আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চিরচেনা

ভালবাসা দিবস উপলক্ষে একটি ভালবাসার গল্প সম্ভাবত অপর্ণা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর অদ্ভুত এক পরিবর্তন এলো তার ছোট বোন তন্দ্রার ভেতর। হঠাৎ করে সে হয়ে উঠলো সুন্দর। আসলে তার চেহারায় কখনও কোন আকর্ষণ ছিল না। লাবণ্যহীন কালো কুৎসিত একটা মেয়ে। কিন্তু পরিবর্তনটাও খুব বেশি নজরে পড়েছিল অনেকের।

আমার কাছে ব্যপারটার খুব বেশি গুরুত্ব ছিলনা। সাধারণত কৈশোর ছেড়ে যৌবনে পা রাখার সময় প্রকৃতির নিয়মে মেয়েদের দেহ মনে স্বাভাবিক যে পরিবর্তন হয়, তেমনই মনে হয়েছিল ব্যপারটা । তাছাড়া নারীর সৌন্দর্য্যর রহস্য খুজে বের করা কোন পুরুষের কাজ হতে পারে বলে মনে করি না। কিন্তু যখন দেখলাম অল্প বয়সি একটি মেয়ের অন্তরে বৈপ্লবিক পরিবর্তন, পঁচিশার্ধো বয়সি নারীর মত আচরণ যেন হুবহু আমার অপর্ণা, তখন ভাবনার ডালপালাগুলো বিস্তার লাভ করতে থাকলো। এ পর্যন্ত বলে থামলেন একটি প্রাইভেট ইউনিভ্যারসিটির সাবেক শিক্ষক স্বপ্নীল আহমেদ।

তারপর দু ঢোকে শেষ করলেন আধা মগ দোচানা। মানে পাহাড়ি বাংলা মদ। কয়েকবার শ্বাস নিলেন ধীরে ধীরে। আবারও মগটা উচু করে ধরলেন, গায়ে লেগে থাকা ফোটা ফোটা মদ সোজা গিয়ে পড়লো তার জিবের ওপর। আবার বলতে শুরু করলেন, অপর্ণা ও তন্দ্রার মধ্যে আচার-আচরণে এবং মানষিকতায় ছিল হাজারও ব্যবধান।

কোন দিক থেকে তাদের দু বোনের মিল ছিলনা। ওদের বয়সের পার্থক্য প্রায় সাত-আট বছর। পারিবারিক ভাবে অপর্ণার পরিবারের সাথে আমি ঘনিষ্ঠ ছিলাম। ও আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে। আমরা যখন খুশি বেড়াতে যেতে পারতাম।

নৌকা চড়তে ও খুব পছন্দ করতো। একবার আমরা কাউকে কিছু না বলে সোজা ঢাকা থেকে চলে গিয়েছিলাম নড়াইল। আমি তখন লেকচারার হিসাবে সবে মেট্রোপলিটন কলেজে যোগদান করেছি। পারিবারিক ভাবে দুই পরিবারের মধ্যে বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি হয়ে আছে। সবেমাত্র অপর্ণার মাস্টার্স পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে।

হাতে তার সময়ও আছে খানিকটা। তাছাড়া অপর্ণা ও আমি কলেজ জীবন একই ক্লাসে না পড়লেও মেলামেশা করতাম বন্ধুর মত। সে আমার দুই ক্লাস নিচে পড়তো। দুপুরের বেশ আগেই আমরা নড়াইল পৌছাই। ছাত্রজীবনের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে আগে থেকে বলা ছিল।

তার বাড়ির সবাই জানতো আমাদের বিয়ে হয়েছে কিছুদিন আগে। অল্প সময়ের মধ্যে বন্ধুর মা ও বোনের সাথে দারুণ এক খাতির হয়ে গেলো ওর। সত্যিকথা কি জানেন, যেকোন অপরিচিত মানুষকে আপন করে নেয়ার অসম্ভব ক্ষমতা ছিল তার। যেকোন পরিস্থিতিতে নিজেকে চমৎকার ভাবে খাপখাইয়ে নিতে পারতো। নড়াইলে চিত্রা নদীতে বন্ধুর বোন, বন্ধু ও আমরা ঘুরে বেড়ালাম অনেকক্ষণ।

তখন মাঝি হিসেবে ছিল বন্ধুটি নিজেই। পরে আমরা দুজনা ঘুরলাম দীর্ঘক্ষণ। চারপাশে তখন বেশ অন্ধকার। চিত্রার বুকে বইছে ঝিরিঝিরি হাওয়া। বেশ একটা ঠান্ডা আমেজ।

বোঝা যাচ্ছে কিছুদিনের মধ্যে আসবে শীত। অপর্ণা আমার শরীরে গা এলিয়ে দিলো। পুরো নৌকাটা পানিতে স্থির দাড়িয়ে আছে। আমি আস্তে করে দাড়টা রাখলাম। তারপর খুব শক্ত করে দুহাত দিয়ে চেপে ধরলাম অপর্ণাকে।

চিৎকার করে ওই সময় বলেছিলাম, তুমি আমার শ্রেষ্ঠ অর্জন। আমার সারা জীবনের ভাল কাজের বিনিময়ে পাওয়া। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ভাল কাজের পুরস্কার স্বরূপ তোমাকে তুলে দিয়েছেন আমার হাতে। আমার এসব পাগলামি দেখে সে খুব শব্দ করে হেসেছিল। শব্দ করে হাসলে তার হাসিটা অন্যরকম লাগতো।

আমার কানে এখনও ভেসে আসে অপর্ণার সেই হাসি। যেন তার চোখ, মুখ ঠোট, তার সারা অঙ্গজুড়ে প্রবাহিত হচ্ছে হাসির ঢেউ। আমি সেই ঢেউ এর মধ্যে হারিয়ে যেতাম, তার বুকের মাঝে লুকিয়ে শান্তি খুজে পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতাম। উত্তেজনায় আমি থরথর করে কাঁপতে থাকতাম। কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানেন, আবিস্কারের নেশাই উম্মাদ হয়ে থাকা হবু স্বামীকে নানা ছলনায় সে ঠিকই শান্ত করে ফেলতো।

মনে পড়ে সেদিন আমার থেকেও অনেক বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল অপর্ণা। আলিঙ্গনরত অবস্থায় সে আমার কানের কাছে এসে ছোট্ট করে একটা কামড় দিয়ে বললো, আজ রাতে বন্ধুর বাসায় থেকে গেলে কেমন হয়। যেন আজ আমার জন্য তার ধর্মীয় সব বাধা, লাজ লজ্বা, সামাজিকতা উপেক্ষিত করতে প্রস্তুত। কিন্তু সেদিন তার কথায় আমি কোন সাই দিতে পারিনি। শুধু বলেছিলাম, খারাপ হয়না, কিন্তু এ বাড়ির মানুষগুলো কখনও যদি ব্যাপারটা বুঝতে পারে, তাহলে তোমাকে সারা জীবনই খারাপ একটি মেয়ে হিসাব মনে রাখবে।

আফটার অল আমাদের এখনও বিয়ে হয়নি। কথাটা শুনে অপর্ণা সাথে সাথে বললো, সজল ভাইয়ের মা ব্যাপারটা টের পেলে খুব কষ্ট পাবেন, তাই না? ছেলের বন্ধুর সম্পর্কে তার ধারণাটাও নিশ্চয় পাল্টিয়ে যাবে? আর তাই শেষপর্যন্ত অপর্ণা নিজেই তার প্রস্তাবনা প্রত্যাহার করে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রাতেই নড়াইল থেকে সোজা আমরা চলে যাই মাগুরা। সেখানেই আমাদের গ্রামের বাড়ি। অপর্ণা ও আমাদের বাড়ির মধ্যে ব্যবধান বলতে একটি মাত্র বাগান।

সেই বাগানেই আজ চির নিদ্রায় আছে অপর্ণা। সেখানে কবরের নাম ফলকে তার নাম লেখা আছে অপর্ণা হক এবং পিতার নাম ও জন্ম-মৃত্যুর তারিখ । কিন্তু আমি বলবো, সেখানে অপর্ণা নয়, তন্দ্রা শুয়ে আছে অপর্ণার শরীর নিয়ে। বেসরকারি কলেজের সাবেক শিক্ষক স্বপ্নীল আহমেদের গল্পটা সেদিন বেশিদূর এগোলো না। কথায় কথায় তিনি এত বেশি আবেগ প্রবণ হয়ে পড়েছিলেন যে, তার মুখ দিয়ে স্পষ্ঠ ভাবে কথা বের হচ্ছিল না।

আমিও তাকে গল্পে গল্পে ধরে রাখার কোন চেষ্টা করলাম না। পার্বত্য চট্রগ্রামের দূর্গম পাহাড়ী এলাকায় বসবাসরত উপজাতিদের আর্থ সামাজিক অবস্থা নিয়ে প্রতিবেদন করার উদ্দেশ্যে আমার ঢাকা থেকে এখানে আসা। পাহাড়ের গায়ে থাকা গ্রামগুলো ঘুরে ঘুরে আমাকে সংগ্রহ করতে হবে বসবাসরত মানুষের জীবনযাত্রার নানা দিক। তাদের হাসি আনন্দ। সেখানে যেসব এনজিও কাজ করছে তাও তুলে ধরতে হবে প্রতিবেদনে।

সবমিলিয়ে দারুণ একটা এস্যাইনমেন্ট আমার। আজ সকালে পাহাড়ী পল্লীতে ঘুরতে ঘুরতে লোকটার সাথে পরিচয়। তারপর এক কথায় দু কথায় পাহাড়ী মানুষের জীবন যাপন নিয়ে হলো আলাপ। এরই মধ্যে দুজনার ব্যক্তিগত কথাবার্তা হলো কিছুক্ষণ। একসময় পাহাড়ের টিলায় গিয়ে বসলাম দুজনা।

সামনে বেশখানিকটা বিস্তৃত জায়গা। পাহাড়ের ওপর খোলা মাঠের মত। টিলার ওপরে এমন সমতল জায়গা হতে পারে, তা না দেখলে কেউ ভাবতে পারবেন না। ইচ্ছা করলেই পাহাড়ের এই স্থানে সিক্সে সা্ইড ক্রিকেট ম্যাচ হতে পারে। এমন একটি স্থানে দুজনার কেটে গিয়েছিল অনেকটা সময়।

বহুদিন পর আমার কাছ থেকে ব্যানসন সেগারেট খেতে পেয়ে তিনি বেশ তৃপ্ত। প্যাকেটটা নিজের হাতে নিয়ে একটার পর একটা সেগারেট খেতে লাগলেন স্বপ্নীল সাহেব। তার ঘাড়ে ঝুলে থাকা ছোট্ট থলিটা মাটিতে রাখলেন। সেখান থেকে বের করলেন বোতল ও একটি মগ। বোতল থেকে পাহাড়ী বাংলা মদ ঢাললেন মগে।

তারপর মদ পানের একফাকে বললেন, আগে কখনও মদ পান করিনি। জিনিসটা এখানে এসে শেখা। এই টিলায় একটি মেয়ে থাকে। তার স্বামী চাঁদের গাড়ি চালাতো। একবার কয়েকজন যাত্রিসহ সে এ্যাকসিডেন্ট করে পাহাড়ের খাদে পড়ে যায়।

তারপর থেকেই জীবিকার সন্ধানে নামে মেয়েটি। পাহাড় ঘুরতে আসা মানুষগুলোর কাছে সে বিক্রি করে পাহাড়ী বাংলা মদ। তার নাম মমো। সে রোজ আমাকে মদ বানিয়ে দিয়ে যায়। তার জীবনটাও আমার মত কষ্টের, আমারই মত হারানোর বেদনায় জর্জারিত।

তারও কেউ নেই, আমারও নেই। একটু বেলা করে রুম থেকে বের হলাম আজ। গত রাতে প্রতিবেদনের কাজটা কোন ভাবেই শুরু করা যাইনি। ঘুরে ফিরে বারবার স্বপ্নীল আহমেদের কথা মনে হচ্ছিল। সকাল থেকেও ভাবনার কিছু অংশ জুড়ে রয়েছে লোকটি।

কিন্তু আজ এ অঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কিছু তথ্য জোগাড় না করলেই নয়। দুদিন হলো বান্দরবনের রুমায় রয়েছি। লেখার মত কোন তথ্য উপাত্ত জোগাড় হয়নি। যদিও বান্দরবন প্রতিনিধির মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে অনক তথ্য বের করা যাবে। তাছাড়া রুমায় আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে যেসব এনজিও কাজ করছে, তাদের কাছ থেকে মিলবে অনেক কিছু।

আসলে তাদের পিড়াপিড়িতে একপ্রকার এখানে আসা আমার। তাদেরই ব্যবস্থা করে রাখা পাহাড়ী কটেজে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সত্য হোক, মিথ্যে হোক তাদের ভূমিকাকে হাইলাইট করতে হবে আমার প্রতিবেদনে। এতে করে তাদের ভাগ্যে মিলতে পারে বেশি বেশি বিদেশি অনুদান। তবে এটি ঠিক, পাহাড়ী জনগোষ্ঠিকে শিক্ষিত করে তুলতে স্বপ্নীল সাহেব স্বার্থহীন ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

তিনি নিজেইতো এখানে একটা স্কুল চালান বলছিলেন। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি এখানে আছেন। পাহাড়ী প্রায় সব ছেলে-মেয়ে তার স্কুলে পড়ে। বরং এনজিও র করা স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী নেই। আমার অবশ্যই উচিত হবে, সঠিক জিনিসটা তুলে ধরা।

তাতে এনজিওর লোকরা অসুন্তষ্ঠ হলে কিছু করার নেই। কেননা এ অঞ্চলের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে ব্যক্তি উদ্দ্যোগে করা স্কুল বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এটি আমি রুমা বাজার এলাকায় এসে টের পেয়েছিলাম। একটি দোকানে চা পানের সময় একজন পাহাড়ী বয়স্কলোক স্বপ্নীল সাহেবের কথা বলছিলেন। ওই লোকটা নিজে্ই তার স্কুলে ভর্তি হয়ে বাংলা বর্ণমালা শিখেছেন।

স্বপ্নীলের স্কুলের একটি বিরল দৃষ্টান্ত হলো তার ছাত্রদের অনেকেই তাদের বাবা-মায়ের সাথে একই ক্লাসের লেখাপড়া করে। এতে করে ছোট ছেলে মেয়েরা বাপ-মা'র সাথে পড়াশুনা করতে পেরে আনন্দ অনুভব করছে। এটিও হতে পারে প্রতিবেদনের মূল আকর্ষণ। সুতরাং এ এলাকার শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে লিখতে হলে, অবশ্যই স্বপ্নীল আহমেদের ভুমিকার কথা গুরুত্ব দিয়ে লেখা উচিৎ। যে টিলার ছোট্ট কটেজে আমার থাকার ব্যবস্থা করেছেন এনজিও কতৃপক্ষ, তার পাশের টিলায় থাকেন স্বপ্নীল সাহেব।

হাটতে হাটতে তার বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। কাছাকাছি যেতে চোখে পড়লো একদল ছেলে-মেয়েকে নিয়ে তিনি বাসার দিকে ফিরছেন। বুঝলাম স্কুল ছুটি। কাছাকাছি আসার পর স্বপ্নীল সাহেবে বাচ্চাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ওনাকে সালাম দাও। উনি মস্ত বড় সাংবাদিক।

রাজধানী থেকে এসেছেন। তার কথা শেষ হবার আগেই সবাই মিলে একসাথে আমাকে সালাম দিলো। আমিও বললাম ওলাইকুম আসসালাম। আস্তে আস্তে টিলার পথ ধরে ওপরে উঠলাম দুজনা। ছোট্ট একটা ঘর।

সাথে বারান্দাও রয়েছে। কোন তালাটালা লাগানো নেই দরজায়। একটু জোরে ঠেলা দিয়ে দরজা খুললেন স্বপ্নীল আহমেদ। ভেতরে ঢুকে চারপাশ চোখ বুলালাম। বেশ অবাক লাগলো, চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে বই আর বই।

যেন ছোটখাটো একটা লাইব্রেরী। সেখানে রয়েছে আমেরিকার বিখ্যাত লেখক Robert Jordan এর লেখা THE WHEEL OF TIME বইটি। কোন অনুবাদ কপি নয়, ইংরেজি ভার্সনের মূল বইটি রয়েছে। যতদূর জানি বইটি সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় ৪০ মিলিয়নের বেশি কপি বিক্রি হয়। বইটি হাতে নিয়ে স্বপ্নীল সাহেবের কাছে জানতে চেলাম, আচ্ছা লেখক রবার্ট জর্ডানের নামটা নিশ্চয় আসল নয়।

সম্ভাবত ছদ্মনাম বা পেননামে তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, তার আসল নাম James Oliver Rigney. ২০০৭ সালে তিনি মারা গেছেন। তার বিখ্যাত বইগুলোর মধ্যে আছে ‌দ্যা আই অব দ্যা ওয়াল্ড, দ্যা ফায়ার অব হেভ্যেন, দ্যা হান্ট বিগিন্স, দ্যা গ্রেট হান্টস। আলাপচারিতার একপর্যায় তার কাছ থেকে আরও জানা গেলো তিনি রসায়নের ওপর পিএইচ ডি করেছেন। -কিন্তু আপনি রাজধানীর জীবন ছেড়ে এখানে ঠিকানা গড়লেন কেনো? সেখানে শিক্ষকতা করার কাজটা কি ভাল ছিলনা? ছিল, কিন্তু অপর্ণা মারা যাওয়ার পর আর ভাল লাগেনি।

-এটা কোন কথা হতে পারে না মি. স্বপ্নীল। আমি পারিনি। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সমস্যা হয়েছিল আমাদের, যেকারণে আমায় ছাড়তে হয়। -আমাদের বলতে। পাল্টা প্রশ্নে কিছুটা থতমত খেয়ে স্বপ্নীল বললো, আমাদের বলতে আমার ও তন্দ্রার।

-তন্দ্রা, তন্দ্রা বলতে আপনার প্রেমিকা অপর্ণার বোন ? জ্বি। - গতকাল তার কথাইতো বলছিলেন। অপর্ণার মৃত্যুর পর অদ্ভুত এক পরিবর্তন আসে তার ছোট বোন তন্দ্রার ভেতর। আচ্ছা, অপর্ণা মারা গেলেন কিভাবে? প্রশ্নটা শুনে আমার চোখের দিকে তাকালেন স্বপ্নীল। তাকে দেখে মনে হলো এ প্রশ্নর উত্তর দিতে তিনি আগ্রহী নন।

উত্তরটা দিতেও তার কষ্ট অনুভব হয়। স্বপ্নীল আহমেদ বললেন, অপর্ণার ছোট বোন তখন উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকায় এসেছে। মিরপুরে মামা বাড়ি থেকে সবেমাত্র সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিং শুরু করেছে। অপর্ণা থাকতো রোকেয়া হলে। তখনও বিয়ের পাচ-ছয় দিন বাকি।

কেনাকাটা তেমন কিছু করা হয়নি । যদিও গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু আমরা নিজেরা পছন্দ করে রেখেছিলাম। যাইহোক, দুই বোন সেদিন নিউমার্কেট থেকে কেনাকাটা শেষে যাচ্ছিল মিরপুর। তাদের বহনকারী যাত্রিবাহি বাসটা শ্যামলি পার হওয়ার পরপরই আকষ্মিক রাস্তার বায়ে অপর একটি বাসকে ধাক্কা মেরে উল্টে পড়ে। ওরা দুই বোন বাসের সামনের সিটে বসা ছিল।

আকষ্মিক ধাক্কায় সামনের গ্লাসটি ভেঙে যায়। তারা দুবোনই ছিটকে রাস্তায় পড়ে। দুজনায় ঘটনাস্থলে জ্ঞান হারায়। হাসাপাতালে নেয়ার প্রায় তিন ঘন্টা পর ফিরে আসে একজনের জ্ঞান। অপরজন মারা যায়।

সাংবাদিক সাহেব, বলতে পারেন সেই মানুষটি কে? স্বপ্নীল আহমেদ নিজেই যেন নিজের কাহিনীটাকে রহস্যময় করে তুললেন। আমার কাছেই তিনি উম্মাদের মত প্রশ্ন করলেন। মারা গেলো কে? -আপনি নিজেই বলছেন আপনার হবু স্ত্রী, প্রেমিকা অপর্ণা মারা গেছেন। স্বপ্নীল আবারও একটা রহস্যময় ভাব করে বলতে লাগলো, অপর্ণা মারা যাওয়ার মাস চারেক পর তন্দ্রা ভর্তি হলো আমার ইউনিভ্যারসিটিতে। আমি তাকে দেখে চমকে উঠলাম।

তার চেহারার আমুল পরিবর্তন। কালো কুৎসিত ধরণের সেই মেয়েটার গায়ের রঙ বেশ ফর্সা হয়ে উঠেছে। চেহারায় লাবণ্য ভাব। আসলে অপর্ণা মারা যাওয়ার পর আমি কিছু দিনের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলাম। বলতে গেলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল প্রায় সবার সাথে্।

দু একজন বন্ধু-বান্ধবের সাথে যোগাযোগ থাকলেও, অপর্ণার পরিবারের সাথে কোনই যোগাযোগ ছিলনা পাচঁ-ছয় মাস। আস্তে আস্তে আবারও আগের মত যোগাযোগ শুরু হয় অপর্ণাদের পরিবারের সাথে। তন্দ্রাও যেন অনেকটাই সহজ হয়ে পড়ে। তার চাহনী, তার কথা বলার ঢং, সবকিছু যেন অপর্ণার মত মনে হতে লাগলো। তার ভালবাসা, তার শরীরের গন্ধ- সবই যেন নতুন ভাবে ফিরে আসতে থাকে তন্দ্রার স্পর্শে।

-তারপর? মজার ব্যাপার কি জানেন সাংবাদিক সাহেব। মেয়েটি হঠাৎ একদিন আমাকে বললো, সে নড়াইল যেতে চায়। সেখানে গিয়ে সারা রাত চিত্রার বুকে সে ভাসতে চায় আমায় নিয়ে। আমি তার কথাবার্তায় তালগোল পাকিয়ে ফেলতাম। প্রথম প্রথম মনে হতো সে বোধ হয় অপর্ণার কাছ থেকে আমাদের নড়াইল ভ্রমণের নানা গল্প শুনে থাকতে পারে ।

কিন্তু তার আলিঙ্গনের ধরণ দেখে আমি চমকে উঠতাম। সেটিও হুব হু ছিল অপর্ণার মত। বিশ্বাস করুণ, তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আমি অপর্ণার অস্তিত্ব খুজে পেতাম। স্বপ্নীল সাহেবের সাথে সেদিনের পর আর কোন কথা হয়নি। ভর দুপুরে মদ পান করতে করতে তিনি ঝিমিয়ে যান।

কোন রকম শুয়ে পড়েন বিছানায়। এক সময় ঘুমিয়ে পড়েন বিনা নোটিশে। আমিও আর সময় দিতে পারিনি। অসমাপ্ত থেকে যায় তার গল্প। শোন হয়নি কেনো তিনি অপর্ণার ছোট বোন তন্দ্রার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন না ।

তবে তাদের মধ্যে অতিমাত্রায় ঘনিষ্ঠতার খবর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়েছিল বলে কথা প্রসঙ্গক্রমে তিনি একবার উল্লেখ করেছিলেন। এতে করে অন্যান্য শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। শেষে তাকে ও তন্দ্রাকে বেশ অসম্মানজনক ভাবে তাড়িয়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরের দিন ভোরে রওনা হয়ে আমাকে ফিরতে হয় বান্দরবন। সেখানে একদিন থেকে চিটাগং হয়ে ঢাকার পথে রওনা হই।

ট্রেনে যেত যেতে মনে হলো, এমন হতে পারে যে, একই সাথে দুর্ঘটনায় অচেতন হয়ে পড়া দু বোন হাসপাতালে পাশাপাশি বিছানায় মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিল। তখন হয়তো দু বোনের আত্মা অদল-বদল হয়ে যায় । তবে যাই ঘটুক না কেনো, অপর্ণার মৃত্যুর পর তন্দ্রার ভেতর তাকে খুজেঁ ফেরার চেষ্টা চালায় স্বপ্নীল। আসলে প্রকৃত ভালবাসার মৃত্যু নেই।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.