আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মানবিকতা-



কান্না সংক্রামক, বীভৎসতা খুব সহজেই আমাদের স্বাভাবিক চৈতন্যকে স্তব্ধ করে দেয়, এবং আমরা আমাদের সহজাত যুক্তিবোধ হারিয়ে ফেলি। নৃশংসতা পরিমাপ করলে হয়তো এই ১৩৬টা মৃত্যুর সাথে গত ৪ বছর নিহত প্রায় ১০০০ সন্ত্রাসীর মৃত্যুকেও একই কাতারে স্থাপন করা যায়। কিংবা আরও একটু দুরে গিয়ে তাকালে অপারেশন ক্লিন হার্টের সময়ও ৮১ জন বিনাবিচারে নৃশংস ভাবে নিহত হয়েছিলো, তাদের কথাও বিবেচনা করা যায়। আমি তুলনা করতে চাই, প্রতিটা অমানবিক মৃত্যুর বিচার দাবি করা উচিত, এই ঔচিত্যবোধ থেকেই যদি প্রতিটা ঘটনাকে দেখতে চাই তাহলে রাষ্ট্রের ভুমিকাকে প্রশ্ন করতেই হয় আমাকে। রাষ্ট্র সংঘবদ্ধ যুদ্ধবাজদের কাছে কতটা অসহায় হয়ে আছে? প্রত্যেকেরই ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার আছে, প্রত্যেকটা অপমৃত্যুই তার পরিজনের কাছে অনাকাঙ্খিত।

প্রতিটা মৃত্যুই কিছু শুন্যতা রেখে যায়। সেনাসদস্যগণও আমাদের মতো মানুষ, এবং তাদেরও পরিজন চাইছে এই হত্যাকান্ডের বিচার। শোকের দহনে স্বাভাবিক চিন্তাবিচ্যুত হয়ে একজন যখন বললেন তিনি তার স্বামীকে যেভাবে মারা হয়েছে বিডিআরদের সেভাবেই হত্যা করা হোক, এ টিথ ফর টিথ, এন আই ফর এন আই, প্রতিহিংসা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। যদিও তার সম্পূর্ণ অধিকার আছে, তবে নৃশংসতা দিয়ে নৃশংসতা রোধ করা যায় না। অনেক দিক আগে, ট্রেনের কামরায় বৃদ্ধ এক সৈনিকের সাথে কথা হয়েছিলো।

সৈনিকের বয়েস ৫৫ বছর, তার অবসরের সময় হয়ে যাচ্ছে, অবসরের আগে সে যাচ্ছে তার গ্রামের বাড়ী। নিয়মিত পরিশ্রমে পেটা শরীর, কানের দু পাশে কাঁচা পাকা চুল, হয়তো নিয়মিত নয়, কিন্তু সেদিন পান খেয়ে তার ঠোঁট লাল। বসে আছেন চার সীটের আসনের একটা কোনায়। তখন সদ্য এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত, সাধারণ মানুষেরা তখন আর্মিকে তেমন ভয় পায় না, এবং একটু বয়স্ক মানুষেরা যেমন সম্ভ্রম নিয়ে তাকায়, সদ্য কৈশোর পেরোনো আমি তখনও তেমন বড় ভয়ের কিছু দেখি নি। সুতরাং তাকে নিজের মনোভাব জানাতেও সমস্যা হলো না।

কথা বলতে গিয়ে বুঝলাম, আদতে সেও আমাদের মতো সাধারণ মানুষ, একজন সৈনিক, আমার ধারণা মতে যতটুকু রাষ্ট্রীয় সুবিধা পাবেন আশা করেছিলাম, ঠিক ততটা রাষ্ট্রীয় সুবিধা পান না, তখন তার বেতন ছিলো সব মিলিয়ে ৪০০০, প্রতি সপ্তাহে রেশনে ৫ কেজি চাল, পরিবারে ছেলে ২ জন। তারা গ্রামে থাকে গ্রামের স্কুলে পড়ে, এসএসসি দিবে। আমি সৈনিকের দিকে তাকাই, তার পেটা শরীর দেখে মনে হয় না তার অবসরের সময় হয়ে গিয়েছে, তার উপরে তার ছোটো ছেলে যে এখনও স্কুলের চৌকাঠ পেরোয় নি এবং তার বড় ছেলে, যে হয়তো তার অবসরে যাওয়ার সময় হয়তো এইচএসসি দিবে, কিছুটা হলেও আমার সমবয়সী সেই ছেলেটার পিতা হিসেবে তাকে দেখলাম। তিনি অবসরে গেলে পাবেন সব মিলিয়ে ৮৪ হাজার টাকার মতো। এই টাকায় কিভাবে দিন গুজরাণ করবেন সেই চিন্তায় ব্যকুল, সেই মানুষটাও তার পেশাগত জীবনে তেমন সম্মান পান না তথাকথিত কমিশনড অফিসারদের কাছ থেকে।

তারাও নিতান্ত চাকরের মতোই ব্যবহার করে তার সাথে। তাদের কাজ বাগান পরিচর্যা, তাদের কাজ ঘাস কাটা, তাদের কাজ আগাছা নিড়ানো, মূলত তারাই শাররীক পরিশ্রমের কাজগুলো করে থাকেন। একজন এইচএসসি পাশ ছেলে যখন সামরিক বাহিনীতে যোগদান করে, যেহেতু পদাধিকার বলে তারা এই সাধারণ সৈনিকের তুলনায় উপরের কাতারে তারা নিতান্ত অবহেলায় তাদের অচ্ছুত জ্ঞান করে। তবে সবাই তেমন নন, কেউ কেউ বড় ঘরের সন্তান হলে, তাদের আপনি করেও বলে। এইসব কতিপয় মানুষদের প্রশংসা করে চলে যাওয়া মানুষটাকে আমি শেষ পর্যন্ত দেখলাম তারপর নেমে গেলাম আমার গন্তব্যে।

আমার এক বন্ধু, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম এক দিন হঠাৎ করেই, আচ্ছা তোর বাসায় কে কে আছে? মা , বাবা, ছোটো ভাই- ছোটো ভাই কোন ক্লাশে পড়ে, এইটে বৃত্তি পাওয়ার পরে আর পড়ে নাই, বিডিআরে জয়েন করছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি, বললাম কেনো পড়াশোনা কন্টিনিউ করলো না। বাসার যে অবস্থা, আমার বাবা অবসর নিয়েছে, বৃদ্ধ, শাররীক পরিশ্রম করতে পারে না, আমি যতটুকু পারি সাহায্য করি, কিন্তু সবটুকু পারি না। ছেলেটা চমৎকার, একটু কুণ্ঠিত, একটু ধর্মভীরু, কিন্তু সব মিলিয়ে ভালো মানুষ ছিলো। কোনো রাজনৈতিক অভিসন্ধিবিহীন সাধারণ ছাত্র, যে প্রতিদিন বিকেল বেলা টিউশনি করতে বের হয়ে যেতো, ঠিক ৯টা কিংবা ১০টায় ফিরতো টিউশনি শেষ করে, হলের ক্যান্টিনে খেয়ে, পড়তো, ভালো ছাত্র ছিলো।

তার বিশ্ববিদয়ালয়ে পড়বার খরচ, তার ছোটো বোনের খরচ, তার মায়ের চিকিৎসার খরচ, সব মিলিয়ে যতটুকু সম্ভব ততটুকুই করতো ও। আমি ওর বাস্তবতা শুনে আহত বোধ করলাম, ওর সাথে নিয়মিত ঠাট্টার সম্পর্ক বদলে গিয়ে একটু সম্ভ্রম জাগলো, আমি একেবারে বখে যাওয়া ছেলে, যা কিছু হচ্ছে চারপাশে তার কোনোটাই আমাকে স্পর্শ্ব করে না, আমার পয়সার অভাব আছে, হয়তো দু হাত খুলে খরচ করতে পারি না, কিন্তু অন্তত আমার ভাবতে হয় না বাসায় কেউ অসুস্থ হলে কি হবে, বাসার টেবিলে ভাত কিভাবে উঠবে। অপারেশন ক্লিন হার্ট চলছে, পাবনার এক প্রাক্তন ছাত্রনেতা, এলাকার মাস্তান ছিলো এক সময়, তবে অনেক দিন হয়েছে তিনি রাজনীতির সাথে যুক্ত না, বাসার সামনে ছোটো একটা ব্যবসা করে জীবন চালান, বিয়ে করেছেন, প্রথম মেয়ের বয়েস তখনও ২ হয় নি, তাকে এক রাতে ধরে নিয়ে গেলো যৌথ বাহিনী ভয়ংকর সন্ত্রাসী হিসেবে তাকে গুলি করে মেরে ফেলে গেলো। তার মেয়ের কান্নার দাগ শুকায় নি, হয়তো এই বাবা, প্রাক্তন সন্ত্রাসী, যার সাথে রাজনীতির সংশ্রব নেই ৫ বছর, তাকে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী করে, তাকে হত্যা করতে বিন্দুমাত্র বিব্রত হতে হয় নি প্রশাসনকে। এবং ৮৩ জন নিহত হয়েছিলো, পঙ্গু হয়েছিলো আরও হাজার খানেক।

এই প্রতিটা অমানবিকতাই দেখিয়ে দিয়েছে, এই দেশে মানবিকতা হরণের বিচার হয় না সব সময়। আমি রাষ্ট্রের কাছে বিশেষ কিছু দাবি করি না। শুধু দাবি করি মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো রাষ্ট্র পুরণ করুক। তাকে অন্ন নিরাপত্তা দিক, তাকে মাথাগোঁজার একটা ঠাঁই করে দিক, তাকে ন্যুনতম শিক্ষায় শিক্ষািত করুক, যেনো সে নিজের উপার্জন নিজে করে সম্মানজনক জীবিকা নিয়ে জীবনধারণ করতে পারে। এবং সেই সাথে চাই, প্রতিটা মানুষ যেনো সরকারী হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসা পায়, প্রায় পঙ্গু সরকারি হাসপাতালগুলোর স্বাস্থ্য সেবার মান খুবই খারাপ, অন্তত তার পরিজন যেনো এইটুকু সান্তনা নিয়ে বলতে পারে, যতটুকু সামর্থ্যে ছিলো তার সবটুকু দিয়েই তার রোগউপশমের চেষ্টা করেছিলাম আমরা।

নিহত সামরিক বাহিনীর সদস্যদের প্রতি আমার ক্ষোভ নেই, বিদ্বেষ নেই, তাদের সরকারের তরফ থেকে ১০লক্ষ টাকা দেওয়া হবে, তাদের সন্তানদের শিক্ষার যাবতীয় দায় দায়িত্ব নিবে সরকার, এই সরকারী উদ্যোগকেও আমার আপত্তিকর মনে হবে না, যদি, ঠিক একই সময়ে নিহত বিডিআর সদস্যদের পরিবারের সাথেও একই মানবিক ব্যবহার করা হয়, আজকে দুইজন কর্ণেল সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সকল বিডিআর সদস্যই এই বিদ্রোহে যুক্ত ছিলো না, তাদের কেউ কেউ সেনাসদস্যদের সহায়তা করেছে, এবং এই আভ্যন্তরীণ কোন্দলে কিছু বিডিআর সদস্য নিহত হয়েছে। তাদেরও পরিবার আছে, তারাও এই হতয়ার বিচার চাইতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্র কি তাদেরও একই রকম সুবিধা দিতে বদ্ধ পরিকর? মেধা কিংবা দক্ষতা কিংবা যোগ্যতার ঘাটতি নয় বরং অনেক সময়ই অর্থনৈতিক দৈন্যতাই নির্ধারণ করে দেয় কোন মানুষটা সাধারণ পদাতিক সৈনিক হবে আর কোন মানুষটা গিয়ে হবে লেঃকর্নেল। যেই মানুষটা পেটের দায়ে সামরিক বাহিনীর সাধারন পদাতিক সৈনিক, সেই মানুষটার মেধা নেই এমন না, যারা নিহত হয়েছেন, তারাই মেধাবী এমন না, তারাই মানব দরদী এমন নয়, এমন অনেক মানবদরদী চারপাশে আছে, তবে সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সময় যেভাবে দেবতাজ্ঞান করা হচ্ছে, তাতে দেবতার প্রয়ানে পূজারীস্তাবক হয়তো আত্মহত্যা করবে। একটু সংযত আচরণ করা উচিত মিডিয়ার, একেবারে উপেক্ষা এবগ একেবারে মাথায় তুলে নাচার মাঝামাহি, যার যতটুকু প্রাপ্য ঠিক ততটুকুই দেওয়ার বোধ কবে হবে বাংলাদেশের মিডিয়ার?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।