আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিপর্যস্ত ঢাকা : বিপর্যস্ত নগর জীবন !



দেহের কোন অংশে ঘাঁ হলে আমরা চিকিৎসা করাই যেন, তা সারা শরীরে না ছড়ায়। শুধু ঘাঁ নয়, শরীরে কোন রোগ বা এর উপসর্গ দেখা দিলে প্রাথমিক অবস্থাতেই উঠে পড়ে লাগি আরোগ্য লাভের জন্য। সুন্দর এই পৃথিবীর প্রতি সবারই আলাদা একটা টান আছে। সবাই জানি বাঁচতে হবে। বাঁচতে চাই সবাই।

মরার আগে প্রাণপঁণ চেষ্টা করি জীবন বাচাতে। কারন, পৃথিবীতে টিকতে হলে জীবন রক্ষার বিকল্প কিছু নাই। এসব কথা একজন মানুষ কেন্দ্রিক। বাঁচতে হলে যেমন জীবন রার অপরিহার্য প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি সুস্থ-সুন্দরভাবে বসবাস করতে একটি দেশ, নগর/রাজধানী সর্বোপরি এর প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার বিকল্প কিছুই নেই। ঢাকা ! আজ থেকে ৪০০ বছর আগে বুড়িগঙ্গা নদীর সুবিশাল বুঁক চিরে গড়ে ওঠা একটি জনপদ।

যা আজ সমগ্র বাংলাদেশের রাজধানী। একটি নগর। এদেশের প্রাণকেন্দ্র। আমাদের দেশের প্রাণকেন্দ্র এই রাজধানীই আজ মৃত্যু মুখে পতিত। যেন খুঁটি নড়বড়ে এক দোঁচালা ঘর।

মৃদু বাতাসেই যে এটা গুঁড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়বে তা আর বলার অপো রাখে না। ১ কোটি ৫০ ল লোকের বসবাসরত এই নগরীর বুকে আজ জেঁকে বসেছে মরণব্যাধি বিভিন্ন রোগ। যা ক্যান্সারের মত ছড়াচ্ছে ঢাকার সর্বাঙ্গে। যেদিকে তাকাই সংকট, অনিয়ম আর অব্যবস্থাপণা। এমন কোন বিষয় নেই, যা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা না করলে চলবে রাজধানীবাসিদের।

সম্প্রতি নগরবীদরা ঢাকাকে ভূমিকম্প প্রবণ নগরী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। সবসময় আতঙ্কে থাকতে হয় এই বুঝি এলো ভূমিকম্প। এক গবেষনায় দেখা যায়, ঢাকায় ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ২৫ হাজারের ও বেশি মানুষ মারা যাবে এবং আহতের পরিমান ১ লাখ ৭ হাজার জন ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এবং এতে ক্ষতির পরিমান স্বাভাবিক মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন নগরবীদরা। আরও দেখা যায়, ঢাকা শহরের ৯০ ভাগ স্থাপনাই নিয়মবহির্ভূত।

অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট নানান দূর্ঘটনায় হাজার হাজার নগরবাসী অকালেই প্রাণ হারাচ্ছে। হাজারো সমস্যা মাথায় নিয়েই ঝুকিপূর্ণ এই শহরে বসবাস করছি আমরা। এসব থেকে উত্তরনের উপযুক্ত পদক্ষেপ নিচ্ছে না কোন সরকার। দূর্ঘটনা ঘটার আগে এসব নিয়ে ভাবার কোন সময় থাকে না সংশ্লিষ্ঠ কতৃপক্ষের। শুধুমাত্র দূর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর হয় দীর্ঘ মেয়াদী তদন্ত আর অবাস্তব সব পরিকল্পনা।

সময়ের দোলাচলে পরিকল্পনার রঙ্গিন মোঁড়কেই মোঁড়ানো থাকে তাদের সেসব পরিকল্পনাগুলো। পানি। দৈনন্দিন জীবন ধারনে অন্যতম একটি উপাদান। গুরুত্বপূর্ণ এই উপাদানটিকে জীবনের অপর নাম হিসেবেও চিনি আমরা। পানি ছাড়া পৃথিবীর সকল জীব সম্প্রদায়ের প্রাণ রা দূস্কর।

পানি ছাড়া একটি সবুজ পৃথিবী কল্পনাই করা যায় না। মেনে নিতেও কষ্ট হয়, চারদিকে নদীবেষ্টিত হওয়ার পরও রাজধানী ঢাকায় পানি সংকট চরম আকার ধারণ করছে। বিশ্বে অনেক নগর আছে যেখানে কোন ভৌত অবকাঠামো বা বিল্ডিং নির্মান করতে গেলে সেই অবকাঠামোর নকশায় সর্বপ্রথম বৃষ্টির ন্যাচারাল পানি সংরনের ব্যবস্থা না থাকলে সে নকশা অনুমোদন পর্যন্ত করা হয় না। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্র পুরো আলাদা। এসব অব্যবস্থ্যাপনার কারনে জীবন ধারনের প্রয়োজনীয় এই উপাদানটিই নগরে পর্যাপ্ত পরিমানে সরবরাহ করতে পারছে না ঢাকা ওয়াসা।

ঢাকায় প্রতিদিন ২’শ ৪০ কোটি লিটার পানির চাহিদা থাকলেও ওয়াসা পানি সরবরাহ করছে ২’শ ১০ কোটি লিটার। অতিরিক্ত উত্তেলোনের ফলে অস্বাভাবিক হারে নীচে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। নগরবীদরা আশংকা প্রকাশ করেছেন, অদূর ভবিষ্যতে রাজধানীতে সুপেয় পানির চরম সংকট দেখা দিবে। অভিযোগ আছে, ঢাকা ওয়াসা যে লাইনগুলো দিয়ে পানি সাপ্লাই করে সেগুলো ৫০-৬০ বছরের পুরনো। স্যুয়ারেজ লাইন আর পানির লাইন একসঙ্গে হওয়ায় ঝাঁজরা বা মরিচা ধরা লাইনে ফুটা হয়ে স্যুয়ারেজ লাইনের ময়লা আর ওয়াসার পানি মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।

এতে পানি বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। আর এসব পানি ব্যাবহার করে নগরবাসীরা আক্রান্ত হচ্ছে ডায়রিয়া, কলেরা, কুষ্ঠ, চর্ম সহ বিভিন্ন প্রকার পানিবাহিত রোগে। এতে সফলতার চাইতে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী হচ্ছে নাগরিক সেবাদানকারী এই প্রতিষ্ঠানটির। বিশেষজ্ঞদের মতে, সংকটের কারন হিসেবে পানির প্রাকৃতিক আঁধার গুলো নষ্ট করাই মূল কারন। ঢাকার চারপাশের নদ-নদীগুলো অবৈধ দখল আর দূষনে মৃত প্রায়।

অথচ এ বিষয়ে কোন পদপে গৃহিত হচ্ছে না। আজকাল গ্রাম অঞ্চলেও চলছে আবাসনের নামে কৃষি জমি, ডোবা, খাল, বিল ভরাটের মহোৎসব। ঢাকায় প্রতিদিন বাসা-বাড়ী, শিল্প কারখানা থেকে ৩০০০ থেকে ৩৫০০ টন ময়লা বের হচ্ছে। লোকবল সঙ্কট আর প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির অভাবে বিশাল এই ময়লা স্তুপের মাত্র ৫০ ভাগ সংগ্রহ করতে পারছে ঢাকা সিটি কর্রোরেশন। বাকি ৫০ ভাগ ময়লা রাস্তা ঘাট, এখানে সেখানে পড়ে থাকার কারনে পরিবেশ দূষনের পাশাপাশি উদ্ভব ঘটছে নানা রকম রোগ জীবানুর।

ঘাটতির অজুহাতে ঘন্টার পর ঘন্টা লোডশেডিংয়ের নামে বিদ্যূৎ লাইন বন্ধ রাখছে কতৃপ। কয়েক দফা দাম বাড়িয়েও বাড়ছেনা বিদ্যুতের কাঙ্খিত সেবার মান। বাড়ছে এই আছে, এই নেই ভেল্কিবাঁজী। সাধারন মানুষদের লোডশেডিং নামক অন্ধকারে রেখে এখানেও তারা চালাচ্ছে “আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ” হওয়ার ব্যবসা। যানজট ঢাকা নগরীতে আরেক বিড়ম্বনার নাম।

বিজ্ঞানের ভাষায়, জীব ও জড়ের মধ্যে পার্থক্য হল - জীব চলমান, গতিশীল এবং যার প্রাণ আছে। জড় হল, যার কোন গতি বা জীবন একটিও নেই। স্থিরতাই জড়ের লন। কিন্তু, ক্রমবর্ধমান এই বিরক্তিকর যানজটের কারনে আমরা যেন জড় পদার্থের ন্যায় গতিহীন, স্থির হয়ে পড়ছি। যানজটের কারনে ঢাকার নাগরীক জীবন দিনদিন অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে ।

এক ঘন্টার পথ পাড়ি দিতে লাগছে দুই থেকে আঁড়াই ঘন্টা। এর কারনে প্রতি বছর রাস্তাতেই হারিয়ে যাচ্ছে ৮১ লাখ ৫০ হাজার কর্মঘন্টা। গবেষনায় দেখা যায়, রাস্তায় নষ্ট হওয়া এই কর্মঘন্টার সর্বনিম্ন বার্ষিক অর্থনৈতিক মূল্য ১১ কোটি ৯০ ল টাকা। পরিবেশগত তি ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। পরিবহন মালিকদের তি প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা।

গতিহীনতার কারনে প্রতিটি যান চালিত বাহনের দৈনিক গড়ে প্রায় ৮ ঘন্টা রাস্তাতেই নষ্ট হচ্ছে। সিএনজি/জ্বালানী তেলের মূল্য হিসেবে প্রতিবছর ৫৭৫ কেটি টাকা সমমুল্যের অতিরিক্ত জ্বলানী পোঁড়ানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার তি হচ্ছে। উন্নয়নশীল এদেশের উন্নয়নকে পশ্চাৎমুখি করছে অভিশপ্ত এ যানজট। এ থেকে উত্তরনের উপায় কি।

যানজটের কবল থেকে ৪০০ বছরের প্রাচীন এই নগরকে বাঁচাতে নগরকর্তারা কি পদপে নিচ্ছে ? এই যদি হয় প্রশ্ন ! তাহলে, নগর কর্তারা আমাদের আশার গান শোনাবে। একদিন এ নগরীর মাটির নীচ দিয়ে মেট্রোরেল চলবে। যে স্বপ্ন অনেক আগ থেকেই দেখে আসছি। রাস্তার প্রতিটা মোড়ে মোড়ে ফুটওভারব্রীজ হবে। আর উড়াল সেতু সারা দেশব্যাপি বিস্তৃতি লাভ করবে।

এক গবেষনায় দেখা যায়, ঢাকার যানজট নিরসনে গৃহিত প্রকল্পগুলোর সিংভাগই গাড়ী বান্ধব। পরিবেশ বান্ধব বাহন রিকশার জন্য নেই কোন নির্দিষ্ট ষ্ট্যান্ড। অথচ ঢাকার ৩৮.৭ শতাংশ যাতায়াত সম্পন্ন হয় রিকশায়। সাইকেলের জন্য নেই কোন আলাদা লেন। মানুষ হাঁটতে চায় কিন্তু, হাঁটার জন্য নেই উপযোগী ফুটপাত।

সর্বত্র ভাঙ্গাচোরা, প্রাইভেট গাড়ীর অবৈধ পার্কিং, বিল্ডিংয়ের নির্মান সামগ্রী মজুদসহ বিরক্তিকর পরিবেশ ফুটপাতে। নেই মানসম্মত গণপরিবহন ব্যাবস্থা। মেট্রোরেল তো রূপকথার গল্প। এই নেই নেই এর মধ্যে আছে ব্যক্তিগত গাড়ীর অবাধ চলাচলের জন্য পাহাড়সম ফুটওভারব্রীজ। কিন্তু সমতলে নিরাপদ পারাপারের জন্য নেই জেব্রা ক্রসিং।

তা কি হয় ? এটা হলে তো যান্ত্রিক বাহনগুলোকে ব্রেক কষে কষে চলাফেরা করতে হবে। কৌতুহলী মনে প্রশ্ন জাঁগে ! একজন প্রতিবন্ধী, অসুস্থ ব্যক্তি, নারী/শিশু, সর্বোপরি ভারী মালামাল বহনকারী একজন মানুষ কিভাবে পাহাড়সম ঔ ফুটওভারব্রীজ ডিঙ্গিয়ে রাস্তা পার হবে ? যানজটের অজুহাতে একের পর এক তৈরী হচ্ছে উড়াল সেতু। বিষেষজ্ঞদের অভিমত, বিশাল বাজেটের তৈরী এই উড়াল সেতু গুলো সাময়িক চাপ কমালেও যানজট নিরসনে বড় ধরনের ভ’মিকা রাখবে না। যানজট নিরসনে সবার আগে দরকার প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রন এবং ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন। শিশুদের শারিরিক ও মানসিক বিকাশে মাঠ ও পার্কের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

কিন্তু, প্রয়োজনের তুলনায় ঢাকায় মাঠ, পার্ক, উন্মুক্ত স্থানের পরিমান খুবই কম। যাও আছে বিভিন্ন ভাবে দখলের কারনে সেগুলো ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। ফাকা জায়গাগুলোতে প্রতিনিয়ত উঠছে বড় বড় দালানকোঠা। যেন আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নে বিভোর অট্টালিকাগুলো। ঢাকায় আশংকাজনক হারে কমে যাচ্ছে সবুজ গাছপালা ও ঘাস।

কংক্রিটের কার্পেটে ছেয়ে গেছে ঢাকার জমিন। এজন্য উদ্ভিদকুলকে জীবন ধারনে প্রতিকুল অবস্থার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। পৃথিবীর বসবাস অনুপযোগী শহরের মধ্যে ঢাকা এখন অন্যতম। অপরিকল্পিত নগরায়ন, জনগনের আধিক্য, আবাসিক এলাকায় শিল্প-কারখানা নির্মান, পানির প্রাকৃতিক আধার- খাল বিল ভরাট, যানজট, শব্দ-পরিবেশ-পানি দূষণ, গরমে বিদ্যুৎ আর শীত এলেই গ্যাস সংকট। নানান কারনে ঢাকা ক্রমেই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।

চতুর্মূখী চাঁপে আজ বিপর্যস্ত নগরজীবন। উত্তরনে নানান প্রকল্প গ্রহন করলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বরং,চলমান সমস্যাগুলো আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। তবে এই চাপ ভয়াবহ হয়ে ওঠার আগেই যথাযথ ব্যাবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেইসাথে বন্ধ করতে হবে নির্বিচারে প্রকৃতির উপর নির্মম হস্তক্ষেপ।

নইলে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেবে। মনে রাখতে হবে, প্রকৃতির প্রতিশোধ-ক্ষমাহীন। মোঃ আবু রায়হান। উন্নয়ন কর্মী

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.