আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মায়ের শাড়ি (গল্প)

আলো..

কথা বলার মাঝে আরেকবার ঝাকুনি খেতেই এই নিয়ে পাঁচবারের বার জামালকে বকা দিয়ে উঠলাম, "এই তুমি কি আস্তে চালাতে পারোনা নাকি?" তুমি বলাতেই হয়তোবা সে, লাফিয়ে লাফিয়ে প্যাডেল ঘুরাতে ঘুরেতে আমার দিকে না তাকিয়েই একটা মুচকি হাসি দিল, বলল, "আর কত আস্তে চালামু?"! কথাটা ঠিকই, আমার জন্যই সে ভালো রাস্তা দিয়ে ঘুরে খুব ধীরে ধীরে চালিয়ে যাচ্ছে। তবুও কখনো রিকশায় ওঠার অভ্যাস নেই আমার, ড্রাইভারটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরাতেই এখন এই ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে! ফোনে রিম্পির সাথে আজকের মাদারস ডের গিফট কেনা নিয়ে আগাম আলোচনা করছি। ও এতক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে, আমারো আর বেশিক্ষণ লাগবেনা বলে ফোনটা রাখি। এরপর হঠাৎ জামালের দিকে চোখ পরলো, এত ছোট ছেলেটা যে ঠিক মতো রিকশার প্যাডেলে পা-ই পৌঁছায় না। "এই তুমি এই বয়সে রিকশা চালাও কেন?" বলেই ভাবলাম এটা জিজ্ঞাসা করা উচিৎ হয়নি।

বেশ অনেকক্ষণ জামাল নিরবে এগিয়ে গেল। মনে মনে ভাবছে সে- আপাকে কেমনে বলবে সে একসময় ক্লাস ফাইভে পড়তো, সেই স্কুলঘর এখন মাটির সাথে মিশে নিশ্চিন্হ হয়ে গেছে! একসময় তাদের খোঁয়াড় ভরা হাঁস-মুরগি ছিল, গরু ছিল, এমনকি নিজেদের বাড়ির পিছনে এক টুকরা জমিও ছিল যার সবই এখন কবরখানায় পরিণত হয়েছে। আরো অনেকের মতো আদরের বড় আপাটাকেও সেখানে শুইয়ে রেখে পেটের তাগিদে শহরে চলে এসেছে ওরা। জামালের বাবার মতো ওদের পুরো সংসারটাকেই সেই কালো রাতে পঙ্গু করে দিয়ে গেছে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়। এসব বললেও আপা কতটুকুইবা মানে বুঝবে! তাই অনেকক্ষণ পর সে উত্তর দিল, " না চালাইলে খামু কি?"... ... গন্তব্যে পৌঁছে আমার ফ্লেক্সি করার একশ টাকার নোটটা ওর হাতে দিতেই সে জানালো ভাঙতি নাই।

আমি যখন বললাম লাগবেনা, সে কিছুতেই টাকাটা নিতে চাইলোনা। অবশেষে যখন মনে করো তোমাকে তোমার আপা দিয়েছে বলাতে সে আর কিছু বললনা। যাওয়ার জন্য ঘুরতে যেতেই জামাল জিজ্ঞাসা করল, "আপা একটা কথা... ... মাদার ডে মানে কি মা দিন?" প্রচন্ড অবাক আমি উত্তর দিলাম, "হুম, মাদারস ডে মানে মা দিবস!" মাদারস ডের তাৎপর্য জামাল কিছুই বোঝেনা। তবে নতুন যাত্রী নিয়ে যেতে যেতে তার নিজের মায়ের কথা খুব মনে পড়ে যায়। পঙ্গু বাবা আর ছোট বোনটাকে দেখাশোনার ফাঁকে তার বয়স্কা মা বাড়িবাড়ি কাজের খোঁজে দৌঁড়ায়।

জামালের একা সংসার চালাতে কি কষ্ট হয় মা বোঝেন। ছোট্ট বোনটাও এখনি কতটা বাস্তব বোঝে যে তারও কোন চাহিদা নেই। মা এখনো জামাল রাতে বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত জেগে বসে থাকেন, কখনোবা খাবার নিয়ে। মাঝে মধ্যে দেরি করে ফিরলে উদ্বিগ্ন হয়ে দরজার কাছে ছুটে এসে আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেন। কাদা-মাটি, ময়লা,ঝোলের গন্ধ ছাপিয়ে জামালের নাকে এসে লাগে ঘামের গন্ধ, মায়ের গন্ধ।

মায়ের গায়ে সারা বছর এই একটাই কাপড় দেখে সে। এর জন্য মায়ের কখনো কোন চিন্তাও নেই! জামাল আজ মনে মনে ঠিক করেছে মায়ের জন্য একটা কাপড় কিনে নিয়ে যাবে। সেই যে অনেক ছোট থাকতে বাবা তাকে নিয়ে মেলা থেকে মায়ের জন্য একটা ছাপা শাড়ি কিনেছিল, সেইরকম। ভাবতেই নতুন উদ্যামে প্যাডেল ঘোরানো শুরু করে সে। শেষ যাত্রীটা নামিয়ে দিতে দিতেই সন্ধ্যা পার হয়ে রাত নেমে আসলো।

এখান থেকে উড়ে উড়ে গেলেও দোকান পর্যন্ত পৌঁছাতে তার প্রায় এক ঘন্টার বেশি লাগবে। আজ সারাদিন একটু বেশি মজুরি পাওয়ার আশায় না খাওয়ার মতো কোন বিশ্রামও নেয়নি সে। ক্লান্ত দেহে অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে যেতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত জামে আটকালো। প্রায় দুই ঘন্টা পর জাম ছাড়িয়ে একটা লম্বা টান দিতে যাবে তখনই পাশ থেকে হুইসেল, পালানোর উপায় নাই... "ওই, ওই পিচ্চি ওই, এদিক আয়, আয়... ওই, এই বয়সেই চোক্ষে লাল বাত্তি দেখস না, না?" বলেই পিঠে ধাম করে এক বারি! জামাল চুপচাপই মারটা হজম করলো। পুলিশটা ওকে এখানে থাকতে বলে আরো কিছু রিকশার পিছনে বারি টারি দিয়ে এসে একটা সিগারেট ধরালো।

সারারাত থানায় আটকে জীবনের মতো একটা ভালো শিক্ষা দিবে নাকি, আর যেন এমন না করে, আরো নানা রকম উপদেশ দিয়ে অবশেষে তার মনে হয় একটু দয়ার সঞ্চার হলো। বলল সারাদিনের মজুরির ভালো একটা অংশ তাকে দিলেই সে আজকের মতো জামালকে ছেড়ে দিবে। রাতে না খেয়ে থাকতে হবে বলে অনেক কাকুতি-মিনতির করার পর সে অর্ধেকে রাজি হল। তবুও মায়ের কথা ভেবে জামাল সারারাত থানায় থাকার সাহাস পায়না। ঘাম ঝরানো মজুরির অর্ধেকটাই দয়ালু! পুলিশটার হাতে তুলে দিয়ে অন্ধকারে জামাল মিশে যেতে থাকে।

ক্লান্ত পায়ে প্যাডেল ঘুরায় আর ভাবে, খাদ্যের চাহিদাই যাদের অপূর্ণ থাকে তাদের অন্য কিছু চাওয়ার ভাবনা করাই যে হয়তো পাপ! -------------- বিশ্বের সকল মায়েদের জন্য অন্তর থেকে অনেক অনেক দোয়া, কৃতজ্ঞতা, শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা জানাই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.