আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জীবনানন্দ দাশ : 'বনলতা সেন' কাব্যগ্রন্থ

বাস্তবতা ফেরী করে বেড়াচ্ছে আমার সহজ শর্তের সময়গুলোকে

* এই পোস্টটার মুল্ উদ্দেশ্য হলো জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থটির কবিতাগুলো এক পোস্টে প্রকাশ করা। আশা করছি সেই কাব্যগ্রন্থটির সবগুলো কবিতা এই পোস্টে পাওয়া যাবে। জীবনানন্দ দাশের অন্যতম জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ বনলতা সেন। ১৯৪২ সালে কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এটি জীবনানন্দ দাশের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ।

তার আগে ঝরা পালক (১৯২৭) এবং ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬) নামের দুইটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছিল। এই কাব্যগ্রন্থটিতে মোট ২৯ টি কবিতা স্থান পেয়েছে। বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ শুরুর কবিতাটির নাম কাব্যগ্রন্থের নামে- বনলতা সেন । বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা কবিতা তে প্রথম ১৯৩৩ সালে কবিতাটি প্রকাশিত হয়। অ্যাডগার অ্যালেন পো এর 'টু হেলেন' কবিতাটির সাথে বনলতা সেন কবিতাটির কিছু সাদৃশ্য রয়েছে।

বনলতা সেন চরিত্রটি জীবনানন্দ সৃষ্ট বিখ্যাত একটি চরিত্র। এই চরিত্রটি আরে কিছু নামে পরিচিত, যেমন- শ্যামলী, সবিতা, সুরঞ্জনা। প্রত্যেকটি নাম দিয়েই কাব্যগ্রন্থটিতে একটি করে কবিতা আছে। ### বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থটির কবিতাগুলো বইয়ের ক্রম অনুযায়ী দেওয়া হলো। পোস্ট অংশে রয়েছে ৫ টি কবিতা।

বাকি কবিতাগুলো কমেন্ট অংশে আসবে। ০১. বনলতা সেন হাজার বছর ধরে আমি পথ হাটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি ; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে সেখানে ছিলাম আমি ; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে ; আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারি দিকে জীবনের সমুদ্র সফেন, আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন। চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য ; অতি দূর সমুদ্রের পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর, তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে ; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন। সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে ; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল ; পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন তথন গল্পের তরে জেনাকীর রঙে ঝিলমিল ; সব পাখী ঘরে আসে - সব নদী - ফুরায় এ-জীবনের সব লেন দেন ; থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন। ০২. কুড়ি বছর পরে আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি আবার বছর কুড়ি পরে- হয়তো ধানের ছড়ার পাশে- কার্তিকের মাসে- তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে - তখন হলুদ নদী নরম নরম হয় শর কাশ হোগলায়- মাঠের ভিতরে! অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর, ব্যস্ততা নাইকো আর, হাঁসের নীড়ের থেকে খড় পাখির নীড়ের থেকে খড় ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল।

জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি, বছরের পার,- তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার! হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে সরু -সরু কালো-কালো ডালপালা মুখ নিয়ে তার, শিরীষের অথবা জামের, ঝাউয়ের-আমের; কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে! জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার- তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার! তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেঁচা নামে- বাবলার গলির অন্ধকারে অশথের জানালার ফাঁকে কোথায় লুকায় আপনাকে! চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে। সোনালি সোনালি চিল- শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে- কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে! ০৩. ঘাস কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয় পুথিবী ভরে গিয়েছে এই ভোরের বেলা; কাঁচা বাতাবির মতো সবুজ ঘাস-তেমনি সুঘ্রাণ- হরিণেরা দাঁত দিয়ে ছিড়ে নিচ্ছে। আমারো ইচ্ছা করে এই ঘাসের এই ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো গেলাসে - গেলাসে পান করি, এই ঘাসের শরীর ছানি- চোখে চোখে ঘষি, ঘাষের পাখনায় আমার পালক, ঘাষের ভিতর ঘাস হয়ে জন্মাই কোন এক নিবিড় ঘাস-মাতার শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে। ০৪. হাওয়ার রাত গভীর হাওয়ার রাত ছিল কাল- অসংখ্য নক্ষত্রের রাত; সারারাত বিস্তীর্ণ হাওয়া আমার মশারিতে খেলেছে; মশারিটা ফুলে উঠেছে কখনো মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মতো, কখনো বিছানা ছিঁড়ে নক্ষত্রের দিকে উড়ে যেতে চেয়েছে, এক-একবার মনে হচ্ছিল আমার- আধো ঘুমের ভিতর হয়তো- মাথার উপরে মশারি নেই আমার স্বাতী তারার কোল ঘেঁসে নীল হাওয়ার সমুদ্রে শাদা বকের মতো উড়ছে সে! কাল এমন চমৎকার রাত ছিল। সমস্ত মৃত নক্ষত্রেরা কাল জেগে উঠেছিল-আকাশে একতিল ফাঁক ছিল না; পৃথিবীর সমস্ত ধূসরপ্রিয় মৃতদের মুখও সেই নক্ষত্রের ভিতর দেখেছি আমি; অন্ধকার রাতে অশ্বত্থের চুড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির - ভেজা চোখের মতো ঝলমল করছিল সমস্ত নক্ষত্রেরা; জোছনারাতে বেবিলনের রানির ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার শালের মতো জ্বলজ্বল করছিল বিশাল আকাশ! কাল এমন আশ্চর্য রাত ছিল।

নে নক্ষত্রেরা আকাশের্ বুকে হাজার-হাজার বছর আগে ম'রে গিয়েছে তারাও কাল জানালার থিবর দিয়ে অসংখ্য মৃত আকাশ সঙ্গে করে এনেছে যে রুপসীদের আমি এশিরিয়ায়, মিশরে বিদিশায় ম'রে যেতে দেখেছি কাল তারা অতিদূরে আকাশের সীমানায় কুয়াশায় কুয়াশায় দীর্ঘ বর্শা হাতে করে কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে যেন- মৃত্যুকে দলিত করবার জন্য? জীবনের গভীর জয় প্রকাশ করবার জন্য? প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ তুলবার জন্য? আড়ষ্ট- অভিভূত হয়ে গেছি আমি, কাল রাতের প্রবল নীল অত্যাচার আমাকে ছিঁড়ে ফেলেছে যেন; আকাশের বিরামহীন বিস্তৃর্ণ ডানার ভিতর পৃথিবী কিটের মতো মুছে গিয়েছে কাল! আর উত্তুঙ্গ বাতাস এসেছে আকাশের বুক থেকে নেমে আমার জানালার ভিতর দিয়ে, শাঁই শাঁই করে, সিংহের হুঙ্কারে উৎক্ষিপ্ত হরিৎ প্রান্তরের অজস্র জেব্রার মতো! হৃদয় ভরে গিয়েছে আমার বিস্তীর্ণ ফেল্টের সবুজ ঘাসের গন্ধে, দিগন্ত-প্লাবিত বলীয়ান রৌদ্রের আঘ্রাণে মিলনোন্মত্ত বাঘিনীর গর্জনের মতো অন্ধকারের চঞ্চল বিরাট সজীব রোমশ উচ্ছ্বাসে, জীবনের দুর্দান্ত নীল মত্ততায়! আমার হৃদয় পৃথিবী ছিঁড়ে উড়ে গেল, নীল হাওয়ার সমুদ্রে স্ফীত মাতাল বেলুনের মতো গেল উড়ে, একটা দূর নক্ষত্রের মাস্তুলকে তারায়-তারায় উড়িয়ে দিয়ে চলল একটা দুরন্ত শুকনের মতো। ০৫. আমি যদি হতাম আমি যদি হতাম বনহংস; বনহংসী হতে যদি তুমি; কোন এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে ধানক্ষেতের কাছে ছিপছিপে শবের ভিতর এক নিরালা নীড়ে, তাহলে আজ এই ফাল্গুনের রাতে ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে আকাশের রুপালী শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম- তোমার পাখনায় আমার পালক, আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন- নীল আকাশে খইক্ষেতের সোনালী ফুলের মতো অজস্র তারা, শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড়ে সোনালী ডিমের মতো ফাল্গুনের চাঁদ। হয়তো গুলির শব্দ; আমাদের তীর্যক গতিস্রোত, আমাদের পাখায় পিস্টনের উল্লাস, আমাদের কন্ঠে উত্তর হাওয়ার গান! হয়তো গুলির শব্দ আবার : আমাদের স্তব্ধতা, আমাদের শান্তি। আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু আর থাকত না; থাকত না আজকের জীবনের টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার; আমি যদি বনহংস হতাম, বনহংসী হতে যদি তুমি; কোন এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে ধানক্ষেতের কাছে। (এই কাব্যগ্রন্থটির বাকি কবিতাগুলো কমেন্ট অংশে আসবে।

)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।