আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"অলৌকিক"

মানুষ মরেনা কখনো

কয়দিন আগে বাসায় ফেরার সময় মিরপুর-১ এর বাসস্ট্যান্ড যখন পার হচ্ছিলাম তখন একটা ঘটনা ঘটল। রিকশা ঠিক করার আগে ঠিক ওভারব্রিজের নিচে তরমুজওলা তরমুজ বিক্রি করছিল। তরমুজগুলোর মধ্যে একটা ছোট আকারের তরমুজ পছন্দ হলো। হাতে তুলে টোকা দিয়ে দেখলাম; পাকা মনে হল, ভিতরে লাল হবে এবং যেরকম মিষ্টি চাই সে রকমই হবে বলে ধরে নিলাম। তখন বাজে প্রায় সাড়ে তিনটার মতো, বাইরে খটখটা রোদ, চৈত্রের খরদুপুর যাকে বলে।

বাসে বসেই গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল। তো যখন তরমুজটা পছন্দ হলো তখন জিঞ্জেস করলাম তরমুজওলাকে, ‘দাম কত?’; তরমুজওলা বলল, ‘একশত টাকা’। আমি অবাক হয়ে গেলাম। তরমুজটার সাইজ ছিল এমন যে একহাতেই পুরোপুরি ধরা যায়। আর ঠিক এরকম সাইজের একটা তরমুজ আমি একসপ্তাহ আগেও নিয়েছি চল্লিশ টাকায়।

তাই আমি কিছু না বলে সাথে সাথেই তরমুজটি যথাস্থানে রেখে দিলাম। তখন তরমুজওলা তরিঘরি করে বলল, ‘কি হল স্যার নিবেন না?’ আমি বললাম, ‘এতদামি তরমুজ নেয়ার সামর্থ্য নাইরে ভাই!’ তখন ও বলল, ‘একটা দাম বলেন অন্তত!’ আমি একটু ভেবে বললাম, ‘চল্লিশ টাকা’ তরমুজওলাও একটু ভেবে বলল, ‘ঠিকআছে স্যার, নেন’। আমি তখন তরমুজওলার হাতে তরমুজটি দিয়ে মানিব্যাগ বের করলাম। যখন টাকা গুনছি, সে সময় তরমুজওলা একটু পরখ করল তরমুজটা। এতক্ষন সে তরমুজটা হাতে নিয়ে দেখেনি।

তার এখন কি মনে হলো সে আবার আমাকে বলল, ‘এ তরমুজ চল্লিশটাকায় দেয়া যাবে না’। বলে সে মুখ শক্ত করে আমার দিকে তাকাল। আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মনটা খুব খারাপ হলো। একবার নিতে বলে আবার মানা করল কেন? অনুযোগ করতে ইচ্ছে হলো।

কিছুই বললাম না। নিজেকে খুব ছোট মনে হলো। একটা চাপা অভিমান বুকের ভেতর ফুলে ফুলে উঠতে চাইলো। তবুও কিছু বললাম না। সোজা একটা রিকশা নিয়ে বাসার দিকে রওনা করলাম।

তার একদিন পর আবারও ঠিক ঐ জায়গা দিয়ে যখন একই সময়ে বাসায় ফিরছি, হঠাৎ দেখি সেই তরমুজওলা কোত্থেকে যেন এসে উপস্থিত। তার চুল উস্কখুস্ক, জামার বোতাম দুইটা খোলা, দেখে অনেকটা উদ্ভ্রান্তের মতো মনে হলো। সে দৌড়ে এসে আমার সামনে এসে হাত জোড় করে বলল, ‘স্যার আমারে মাফ করেন!’ আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম, ‘তোমার কি হয়েছে? আর আমার কাছেই বা মাফ চাচ্ছ কেন?’ সে ভেউ ভেউ করে কেদে বলল, ‘স্যার মনে আছে পরশুদিন আপনে একটা তরমুজ কিনতে চাইছিলেন?’ আমি বললাম, ‘হ্যা, মনে আছে!’ তরমুজওলা বলল, ‘আমি আপনেরে তরমুজ দিতে কইয়াও দেইনাই। আপনেরে বিদায় করনের পর থেইক্কা ঐদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত একটা তরমুজও আর বিক্রি হয় নাই। হের পরদিন সকাল থিক্কাও দুপুর বারটা পর্যন্ত বইস্যা ছিলাম, তাও একটা তরমুজও বেচতে পারি নাই।

আমার সামনে রাস্তার ঐপাশের দোকান থিকা কাস্টামার আইসা তরমুজ কিনা লয়া যায় কিন্তু আমার কোন বেচা-কিনা নাই। এমন সময় দুপুর বেলা পুলিশে আইস্যা আমাগো ওঠায় দিছে। থানার নতুন ওসি আইছে হ্যার লাইগ্যা’। এই বলে একটু থেমে ও নিশ্বাস নিল, তারপর আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্যার দয়া কইরা আপনার ইচ্ছা মতো একটা তরমুজ আপনি নিয়া যান! আমারে ক্ষমা করেন স্যার আমারে ক্ষমা করেন!’ এই বলে আবার সে শব্দ করে কান্না শুরু করল। এঘটনাটার বর্ণনা এখানেই শেষ করছি; তবে, পোস্টটির শেষ পর্যন্ত একটু পড়ুন।

এ ঘটনার প্রথম অংশটি মানে, রিকশায় করে বাড়ি রওনা দেয়া পর্যন্ত পুরোপুরি সত্য ঘটনা। কিন্তু এর পরের অংশটি পুরোপুরিই কাল্পনিক; অবাস্তব। ঘটনার নাম দিতে পারতাম ‘এমন যদি হতো’, কিন্তু তা না দিয়ে দিয়েছি ‘অলৌকিক’। কেননা, আমার মতে এরকম ‘অলৌকিক’ ক্ষমতার অধিকারী না হলে আমাদের মতো স্বল্প আয়ের মানুষের এ জিম্মি অবস্থা কোনদিন ঘুচবার নয়। আমাদের ছোট ছোট আকাঙ্খাগুলো অন্যকারো ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর হয়ে থাকবে চীরদিন; আর আমাদের শুধু থাকবে কাঠ-ফাটা রদ্দুরে শুষ্ক গলা আর আর্দ্র নেত্র।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।