আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পরগাছা

...ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাচিয়া,সদাই ভাবনা, যা কিছু পায়, হারায়ে যায়, না মানে স্বান্তনা...
প্রতিযোগিতাটা বিকেলে। তবে সবাই দুপুর থেকেই হাজির। কত দেশের কত রকম মানুষ এসেছে। মানুষের গায়ের রংএরই তো কতরকম ধরন। আবির অবাক হয়ে যায়।

এটা একটা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা। সবাই বলে ম্যাথ অলিম্পিয়াড। অংক করার প্রতিযোগিতা। তৈলাক্ত বাঁশ আর চৌবাচ্চার পানির অংক না। শূণ্য নিয়ে, নাম্বার লাইন নিয়ে খেলা করার অংক।

আবির খুব মজা পায় এই খেলাটায়। পাড়ার ক্রিকেটে সেরা বোলার অন্তর বলে ছয় মারার আনন্দ আর একটা জটিল সংখ্যার সমস্যা সমাধানের আনন্দ তার কাছে একই মনে হয়। কখোনো বা তার চেয়েও বেশী। প্রতিযোগিতার প্রথম পর্ব হবে যেখানে সেখানে গিয়ে বসে ছিলো আবিরদের দলটা। পুরো বাংলাদেশের বিভিন্ন স্কুল থেকে তিন জনকে বাছাই করা হয়েছে এই প্রতিযোগিতার জন্য।

আবির, সোহান আর তিন্নি। সোহান আর তিন্নি জামাল স্যারের সাথে একটু নীচ তলায় গেছে। আবির যেখানে বসে আছে তার ঠিক পাশেই একটা মেয়ে বসে আছে। দেখে মনে হয় আরব। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আবির হাই জানালো।

মেয়েটাও তার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে উত্তর দিলো। প্রতিযোগিতার অনেক দেরী। তাই তারা টুকটাক গল্প শুরু করলো। (পাঠকের সুবিধার জন্য আমি বাংলায় লিখছি) -আমি বাংলাদেশ থেকে। তুমি? আবির জানতে চাইলো।

-আমি পাকিস্তান থেকে। পাকিস্তান নামটা শুনলেই আবিরের ভেতর একটা রাগ কাজ করে। এই পাকিস্তানিরাই তো লাখ লাখ মানুষ মেরেছে বাংলাদেশে একাত্তরে। তাই আর কথা বলবে কিনা বুঝতে পারছিলো না আবির। -আমার নাম আমা।

তোমার নাম? মেয়েটাই নিজ থেকে প্রশ্ন করে। - আমি আবির। - আমরা কি বন্ধু হতে পারি? পাকিস্তানি দের সাথে বন্ধুত্ব করতে ইচ্ছে করে না আবিরের। তারপরো নিতান্তই অভদ্রতা হবে বলে বলে, অবশ্যই। কেন নয়।

-তোমার জন্মদিন কবে? মেয়েটার প্রশ্ন। -১৪ই মে। তোমার কবে জন্মদিন? আবিরও জানতে চাইলো। - আমার ২১ শে ফেব্রুয়ারী। এই দিনটা আমার খুব প্রিয়।

আমি অনেক অনেক মজা করি এই দিন। আবিরের কেমন যেন গা গুলিয়ে উঠে। কেমন ঘেন্না ঘেন্না লাগে। রাগে বলে বসে -কিন্ত এই দিনটায় আমরা শোক পালন করি। এই দিনটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের দিন।

তোমাদের কারনে। মেয়েটা খুব অবাক হয়। প্রশ্ন করে, -কেন? তোমাদের কষ্টের দিন কেন? -কারন এই দিনে আমরা আমাদের বাবা দাদাদের হারিয়েছি। কেন জান? ভাষার জন্য। আমরা আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলতে চেয়েছিলাম।

কিন্তু তোমরা আমাদের উপর উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দিয়েছিলে। সেজন্য আমাদের বাবা দাদারা পথে নেমেছিলেন ভাষার দাবি নিয়ে। তাদের উপর তখনকার পাকিস্তানি শাসকরা গুলি চালিয়েছিলো। অনেকে শহীদ হয়েছিলো। একটানে অনেকগুলো কথা বলে থামে আবির।

-সত্যি, আমি তো কিছুই জানতাম না। কোথাও পড়িনি কাউকে ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে। এটাকি সত্যি? তবে উর্দু তোমাদের ভাষা হলে মনে হয় ভালোই হতো। এখন তুমি আর আমি ইংরেজীতে কথা না বলে উর্দুতে কথা বলতে পারতাম। - হ্যা সত্যি।

সেই আন্দোলন সফল না হলে কে বলতে পারে আজ হয়তো আমি তোমার সাথে উর্দুতে কথা বলতাম। আবির একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। -উর্দু অনেক ভালো ভাষা। অনেক সমৃদ্ধ। ।

ইকবালের মতো কবি আছেন যিনি উর্দুতে লিখতেন। মেয়েটা নিজের ভাষার প্রশংসা করে। আবিরের রাগটা একটু পড়ে এসেছিলো। আবার জাগলো। -তোমাদের উর্দু ভাষার কোন কবি নোবেল পেয়েছেন? আবির প্রশ্নটা না করে পারলো না।

-না। -তোমাদের উর্দু ভাষার কি নিজস্ব বর্ণমালা আছে? - ঠিক নিজস্ব নেই, আমরা আসলে আরবী হরফে আমাদের ভাষাটা লিখি। -তোমাদের ভাষাটা তো আসলে হিন্দি। তোমরা একটু এদিক ওদিক করে নিয়েছো। মেয়েটা কি উত্তর দিবে ঠিক বুঝতে পারে না।

কারন কথাটা সত্য। তার মুখটা কালো হয়ে আসে। হঠাৎ করে মেয়েটির উপর থেকে আবিরের সব রাগ পড়ে যায়। করুনা হতে থাকে। আসেলেই তো কারো যদি নিজের একটা ভাষা না থাকে, নিজের বর্ণমালা না থাকে তার মতো অসহায় আর কে আছে।

কিছু কথা: আমি যেখানে চাকরি করি সেখানে নানা দেশের মানুষের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করতে হয়। ঈজিপসিয়ান, কুয়েতী, ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানী। বেশীর ভাগ সময়ই কথা হয় ফোনে বা এম.এস.এন মেসেঞ্জারে। পাকিস্তানীদের সাথেও কথা বলতে হয় কাজের খাতিরে। দেখলাম তারা আমাদের সত্যিকারের ইতিহাসটা জানে না।

তারা অনেকেই জানে না বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের কথা। একাত্তর সম্পর্কেও তাদের ধারনা ভুল। আমরা বিভিন্ন চ্যানেল আর বিশ্ব বিখ্যাত মুভি গুলোর কল্যাণে ভিয়েতনাম যুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে কত কিছু জানি। নরম্যান্ডির উপকুলের যুদ্ধের কথা বা পার্ল হারবার যুদ্ধের কথা পৃথিবীর সবাই জানে। কিন্তু তার চেয়ে অনেক অনেক বড় আত্মত্যাগ যে আমাদের দেশে হয়েছে, ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে মানুষ, সেই ইতিহাস পৃথিবীর কতজন জানে? পুরো পৃথিবীকে আমরা তা আজো জানাতে পারিনি।


 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।