আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শ্রমিক এবং মিডিয়া শ্রমিক

যা দেখছি, যা বুঝছি, যা ভাবছি...

মে দিবসের ছুটিতে বাবা-মার কাছে নরসিংদীতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফিরে একটি পোস্ট লিখব লিখব করেও লেখা হচ্ছিল না। অবশ্য লেখার জন্য যে বিষয়টি ঠিক করেছি তা ভালভাবে ফুটিয়ে তুলতে না পারার ভয়টাও কাজ করছিল সমানভাবে। অবশেষে ভয়কে জয় করে আজ লিখব বলে ঠিক করেছি। আমার মতো আমার কয়েকজন বন্ধুও মে দিবসের ছুটিতে বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল ।

শুধু আমি কিংবা আমার বন্ধুরা নয় পুরো দেশের সকল (?) শ্রমজীবী মানুষই দিনটি উপলক্ষে ছুটি ভোগ করেছে। সকল শব্দের পর প্রশ্নবোধক দেয়ার কারণটি পরে ব্যাখ্যা করছি। বিরামহীন কাজ করতে করতে কান্ত কর্মজীবী মানুষের কাছে প্রত্যেকটি ছুটিই যে তীব্র দাবদাহের পর এক পশলা বৃষ্টির মতো আসে তা আমরা সবাই জানি। প্রত্যেকেই পরম কাক্ষিত ছুটিকে তাদের নিজেদের মতো করে উপভোগ করেন। কেউ গ্রামের বাড়িতে যায়, কেউবা স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঘোরাঘুরি করে, কেউবা সারাদিন বাসায় ঘুমিয়েই ছুটি কাটিয়ে দেন।

এবারের মে দিবসেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এখন মে দিবসের ইতিহাসের উপর একটু চোখ বুলানো যাক। ১৮৮৬ সালের এই দিনে আমেরিকা হে মার্কেট চত্বরে দৈনিক আট ঘন্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের উপর পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণে প্রাণ হারান ১০ জন শ্রমিক। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। গড়ে ওঠে শ্রমিক-জনতার বৃহত্তর ঐক্য।

অবশেষে শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার। শ্রমিকদের এই আত্মত্যাগের স্মারক আজকের মহান মে দিবস। আত্মত্যাগের বিনিময়েই মালিকরা স্বীকার করে নিয়েছিল শ্রমিকরাও মানুষ। শ্রমিকরা যন্ত্র নয়, তাদেরও বিশ্রাম ও বিনোদনের প্রয়োজন রয়েছে। পরবর্তীতে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগোর রক্তঝরা অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়ে ঐ ঘটনার স্মারক হিসেবে পহেলা মেকে ঘোষণা করা হয় ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস’।

১৮৯০ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হচ্ছে মে দিবস। এ উপলক্ষে এদিন সংবাদপত্রসহ সব শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকে। এ ইতিহাসটুক মাথায় রেখে এখন সামনে এগুনো যাক। আমাদের এলাকায় থার্মেক্স নামে একটি স্পিনিং মিল আছে। (সামান্য মিটার রিডার থেকে কোটিপতি হওয়া সেই কাদের মোল্লা এর মালিক) এলাকার অনেকের মতো দূরদূরান্ত থেকে আসা অনেকেই এ মিলে কাজ করে।

তিন শিফটে ভাগ করে দিন-রাত ২৪ ঘন্টাই চলে এ মিলে কাজ । পূঁজিবাদের অনিবার্য নিয়ম অনুসারে এ মিলেও কোন শ্রমিককে পারতপক্ষে ছুটি দেয়া হয়না। ফলে দূরের শ্রমিকদের পরিবার পরিজনদের সাথে দেখা সাক্ষাৎও সহসা ঘটেনা। তবু তারা ছুটির অপেক্ষা করতে থাকে। আর আবেদনের পর আবেদন করতে থাকে।

মে দিবস উপলক্ষে সারা দেশের শ্রমিকদের মতো তারাও ছুটি পাবে বলে আশা করেছিল। আপনজনদের সাথে দেখা করার একটি সুযোগ পেয়ে অন্য সব শ্রমজীবী মানুষের মতো তারাও দিনটি কিভাবে কাটানো যায় তার পরিকল্পনা করেছিল অনেক সময় নিয়ে। কিন্তু তাদের সে আশা পূরণ হয়নি। এ দিনটিতেও তারা পায়নি তাদের ন্যায্য ছুটি। এটাই লেখার শুরুতে সকল শব্দের পর প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেয়ার কারণ।

ছুটির চেয়েও আরও বড় প্রহসনের বিষয় হচ্ছে এদিন সকালে মে দিবস উপলক্ষে মিল চালু রেখে শ্রমিকদের এক প্যাকেট করে বিরিয়ানি দেয়া হয়। বিরিয়ানির প্যাকেট দিয়ে মিলের মালিক মে দিবসে শ্রমিকদের আত্মত্যাগের মূল্য দিয়েছেন মনে করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন। বিরিয়ানি নিয়েই শ্রমিকদের ছুটতে হয়েছে কাজে। এ নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ থাকলেও চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ে তারা প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। অথচ এই দুর্মূল্যের বাজারেও এ মিলে তাদের পুরো মাসের পরিশ্রমের মূল্য দেয়া হয় মাত্র দেড় হাজার খানেক টাকা।

মে দিবসের ইতিহাস থেকে আমরা জানি শ্রমিকরা আত্মত্যাগের মাধ্যমেই প্রমাণ করেছিল তাদের বিশ্রাম ও বিনোদনের প্রয়োজন রয়েছে। অথচ আজ ১২০ বছর পরও তারা তাদের ন্যায্য অধিকার পায়নি। প্রতি বছর মে দিবস আসলে সভা-সেমিনারে বক্তারা শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলেন। কিন্তু এরপর যেই লাউ সেই কদুই থাকে। শ্রমিকরা নিষ্পেষিত হতে থাকে নীরবে।

আর মে দিবস আমাদের মতো কিছু লোকের জন্য ছুটি কাটানোর দিন হিসেবে ফিরে ফিরে আসতে থাকে। শুধু আমাদের এলাকার থার্মেক্স স্পিনিং মিল নয় সারা দেশে এরকম আরও অনেক মিল-গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিও এদিন খোলা ছিল বলে পরে জানতে পেরেছি। শুধু কাজ করাই নয়, এসব জায়গায় এদিনও শ্রমিকদেরকে নির্ধারিত আট ঘন্টার বেশি কাজ করতে বাধ্য করানো হয়েছে। মে দিবসের ইতিহাস মাথায় রাখলে শ্রমিকদের জন্য এর চেয়ে বড় প্রহসন আর কি হতে পারে? এখন আসা যাক আমাদের স্বাধের মিডিয়ার কথায়। আমরা আশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য করি মিডিয়াতে এ সম্পর্কিত কোন সংবাদ থাকে না।

শুধু ‘আজ মহান মে দিবস’ জাতীয় কিছু গৎবাধা সংবাদই আমাদের মিডিয়া হাউজগুলো পরিবেশন করে। সারা বছরের মতো মে দিবসেও শ্রমিকরা পুঁজিপতিদের কাছে নিষ্পেষিত হলে আমাদের স্বাধের মিডিয়া চুপ করে থাকে। অথচ তারাও এদিন ছুটি ভোগ করে। বলা হয়ে থাকে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের আশা-আকাক্ষা, দুঃখ-হতাশা, সমস্যা-সম্ভাবনা ইত্যাদি সবকিছু তুলে ধরাই মিডিয়ার দায়িত্ব। বেসরকারী হিসাবে দেশে শিল্পকারখানায় কর্মরত প্রাতিষ্ঠনিক শ্রমিকের সংখ্যা ৭০ থেকে ৮০ লাখ।

(সূত্র ঃ দৈনিক যুগান্তর, ০১.০৫.২০০৮) এ বিপুল সংখ্যক মানুষের আশা-আকাক্ষাই যদি আমাদের মিডিয়াতে না আসে তাহলে তারা যে আসলে কাদের কথা বলে তা বুঝতে আমাদের কষ্ট করতে হয়না। ন্যায্য বেতনভাতার দাবিতে শ্রমিকরা আন্দোলনে নামলে মিডিয়ার এ চরিত্রটি আমরা আরো ভালভাবে বুঝতে পারি। শ্রমিকদেরকে তারা পরোক্ষভাবে নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য দায়ী করে। অথচ শ্রমিকদের কোন অধিকার না দিয়ে পুঁজিপতিরা যে তাদের দিনের পর দিন শোষণ করে ক্রমে নিঃশেষ করে দিচ্ছে এ সম্পর্কিত কোন সংবাদ আমাদের মিডিয়াতে আসে না। কিন্তু পুঁজিপতিদের কোন সুবিধা পাইয়ে দিতে কিংবা সরকারী কোন সিদ্ধান্ত তাদের বিরুদ্ধে গেলে তা বাতিল করতে মিডিয়াগুলো আদাজল খেয়ে লাগে।

কিন্তু একটা ব্যাপার এখানে খেয়াল করার মতো। মিডিয়াতে যারা কাজ করে তারাও গার্মেন্টস শ্রমিকদের মতো এক প্রকার শ্রমিক। তারপরও মিডিয়া শ্রমিকরা কেন গার্মেন্টস শ্রমিকদের পক্ষ নেয় না? এ প্রশ্নটা এসেই যায়। এক্ষেত্রে আমার মতে দু’টো কথাই সমানভাবে সত্য। এক. তাদের পক্ষ নিতে দেয়া হয়না।

দুই. তারা ইচ্ছে করেই পক্ষ নেয়না। যাই হোক, অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে পরে বিস্তারিত আলোচনা করার ইচ্ছে রইল। তবে একটি কথা না বলে পারছি না, যদি তাদেরকে শ্রমিকদের পক্ষ নিতে না দেয়া হয় তাহলে তারা যে জাতির বিবেক কিংবা ন্বাধীন পেশাজীবী এ তত্ত্বগুলোর ভিত্তি থাকে কোথায়? আরেকটা ব্যাপার, ন্বাধীনতা নাই মানে মিডিয়া শ্রমিকদেরও অধিকার নাই। তাই যদি হয়, গার্মেন্টস শ্রমিকরা তো অন্তত তাদের অধিকার আদায়ের জন্য রাস্তায় নেমে আন্দোলন করে কিন্তু আমাদের মিডিয়া শ্রমিকরা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য কি করে এ প্রশ্নটাও এসে যায়।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.