আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বুয়েট ও বাংলাদেশের বিজ্ঞান গবেষকদের প্রতি

আওরঙ্গজেব

মাঝে মধ্যে বুয়েট সহ বাংলাদেশ ও বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞ গবেষকদের গবেষণা রিভিউর (review) সুযোগ আসে। কিন্তু বাংলাদেশের বেশিরভাগ লেখার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। বাংলাদেশী অন্য রিভিউয়ার সহকর্মীদের মতামতও একই। তাই এই লেখার মাধ্যমে যদি শ্রদ্ধেয় লেখকদের কিছু তথ্য দিয়ে সাহায্য করা যায়, আমার এই প্রচেষ্টা সফল বলে ধরে নেব। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে বুয়েটের শিক্ষকদের লেখা একটি গবেষণা রিপোর্ট পড়তে গিয়ে আমার দাঁত ভাঙ্গার উপক্রম।

লেখাটির লেখক হচ্ছেন বুয়েটের Institute of Information and Communication Technology (IICT) নামের প্রতিষ্ঠানের একজন প্রভাষক, Electrical and Electronic Engineering (EEE) বিভাগের একজন অধ্যাপক ও Civil Engineering (CE) বিভাগের একজন সহকারী অধ্যাপক। Abstract এবং introduction-র কয়েক লাইন পড়তে আমাকে বারবার পড়ে বুঝতে হয়েছে। পরিশেষে, বিরক্ত হয়ে পড়া বন্ধ করে রেখে দিয়েছি। এরকম অবস্হায় যে কোন রিভিউয়ার লেখাটি অগ্রহণযোগ্য (rejection) হিসেবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। অনেকের মতে, বুয়েট ও বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মান আন্তর্জাতিক মানের হলেও, মূল সমস্যা অন্য জায়গায়।

তরুণ গবেষকদের ইংরেজীতে দক্ষতার অভাবে গবেষণা রিপোর্টে presentation হয় খুব দূর্বল। ফলে পাঠকরা বুঝতে পারেন না, লেখাটিতে আসলে কি আছে। রিভিউয়াররা সব ভলান্টারিলি কাজ করেন। তাই যে কোন লেখা মান সম্পন্ন লেখা দূর্বোধ্য হলেও তাঁরা বুঝতে পারেন না, বুঝার জন্য বেশি চেষ্টাও করেন না ও সহজে reject করেন। এজন্য রিভিউয়ারদের কোন জবাবদিহিতাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নেই।

উল্লেখিত লেখাটির মূল লেখক IICT-র একজন প্রভাষক। তাই স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বাস, তাঁর ইংরেজীতে দক্ষতা কম (হয়ত: বাংলা মিডিয়ামে পড়ে আসার কারণে) ও গবেষণা রিপোর্ট লেখার অভিজ্ঞতা তেমন নেই। অথচ তিনিই হয়তো কষ্ট করে গবেষণার মূল কাজটি করেছেন ও লেখাটি লিখেছেন। তাই অভিজ্ঞতার অভাবে তাঁর গবেষণা ভাল মানের হলেও লেখার মান ও presentation খুব দূর্বল। আমার বিশ্বাস অন্য দুজন লেখক, যাঁরা বুয়েটের নামকরা অধ্যাপক (শ্রদ্ধার সাথে বলছি), তাঁরা হয়তো লেখাটি একবারও ভালভাবে পড়ে দেখেননি।

ভূল-ত্রুটি শোধরে দিয়ে মূল লেখককে পরামর্শ দেননি। কিন্তু বিদেশের বড় বড় ডিগ্রীর বদৌলতে তাঁদের এই কাজের যথেষ্ঠ অভিজ্ঞতাও আছে। হয়তো সময়ের অভাবে তাঁরা তা করেননি। এতে তাঁরা দুটি বড় ঝুঁকি নিয়েছেন। প্রথমত, যা সহজেই অনুমেয়, রিভিউয়াররা লেখাটি পড়তে গিয়ে দূর্বোধ্য হলে reject করবেন।

এতে একটি সম্ভাবনাময় তরুণ গবেষকের (মূল লেখক) আগ্রহে ভাটা পড়া অস্বাভাবিক নয়। দ্বিতীয়ত, তাঁদের নামের সাথে লেখাটিতে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বুয়েটের নাম লেখা আছে। এতে বিদেশের একজন পাঠক বুয়েট সম্পর্কে কি ধারণা করবেন - একথা হয়ত: তাঁরা চিন্তাও করেননি। অধিকন্তু, বুয়েট ও বাংলাদেশের অধ্যাপকদের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। অথচ আমরা জানি, বিদেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানসম্পন্ন ডক্টরেট করে ও ন্যুনতম গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করেই তাঁরা অধ্যাপক পদে নিয়োগ পেয়েছেন।

তাই একজন বাংলাদেশী হিসেবে তাঁদের যোগ্যতা সম্পর্কে কোন সন্দেহ না করলেও, তাঁদের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ করছি বৈকি (পাঠক, এতে তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা এতটুকুও কমে যায়নি)। কিন্তু একজন বিদেশী সাত-পাঁচ না ভেবে সরাসরি তাঁদের ও তাঁদের প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ করতে পারেন। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এমনকি বাংলাদেশী যেসব প্রফেসর ও গবেষক এখানে কাজ করেন তাঁরা অত্যন্ত আন্তরিক। তাঁদের গবেষণা রিপোর্টে আন্তর্জাতিক মান পুরো মাত্রায় বিরাজমান।

যে সব বাংলাদেশী ছাত্র তাঁদের অধীনের উচ্চ শিক্ষার জন্য আসেন, তাদেরকে তাঁরা অত্যন্ত দরদ দিয়ে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণার কলা কৌশল শিক্ষা দেন। একটি কনফারেন্স বা জার্নাল রিপোর্ট কিভাবে লিখতে হবে তাও আন্তরিক ভাবে শিখিয়ে দেন। এজন্য বিশেষভাবে উল্লেখ্য অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক (Gippsland School of Information Technology-র প্রধান) ড: মানজুর মোর্শেদ। তিনি ছাত্রদের তাঁর বাসায় ডেকে নিয়ে হাতে কলমে শিখিয়ে দেন কিভাবে একটি কনফারেন্স বা জার্নাল রিপোর্ট লিখতে হয়। তাঁর নিপুন হাতের পরিচর্যায় অল্প সময়ে ছাত্ররা ইংরেজী লেখা ও গবেষণার ফলাফল presentation-এ দক্ষ হয়ে উঠে।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয়, কম্পিউটারে রিপোর্ট লেখার বিভিন্ন software (যেমন, MS Word, Latex) এর প্রথম বা advance ব্যবহার অনেক ছাত্ররা তাঁর কাছেই প্রথম শিখে। ড: মানজুর মোর্শেদের Latex-এ লেখা পিএইচডি Thesis template মোনাশ সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশী-বিদেশী পিএইচডি ছাত্ররা ব্যবহার করেন। আরেকটি বিষয়, গবেষণায় ন্যুনতম সম্পৃক্ত না থেকে একটি গবেষণা রিপোর্টে নিজের নাম লেখক হিসেবে দিয়ে কৃতিত্ব নিতে আমরা অনেকে পছন্দ করি। কিন্তু যাঁরা এটা করেন, তাঁদের বায়োডাটায় গবেষণা রিপোর্টের সংখ্যা বাড়লেও তাঁরা কয়েকটি ঝুঁকি নিয়ে থাকেন। প্রথমত, এই চর্চাটি নৈতিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ।

একটি গবেষণা বা এর রিপোর্ট লেখায় লেখক হিসেবে একজন ব্যক্তির ন্যুনতম সম্পৃক্ততা বাধ্যতামূলক। যদি কেউ ন্যুনতম সম্পৃক্ততা ছাড়াই লেখক হন, তবে তা ঠিক নয়। দ্বিতীয়ত, উপরে উল্লেখিত ঘটনার মতোই লেখক তাঁর নিজের ও প্রতিষ্ঠানের দূর্নামের ঝুঁকি নিয়ে থাকেন। তৃতীয়ত, বায়োডাটায় গবেষণা রিপোর্টের সংখ্যাধিক্যের জন্য চাকরীতে প্রমোশন হলেও, কার্যত তাঁরা ছাত্র ও সহকর্মীদের কাছে হাস্যাস্পদ হয়ে যান। আমাদের দেশে এই ভূল চর্চাটি ব্যাপক।

বাইরে একেবারে নেই বললেই চলে। মেলবোর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বাংলাদেশী গবেষক তাঁর একটি লেখায় একই বিভাগের একজন অস্ট্রেলীয় অধ্যাপকের (যিনি বাংলাদেশী গবেষকটির একজন supervisor ও বটে) নাম লেখক হিসেবে দিতে অনুমতির জন্য গত এক মাস ধরে অপেক্ষা করছেন। অধ্যাপক সাহেব নিজের নাম ব্যবহারের অনুমতি দিতে চান, তবে এর আগে তিনি দেখতে চান লেখাটিতে কি আছে, লেখাটি তাঁর নিজের ও প্রতিষ্ঠানের নামের সাথে মানাবে কিনা। উল্লেখ্য, এর আগে তিনি বাংলাদেশী গবেষকটির আরেকটি লেখায় শুদ্ধ ইংরেজী লেখার ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। পরিশেষে বলব, আমাদের দেশের মেধা ও যোগ্য গবেষকদের অভাব নেই।

এর প্রমাণ, আন্তর্জাতিক কম্পিউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় বুয়েটের কম্পউটার প্রকৌশলের ছাত্ররা বরাবরই ঈর্ষনীয় সাফল্য ধরে রেখেছে। ভারত ও চীনসহ বিশ্বের অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়কে তাঁরা হারিয়েছেন। এছাড়া বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কৃতি গবেষক প্রথম শ্রেণীর আন্তার্জাতিক জার্নালে তাঁদের গবেষণা নিয়মিত প্রকাশ করে থাকেন। এক্ষেত্রে যাঁরা পিছিয়ে আছেন, এক-আধটু পরিচর্যার মাধ্যমেই তাঁরাও বিশ্বমানের গবেষকদের কাতারে শামিল হতে পারেন। বাংলাদেশের যে সকল শিক্ষকরা বাইরের ডিগ্রী নিয়ে এসেছেন, তাঁদের সকলেই কম-বেশি গবেষণার সকল কলাকৌশল জানেন।

তাঁদের একটু আন্তরিকতা, একটু সময়, সহকর্মীদের সাথে একটু সহযোগিতা তরুণ গবেষকদের অনেক উপরে নিয়ে যেতে পারে। পরিণামে শুধু বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বাংলাদেশও বিজ্ঞান চর্চায় বিশ্বে মর্যাদার আসনে সমাসীন হবে। লেখাটি প্রকাশিত: নয়াদিগন্ত, সোনার বাংলাদেশ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।