আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাখির নীড়ে বিদ্যুৎচমক! আ বোল্ট ফ্রম দ্য জ্যামেইকা

যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

১. বেইজিংয়ের আকাশ কাল পরিস্কার ছিলো, সেখানে "বিনামেঘে বজ্রপাত" হয়েছে কিনা জানিনা। তবে, বেইজিংয়ের পাখির নীড়ে (বার্ডস-নেস্ট স্টেডিয়াম) ঠিকই বিদ্যুৎ চমকেছে; বিনামেঘে তো নয়ই, বরং সূদুর জ্যামাইকা থেকে এসেছে এই বিদ্যুতের চমক, চমকের নাম আপনি আমি সবাই জানি -- উসেইন বোল্ট। অসাধারণ!!! একের পর এক চমক এনেছেন এই ইতিহাসসেরা ক্রীড়াবিদ, ট্র্যাক-এন্ড-ফিল্ডের যাবতীয় উপপাদ্যকে একের পর ভুল প্রমাণইত করে বিদ্যুতের মতোই চমকেছেন অলিম্পকের আকাশে। এতদিন ধারনা করা হতো উচ্চতা যাদের খুব বেশী তারা ভালো দৌড়বিদ হননা, বরং গাট্টাগোট্টা শরীরই ব্যালান্স রক্ষার জন্য সুবিধাজনক। বোল্ট দেখালেন, সেটা সবসময় ঠিক না।

আবার ৯.৬ সেকেন্ডের ঘরে মানুষ কখনও ১০০ মিটার দৌড়াতে পারবে কিনা, সেটা নিয়েও বিদগ্ধজন অনেক কথা বলেছেন, বোল্ট ১০০ মিটার দৌড়ে ২০ মিটার বাকি থাকতেই বিজয়ীর মতো দুহাত প্রসারিত করে, ১০ মিটারের এরিয়ায় ঢুকে বুক চাপড়ে যেনো হেলাফেলা করেই দ্রুততম মানবের রেকর্ডটাকে ৯.৬৯ এ নামিয়ে আনলেন; এখন অনেকেই আক্ষেপ করছেন যে শেষ পর্যন্ত স্পীড ধরে রাখলে হয়ত সেটা ৯.৫ এর ঘরেই নেমে যেত!! বিদগ্ধজনেরা এটাও বলছেন যে বোল্টের পাশে আরেকজন বোল্ট থাকলে সে হয়ত ঠিকই ৯.৫ এর ঘরে রেকর্ড রেখে দৌড়টা শেষ করত! লোকের কথার কতটুকু সত্য হতো বা কি হতো জানিনা, তবে এটা এমনই এক দৌড় ছিলো যে এ নিয়ে হাজার রকম গুঞ্জন, বিদগ্ধজনের গালভরা উদ্ধৃতি আরো অনেকদিন ধরেই চলবে। তবে যত যাই হোক, গতকাল যেটা ঘটলো তার তুলনা কিছুইনা। এবারের অলিম্পকের আগে যে বিষয়গুলো আলোচনায় এসেছে, যেমন মাইকেল ফেল্পস আটটি সোনা জিতবে কিনা, উসেইন বোল্ট ৯.৬ এর ঘরে ১০০ মিটার স্প্রিন্টের রেকর্ড নামাতে পারবে কিনা, অথবা কার্ল লুইসের চব্বিশ বছরের লিগ্যাসি ১০০ আর ২০০ মিটারের স্বর্ণ এবার বোল্ট পাবে কিনা -- এগুলোর সবগুলোর উত্তরেই অনেকে বলেছেন "অসম্ভব না"। কিন্তু, এগুলোকে ছাড়িয়ে শুধু একটা রেকর্ডের ব্যাপারেই সবাই সন্দেহবাদীর মতো মাথা নেড়েছেন, ভেবেছেন সম্ভব হবেনা হয়ত সেটা ভাঙা। নতুন করে বলার দরকার নেই, এটা হলো ৯৬ এ মাইকেল জনসনের সেই "ক্ষিপ্র চিতা"র মতোন ২০০ মিটার দৌড়ের রেকর্ড, যেটাকে এখনও স্প্রিন্টের ইতিহাসে সবচেয়ে সুন্দর দৌড় বলা হয়, যে দৌড়ে অংশ নিতে পেরেই শুধু ফ্রেডেরিক/বোল্ডনের মতো মহারথীরা গর্বিত বোধ করেছেন।

বিজ্ঞজনের ধারনা ছিলো স্প্রিন্টে যথেষ্ট পরিমাণ প্রযুক্তিগত উন্নতি না হলে, যেমনটা এবার হয়েছে সাঁতারের পোশাকে, আর কেউ কখনও সেই রেকর্ড ভাংতে পারবেনা। ১৯.৩২ সেকেন্ডের সেই ২০০ মিটারের দৌড়টা দেখার পর আমি অনেকদিন হিসেব মেলাতে পারিনি কেনো মাইকেল জনসন ১০০ মিটারে দৌড়ায়না, কারণ তার সেই রেকর্ডকে সাধাসিধেভাবে ২ দিয়ে ভাগ করলে গিয়ে দাঁড়ায় ৯.৬৬ সেকেন্ড, মানে ১০০ মিটারের সে সময়ের রেকর্ডের চেয়ে ০.১৫ সেকেন্ড কম!! সে যাই হোক, বোল্ট যখন ১০০ মিটারের রেকর্ড কে ৯.৬৯ এরে ঘরে নামিয়ে আনলো, তাও অনেকটা হেসে খেলে, তখন অবশ্য এটা বেশ জম্পেশ আলোচনায় পরিণত হলো যে ২০০ মিটারে সে পারবে কিনা! সবাই যেনো একটু নড়েচড়ে বসলেন। তাও, সেখানেও অধিকাংশই মত দিয়েছেন পারবেনা। এমনকি একজন নামকরা দৌড়বিদ (সম্ভবতঃ বোল্ডন) হিসেব কষেও দেখিয়ে দিয়েছেন যে কার্ভ পার হবার পরের ১০০ মিটার জোরে দৌড়াতে পারলেও প্রথম ১০০ মিটারে স্মুথরেসার জনসনকে অতিক্রম করতে পারবেননা বলে আমাদের উসেইন বোল্টের সময় হবে ১৯.৪০ (একেবারে হিসেব মিলিয়ে দিয়েছেন)। মাইকেল জনসন বলেছিলেন ১৯.৫০ এর কাছাকাছি হতে পারে।

হিসেব নিকেশ জমে উঠেছিলো, আর আমরা দর্শক/পাঠকরাও এসবের আলোচনা পড়ে পড়ে জমে গিয়েছিলাম, ভাবতে লাগলাম দেখি কি হয়! ২. অনেকদিন ধরেই মনটা বিক্ষিপ্ত, এত বিক্ষিপ্ত মনে খেলা উপভোগ করা কঠিন, তাও নেটের সুবাদে বোল্টের ২০০ মিটার দৌড়ের উপর নানানজনের থিসিস পড়ে আগ্রহটা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ালো চুড়ান্তে! রাতের খাওয়া শেষে এককাপ চা হাতে কার্পেটে বসে পড়লাম, একটু পরেই নাকি ২০০ মিটার দৌড় শুরু হবে। উগ্র জাতীয়তাবাদী জাপানীদের দেশে টিভি যে এই কোন "জাপানীর-অংশ-না-নেওয়া-ইভেন্ট" এয়ার করছে, সেটা দেখেই খানিকটা তৃপ্ত বোধ করলাম, ভাবলাম, "নাহ, ভাগ্যটা অত খারাপনা আজ! বল্টু পারতেও পারে" আসলে আমি ভয়ে ছিলাম, জাপানী টিভিতে ইভেন্টটা সরাসরি দেখাবে কিনা এই নিয়ে! এনএইচকে দেখায়নি, কারণ তখন জাপান-আমেরিকার ফালতু বেসবল খেলা চলছিলো, অন্য একটা টিভি দেখিয়েছে (টিবিএস)। দৌড় শুরু হবার আগে ওযু করার সময়ে মাথা মাসেহ করার মতো করেই আমাদের উসেইন বোল্ট নিজের মাথাটাকে ঘিরে কি কি যেন করলো, হয়ত সেটা তার নিজস্ব বানানো কোন রিচুয়াল। তারপর উপরের দিকে ছুঁড়ে দিলো সেই বিখ্যাত তীর-ধনুক। এদিকে চায়ের কাপ হাতে আমি উত্তেজনায় কাঁপছি, মনেপ্রাণে চাইছি বোল্ট রেকর্ডটা ভাঙুক, যেনো রেকর্ডটা ভেঙে গেলেই আমার বিক্ষিপ্ত মনটা শান্ত হবে, যেন রেকর্ডটা ভেঙে গেলেই সবকিছু নতুনপথে চলা শুরু করবে।

কি জানি কেনো, সেরকমই মনে হচ্ছিলো, মনে হচ্ছিলো বোল্টের এই দৌড় আমার জন্যেই। দৌড় শুরুর দশ সেকেন্ডের মধ্যেই বোল্ট যেভাবে অন্যদের ফেলে এগিয়ে গেলো, তাতে আর কারো সন্দেহ থাকার কথা না যে সে স্বর্ণপদক ছাড়া অন্য কিছু পাচ্ছে। কিন্তু সেটা তো আমার-আপনার মাথাব্যাথা না। সেটা জ্যামেইকানদের হতেপারে, ওদের আরেকটা স্বর্ণ বাড়লো, সে হিসেবে। আমি দেখতে লাগলাম টিভি পর্দার ডানদিকে নীচের কোণের টাইমটেলপটা, যেখানে স্টপওয়াচের সময় দেখায়।

দেখতে পাচ্ছি, বোল্ট গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, টেলপে দেখাচ্ছে ১৭ সেকেন্ড, ১৭ থেকে ধুপধাপ বেড়ে ১৮, তারপর ১৯ ... বোল্টের সাথে সাথে যেনো আমিও দৌড়ালাম, সেই ১২/১৩ বছর বয়েসের কিশোরের মতো চীৎকার করতে লাগলাম, "সাবাশ! সাবাশ!!! হবে, হবে, হবে!!!" ... রুদ্ধশ্বাসে দেখলাম আমাদেরে বোল্ট মার্ক ক্রস করলো, আর সময়??? সেটা দেখাচ্ছে ১৯.৩১!!! বসে থাকা অবস্থায় লাফ দেয়া যায়না, আমি শুধু চীৎকার করতে লাগলাম "বাঘের বাচ্চা, বাঘের বাচ্চা" আর কার্পেটে গড়া গড়ি। যেনো রেকর্ড টা আমি গড়েছি! ভাগ্য ভালো চায়ের কাপটা গড়িয়ে পড়েনি, আরো ভাগ্য ভালো যে পরে দেখলাম রেকর্ডটা ১৯.৩০ (বাতাসের গতির কিসব হিসেব-টিসেব আছে হয়ত)। বিলিয়ন বিলিয়ন লোকে দেখেছে, সবাই নিশ্চয়ই এরকম আনন্দই পেয়েছে। বোল্টের এই কীর্তিটা যেনো এই বার্তা দিয়ে গেলো, সব দুশ্চিন্তার অবসান হবে, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, অসম্ভব সাধনইতো মানুষের কাজ। বোল্ট ফ্র দ্য ব্লু আসে খারাপ হিসেবে, কষ্ট দিতে; আর বোল্ট ফ্রম দ্য জ্যামেইকা বুঝি এসেছে ভালো হিসেবে, আনন্দ দিতে।

সেটাই যেনো হয়। জয়তু উসেইন বোল্ট, তোমাকে লাল সালাম।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।