আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আউলা ২০৮ এর ডায়েরী

সৃষ্টিকর্তার সকল অপূর্ব সৃষ্টির মাঝে একমাত্র খুঁত সম্ভবত তাঁর সেরা সৃষ্টি ...

প্রভোস্ট স্যারের সামনে আমি আর সৌমিত্র বসতে না বসতেই স্যার একটু ইতস্তত করে বললেন, "তোমাদেরকে কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না - কিন্তু কথা হলো যে তোমাদেরকে ২০৮ নং রুমটা ছেড়ে দিতে হবে। " অনেক বাদানুবাদ শেষে আমরা যখন রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলাম তখন দুজনেই একটা ঘোরের মাঝে। আমি দেখলাম সৌমিত্রের মুখ অমাবশ্যার রাতের মতই হয়ে গেছে। সামনে কোন আয়না না থাকলেও হলপ করে বলতে পারি যে আমার নিজের চাঁদবদনেরও একই অবস্থাই হয়েছে। অনেক্ষণ করিডোরে দাঁড়িয়েছিলাম দুজনে কোন কথা না বলে।

জানি না ও কি ভাবছিল তবে আমার মন টাইম মেশিনে চড়ে দু বছর আগে দৌড় দিয়েছে ততক্ষণে। ক্লাস এইটে যখন চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে আসি তখন দারুণ কষ্ট পেয়েছিলাম ছোটবেলার বন্ধুদের ছেড়ে আসায়। আবার কুমিল্লায় যারা খুবই কাছের, বন্ধূ হয়ে উঠেছিল - যাদের সাথে কেটেছে আমার জীবনের সেরা সময়গুলি - তারা আবার পড়াশোনার ব্যাপারে ততটুকুই মনোযোগী ছিল, যতটুকু মনোযোগী মিলা তার গানের প্রতি। তাই যখন বুয়েটে চান্স পাই তখন লক্ষ্য করলাম আমার বন্ধুদের কাউকেই সাথে পাচ্ছি না। স্বভাবতই একটু মুষড়ে পড়েছিলাম।

কিন্তু আমার বন্ধুভাগ্য সবসময়ই ভালো কাজেই বুয়েটে কোন সমস্যা হবে না এই ভেবেই আল্লাহ-খোদার নাম জপতে জপতে আহসানউল্লাহ হলে এসে রেজিস্টার করালাম এখানকার আবাসিক হিসেবে। ওঠার সময়ই অনেকের কাছে শুনেছিলাম যে ০১ ব্যাচের বড়ভাইরা নাকি সহজে রুম ছাড়ছে না। কাজেই অনেকেই বরাদ্দকৃত রুমের আশা বাদ দিয়ে পরিচিত বড়ভাইয়ের রুমে, বা রেলস্টেশনের মতো দেখতে গণরুমগুলোতে আস্তানা গাড়ছে। আমার কোন চেনা বড়ভাইও বুয়েটে নেই, আর গণরুমে ওঠার মতো চেনা মুখও চোখে পড়ছে না তাই আমি পড়লাম অকুল পাথারে। হলের গেস্টরুমে বসে আছি সকাল থেকে, টেনশনে চেহারা হয়ে গেছে মৃগী রোগীর হাতে বানানো কাকতাড়ুয়ার মতো।

কি করব না করব কিছুই যখন ভেবে পাচ্ছি না তখন কানের কাছে কে যেন বোমা ফাটালো "আরে তুই এখানে!!" আর আমি মাথা তুলে বুয়েটে আমার প্রথম চেনা মুখটি দেখতে পেলাম। আমার চট্টগ্রামের ছোটবেলার সাথী এবং সহপাঠী অম্লানের চেহারা। ছোটবেলায় ওর উপর যা অত্যাচার করতাম সেগুলো মনে রাখে নি - এই আশায় হাসিমুখে উঠে যেতেই লাফ দিয়ে আমার গায়ের উপর উঠে পড়ল। খোশ গল্পের পর যখন জিজ্ঞেস করলাম ও কোন রুমে অ্যালট পেয়েছে, তখন উত্তর শুনে মনে হল ওকে জড়িয়ে ধরে নাচি! একি সৌভাগ্য! ছোটবেলার বন্ধুর সাথেই তাহলে এক রুমে উঠছি! দুজনে দোআ টোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে এগোলাম কাঙ্খিত রুমের দিকে। কয়েকদিন ধরে বুয়েটের র‌্যাগের যে ভয়াবহ কাহিনী শুনেছি তাতে পা কাঁপাই স্বাভাবিক।

অম্লান অলরেডি দুইবার ধরা খেয়ে গেছে, ওর কাহিনী শুনেতো আমার গলায় সাহারা মরুভূমির আবির্ভাব হল। কোনমতে ঢোঁক গিলে এগোলাম। ঐ রুমে তিনজনই ছিলেন '০১ ব্যাচের। তাঁরা আমাদের সাথে খুবই ভালো আচরণ করলেন। এমনকি "নবীনবরণ"ও করলেন না।

তারা বললেন যে তাদের রুশ ছাড়তে কিছুটা সময় লাগবে হয়তো, কিন্তু এখন বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকায় রুমের বাইরেই যেহেতু সময় কাটবে তাই স্বচ্ছন্দে আমরা উঠে যেতে পারি। তাঁদের কথাবার্তা শুনে মাথার বরফ গলল, এবং প্রথমবারের মতো রুমের দিকে আমাদের নজর পড়ল। একি অবস্থা ! মনে হচ্ছে রুমের মধ্যে দিয়ে কিছুক্ষণ আগেই সিডর বয়ে গেছে ! ঘরে কোন বিছানার বালাই নেই এককোণায় তিনচারটা তেলচিটচিটে তোষক ডাঁই করে রাখা। আর রুমের মেঝেতে এঁটো খাবারের প্লেট, মরা তেলাপোকা, না ধোয়া কাপড়চোপড় আর কাগজপত্র - সব মিলিয়ে আসল মেঝে দেখার কোন উপায়ই নেই (তখন কি আর জানতাম যে এক বছর বাদে আমরাও রুমের একই অবস্থাই করবো!!)। যাইহোক আমি আর অম্লান কোনমতে নিজেদের বেডিং পেতে ঐদিন ঘুম দিলাম।

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি চোর চোর মুখ করে নিরীহ ছাগল টাইপের একটা ছেলে দরজা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে। আমাকে উঠতে দেখে লম্বা করে একটা সালাম ঠুকল - এতো তাড়াতাড়ি কোন জুনিয়র রুমে না ওঠাটাই স্বাভাবিক কাজেই নিশ্চয়ই আমাকে বড় ভাই ভেবেছে। ওকে নিয়ে একটু মজা করব নাকি ভাবতে ভাবতেই অম্লান ঘুম থেকে উঠে ছেলেটিকে দেখে বলল "আরে সৌমিত্র তুই!!" ছেলেটিও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। জানা গেল তারা একই মেসে থেকে বুয়েট ভর্তি কোচিং করেছে, কাজেই একসাথে আগেও ছিল। আবার একসাথে হয়েছে।

পাঠকদের নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হবে না ইনিই আমাদের তৃতীয় রুমমেট। তিনজনের মাঝেই এক ধরনের যোগাযোগ আছে ভেবে বেশ মজা লাগল। পরদিনই ভাইয়ারা আমাদের তিনজনকে ডেকে এই রুমের ইতিহাস শোনালেন। আউলা ২০৮ এ নাকি সবসময়ই একই ব্যাচের তিনজন ছিল - এবং অনেকেই রুম এবং রুমমেট পাল্টায় কিন্তু এই রুমে আজ পর্যন্ত যারা উঠেছে তারা একেবারে বুয়েট লাইফ শেষ করা পর্যন্তই নাকি এই রুমেই সংসার করে গেছে। তাঁরা এটাও বললেন যে এই রুমটা এই হলের ব্র্যান্ড আড্ডা রুমগুলোর একটা।

তখন বুঝিনি কেন, পরে বুঝতে পারলাম যে আমাদের রুমের লোকেশনটাই এতটা দারুণ যে আড্ডা রুম না হওয়ার কোন চান্সই নাই। আহসাসউল্লাহ হলের মাত্র ছয়টি রুমে বারন্দা আছে তার মাঝে ২০৮ হল একটি। এই রুমের দু পা সামনে হলের নামাজ ঘর, এর সামনেই ওয়াশরুম তার একটু সামনেই আবার বাথরুম। ঠিক মাথার ওপর হলের কমনরুম, লাইব্রেরী এবং দোকান আর পায়ের নিচে হলের ডাইনিং। এবং পাশের সিঁড়ি দিয়ে নামলেই হলের ক্যান্টিন এবং পেছনের গেট।

কাজেই আপনি নামাজ পড়তে যান, খেতে যান, বা টিভি দেখতেই যান - আমাদের রুমের সামনে দিয়ে আপনাকে যেতেই হবে। আর যেহেতু এই রুমে তিনজন বাচাল বান্দা, দুইটা খবরের কাগজ, তিনটা নেটের কানেকশন সহ পিসি এবং সেই সাথে বিশাল মুভি, গান এবং অ্যাডাল্ট মুভির কালেকশন আছে তাই কেনো একবার সবাই রাউন্ড দিয়ে যাবে না? তাই এখন এমন অবস্থা যে যখনি কেউ আমাদের রুমে ঢুকে - সেটা দুপুর ১২টা হোক আর ভোর ৪টা হোক - সবসময়ই আমাদের রুমে ছয় সাতজন পোলাপানকে গল্পগুজবরত অবস্থাতে পাবেনই পাবেন। সকালে আমি মোটামুটি তাড়াতাড়ি উঠতে পারি বলে ফ্রেশ ফ্যেশ পেপার পড়ার সুযোগ পাই। অম্লান আর সৌমিত্র উঠে দেখে রুম সাত আটজন বিভিন্ন পোজে বসে আছে আর পেপার টুকরা টুকরা করে বিভিন্ন জনের হাতে শোভা পাচ্ছে। আমি ক্লাস শেষ করে এসে প্রায়ই দেখতাম আমার পিসিতে বসে জিসান ননেট হাবিজাবি করছে।

আর আমাদের ম্যাথ অলিম্পিয়াডের হিরো সোহান তো আমার পিসিতে বসলে আর ওঠার নামই নিতো না। নামাযের সময়গুলোতে রুমে দর্শন পাওয়া যায় ক্যাডেটগুলার - সাদাত, রাসেল, সাফায়েত - আবার দুপুরের দিকে দেখা দেয় লাঞ্চ করে ফেরত আসা জনগণ। প্রতিটা ইপিএলের ম্যাচ শেষে রুমে বসে আট দশজনের ম্যাচ বিশ্লেষণী কারবার। আবার পরীক্ষার সময় প্রতি বিছানায় চার পাঁচজন করে বইহাতে ভীষণ গবেষণায় মত্ত। হলে কোন গন্ডগোল হলেই সবাই আগে দৌড়ে আসে রুমে খবর নিতে - প্রথম দিনের বোকাসোকা সৌমিত্র নেতা হওয়ার সুবাদে সেসব দিন বেশ একটু ভাব নেওয়ার সুযোগ পায়।

বাঁধনের সক্রিয় কর্মী হওয়ার দরুণ অম্লানের কাছে চেনা অচেনা ভিজিটরদের লাইন লেগে থাকে। সব মিলিয়ে এক মহাযজ্ঞ। '০৬ ব্যাচের সবার কাছেই পরিচিত আউলা ২০৮ রুম। কত স্মৃতি এতো অল্প সময়ে, বন্ধুদের সাথে কত মজা করা, কত আনন্দ দুঃখ, শোক-সান্ত্বনার স্মৃতি আজ প্রভোস্ট স্যার মুছে দিতে চাইছেন। কিন্তু এতো সহজেই কি আমরা মেনে নেব ? কখনোই নয় - আমার আর সৌমিত্র দুজনের চেহারাই আজ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, ফোনে অম্লানকে জানানো হয়েছে - সেও কাজটাজ ফেলে কালই চলে আসছে।

এতো সাধের আউলা ২০৮ কি এখনি ছেড়ে দেব?? যেখানে আমরা এখনই পরিকল্পনা করে রেখেছি এই রুমে যখন তিনজন '১০ ব্যাচের নবীনেরা ভয়ে ভয়ে ঢুকবে তখন তাদের কিভাবে অভ্যর্থনা জানানো হবে? যেখানে আমি রুম ছাড়ার সময় সামুতে বিশাল একটা পোস্টের প্ল্যান করে রেখেছি? বিদায়ের দিন কান্না যেন না আসে সেইজন্যও কি করব তা ভেবে রেখেছি এখনি, সবই কি এতো সহজেই ভেসে যেতে দেব ? কখনোই নয়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।