শত্র“রা তখন নাচ আর গানে মশুগুল ছিল। উন্মত্ত বল নাচের পরিবেশকে থমকে দিয়ে চললো গুলি আর বোমা নিক্ষেপ।

প্রায় সকলকে খতম করে দিয়ে ক্লাব থেকে বেরিয়ে রেলের বড় পথ ধরে হাঁটছেন বিপ্লবীরা। জয়ের আনন্দ সবার চোখেমুখে। হঠাৎ একটা গুলির শব্দ। সবাই মিলে দৌড়াতে লাগালো। গুলিটি লেগেছে প্রীতিলতার বুকের ডান দিকে।

বুকে হাত চেপে তবু দৌড়াতে লাগলেন। কে কোথায় দৌড়াতে দৌড়াতে চলে গেলো অন্ধকারে তার কিছুই দেখা গেলো না। প্রীতিলতা এক সময় রাস্তায় পড়ে গেলেন। প্রবল রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে বুকে, যন্ত্রণার ঝড় বইছে সমস্ত শরীরে। হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।

তারপর জ্ঞান ফিরে এলে বুঝতে পারলেন তার চারপাশে অনেকগুলো টর্চ লাইটের আলো। বুঝতে বাকি রইলো না চারপাশে পুলিশের লোকেরা তাকে ঘিরে ফেলেছে। কিন্তু তার তো পুলিশের হাতে বন্দী হলে চলবে না, ফাঁসির দড়িতে ঝুলে তাকে তো মরলে হবে না। চিরমুক্তির পাথেয় যে তার কাছেই গচ্ছিত রয়েছে। প্রীতিলতা আস্তে আস্তে তার কাছে গচ্ছিত পটাশিয়াম সায়ানাইড বের করে জননী ও জন্মভূমির নামে তা মুখে পুরে দিলেন।

এরপর ঘুমিয়ে গেলেন অনন্ত মাটির কোলে। পুলিশ প্রীতিলতার দেহকে ঘিরে হরেক রকমের তদন্ত শেষে শেষ পর্যন্ত তার মরদেহ তার পিতার কাছে সমর্পণ করলো। সেদিন প্রীতিলতার সৎকার হয়েছিল খুবই সাদামাটাভাবে। ইচ্ছে থাকলেও ভয়ে কেউ তার উদ্দেশে শ্রদ্ধা পর্যন্ত জানাতে আসেনি। কিন্তু আজ ভারতবর্ষের স্বাধীকার আন্দোলনের নিবেদিত প্রাণ বিপ্লবী অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা শুধু চট্টলার রানী নয় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মহীয়সী নারীরূপে সমস্ত ভারতবর্ষেরই রানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন।

আলী হাসান : সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী। ----------------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ / ৫ মে ২০০৯ প্রকাশিত

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.