আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৃদু মন্দে মন্দারমণি - শেষভাগ

খুব গোলমেলে, নিজেও ভাল জানি না। তবে আছে,এই ঢের।

গাঢ় লাল হাফ ইটের দেওয়ালের উপর গাঢ় সবুজ দরমার বেড়া আর মাথায় সাদা অ্যাসবেষ্টাসের চাল দেওয়া এই কটেজগুলির পোষাকী নাম গার্ডেন রিট্রিট ৷ কালো কাঁচের জানালাগুলোর ধারগুলো সবুজে রাঙানো ৷ কালো কাঁচের মাথা নিচু দরজা আর দুটো করে জানালা ৷ ঘরের ভিতরে ঢুকতেই দেখা গেল নীল আর সাদা চৌকো চৌকো খোপকাটা ছাপওয়ালা স্যাটিন কাপড়ের চাঁদোয়া টাঙানো অ্যাসবেষ্টাসের নিচে ৷ আধো আধো আলো আঁধারির খেলা সেখানে ৷ লাল, সবুজ, নীল আর সাদা র ংসাথে কালো কাচের দরজা জানালা৷ সব মিলে মিশে সৃষ্টি করেছে এক অদ্ভুত রঙ্গ ৷ গরমটাকে উপেক্ষা করতে পারলে শুধু এই রংএর খেলা দেখেই হয়ত কাটিয়ে দেওয়া যেত একটি বেলা ৷ কিন্তু না ৷ এই গরমকে উপেক্ষা করা গেল না কিছুতেই৷ আসবাব বলতে এক প্রশস্ত বিছানা, ছোট একখানি সাইড টেবল, কাঁচের আর দু'খানি প্লাষ্টিকের চেয়ার ৷ জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে চোখে পড়ে এক মরা বেগুনের বাগান ৷ এবড়ো-খেবড়ো শুকনো ধুলোময় বালুমাটিতে বাগানসুদ্ধু গাছগুলো মরা ৷ দাঁড়িয়ে আছে কে জানে কার, কিসের সাক্ষী হয়ে ৷ কাদের এই বাগান? এই কটেজ মালিকেরই কি? এখানকার এই কটেজের ব্যবসা দেখতে দেখতে কারও একটুও হয়ত সময় হয়নি ঐ গাছেদের গোড়ায় একটু জল দেওয়ার ৷ শুকিয়ে গেছে তাই এক বাগানভর্তি বেগুনগাছ! মরা বেগুনের বাগানের পাশেই সবুজ পত্রবহুল এক নিমগাছ৷ কী অদ্ভুত! মন্দারমণিতে এখনও বিদ্যুত্ পৌঁছোয়নি ৷ তাতে কি? জেনারেটর আছে কী করতে৷ হোটেল, কটেজ সবই চলে জেনারটরে ৷ নামমাত্র খরচে যে যেভাবে পারে কটেজ তুলে দাঁড়িয়ে পড়েছে সেখানে ব্যবসা করতে৷ দরমার বেড়া, অ্যাসবেষ্টাসের চালের মাথা নিচু সেই সব কটেজে ঢুকলে জাহান্নামের আগুনের আঁচ খানিকটা টের পাওয়া যায় ৷ জেনারেটরে চলা পাখার বাতাস যেন আগুন ছড়ায় সেই কটেজে ৷ যারা চার অংকে বিল মেটাতে পারবেন তাঁরা ওঠেন রোজভ্যালীর চারতারা হোটেলে, সেখানে ঘরগুলো তাপানুকূল ৷ আমাদের মত পাতি মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তের সম্বল ঐ জাহান্নামসম কটেজ ৷ সেখানে করে খাচ্ছেন এখন বেশ কিছু মানুষ ৷ কেউ বা দিয়েছেন বিস্কুট, সফট ড্রিংকস, চিপসের দোকান তো কেউ কিনেছেন গাড়ি৷ মারুতী ভ্যান, টাটাসুমো নিদেনপক্ষে একটি অ্যাম্বাসেডর ৷ গাড়ি কেনার টাকা এসেছে ফসলী জমি বিক্রী করে ৷ সেইসব জমি আবার কিনে সেখানে ঢালাও চলছে মাছের ব্যবসা ৷ তৈরিই হয়েছে সব ভেড়ি৷ বাগদা, পোনা, তেলাপিয়ারা সেখানে বড় হয় মানুষের দেওয়া খাবার খেয়ে ৷ জমি বিক্রী করে যাঁরা গাড়ি কিনেছেন তাঁরাও ভালই করে খাচ্ছেন৷ দশ কিলোমিটার মতন রাস্তা কলকাতা দীঘা মহাসড়ক থেকে৷ যেতে হয় চাউলখোলায় নেমে৷ ট্রেকার আর ইঞ্জিনচালিত ভ্যানরিক্সা ছাড়া যাতায়াতের একমাত্র সম্বল এই গাড়িগুলি ৷ চড়া ভাড়ায় দল বেঁধে মানুষ চাপেন এই গাড়িগুলোতে ৷ হোটেল, কটেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন গাড়ির মালিকেরা গাড়ি নিয়ে ৷ বেড়াতে আসা যাত্রীদের পৌঁছে দিয়ে আসেন এঁরা কাঁথি, জুনপুট, দীঘা ৷ দশ কিলোমিটার দূরের চাউলখোলায় যেতে একটি মারুতী ভ্যান ভাড়া নেয় দুশো পঞ্চাশ টাকা, কাঁথি নিয়ে গেলে নেয় সাড়ে চারশো টাকা ৷ যাঁরা ফোন করে হোটেল-কটেজ বুক করে আসেন, তাঁরা চাইলে এই সব গাড়িগুলো এসে তাঁদের নিয়ে যায় কাঁথি, জুনপুট কিংবা দীঘা থেকে৷ ভাঙা এবড়ো-খেবড়ো রাস্তার ঝাঁকুনি কিংবা ধুলো থেকে অনেকটাই বাঁচিয়ে দেয় এই গাড়ি৷ গরমের কথা বলাই বাহুল্য ৷ অনেকেই একবেলার জন্যে এসে ঘুরে যান এই মন্দারমণিতে ৷ গাড়ি করে সকাল সকাল এসে ঘুরে বেড়িয়ে, সমুদ্রস্নান করে আবার ফিরে যাওয়া জুনপুট, দীঘা কিংবা কলকাতায় ৷ চমত্কার দীর্ঘ সৈকত, প্রবল গর্জনে আছড়ে পড়া সমুদ্র আর দূরে বিস্তৃত নারকেল বন৷ একটু নীরবতা প্রার্থীদের বেড়াতে আসার জন্যে আদর্শ স্থান৷ সাথে গাড়ি থাকলে ঘুরে আসা যায় আঠেরো কিলোমিটার লম্বা এই বিচ, যার সাথে সাথেই এগিয়েছে নারকেলের বনও৷ গাড়ি না থাকলে চুপটি করে বসে পড়া যায় কোথাও একটা জায়গা দেখে নিয়ে ৷ তবে যাঁরা রাত্রিবাস করবেন না তাঁদের এখানে বেলা বেশি না করাটাই শ্রেয় ৷ নইলে মিস করতে হতে পারে কলকাতা ফেরার সাড়ে চারটের লাষ্ট বাসটি ৷ যেমন আমরা করেছিলাম ৷ তারপর? একটি বাসের অপেক্ষায় হা পিত্যেশ! মেচেদা, হলদিয়া৷ যাহোক কিছু একটা ! সময় বুঝে আকাশের কোণে জমে ওঠে ঘন মেঘ, ঘন কালো ৷ দেখতে দেখতেই তা ছড়িয়ে যায় গোটা আকাশে , দেয় গুরুগম্ভীর ডাক আর নেমে আসে অঝোর বৃষ্টি৷ রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে কোনমতে দাঁড়িয়ে থাকা, টিনের চাল ভেদ করে মাথায় বৃষ্টির ফোটারা এসে পড়ে টুপটাপ টুপটাপ৷ কিছুই না পেয়ে অগত্যা উল্টো দিকের বাস ধরে যেতে হবে দীঘায় আর যাওয়ার আগে অবশ্যই মনে মনে একটা হিসেব করে নিতে হবে, হাতে এক্সট্রা সময় আর পয়সাকড়ি আছে তো! মফিজুল৷ মারুতী ভ্যানের মালিক ৷ নিজেই গাড়ি চালিয়ে পর্যটকদের নিয়া আসা যাওয়া করে, কাঁথি, জুনপুট, দীঘা ৷ আবার ফিরে আসে মন্দারমণি৷ মফিজুলের বাড়ি সোনামুই'তে৷ গ্রামের নামটি কি সোনামুখী? না না ৷ সোনামুখী নয়, সোনামুই! মফিজুলদের একসম বিঘা তিরিশ জমি ছিল ৷ সম্পন্ন চাষী পরিবার৷ কিন্তু এখন আর নেই সেই জমি ৷ সমুদ্র খেয়ে নিয়েছে ওদের চাষের জমি ৷ এখনও খানিকটা বেঁচে আছে৷ বিঘে দশ মতন৷ তবে এও যেতে পারে সাগরের পেটে যে কোন সময় ৷ সময় থাকতে মফিজুল তাই বেঁচে থাকা জমিটুকু বিক্রী করে দিয়েছে মাছের ব্যবসা করতে আসা একজনের কাছে, সেই টাকায় মফিজুল কিনেছে এই গাড়ি আর একটি ট্রাক্টর ৷ গাড়িটি সে নিজেই চালায় ৷ ট্রাক্টর ভাড়ায় খাটে৷ যাত্রীর আশায় মফিজুল যখন দাঁড়িয়ে থাকে কটেজের সামনে তখন পরম মমতায় পালকের ঝাড়ন দিয়ে ধুলো ঝাড়ে গাড়ির গা থেকে ৷ নরম কাপড় দিয়ে মুছে মুছে চকচকে করে তোলে সে তার গাড়ির শরীর৷ মফিজুলদের গ্রামে এখনও বিদ্যুত্ যায়নি ৷ মন্দারমণি থেকে মাইল পাঁচেক দূরে বিদ্যুত্এর শেষ খুঁটিটি দাঁড়িয়ে আছে ৷ এরপরে আর কবে এগোবে তা মফিজুল জানে না৷ তবে এগোবে এটুকু জানে৷ কারণ, যেভাবে বাইরের মানুষ মন্দারমণিতে আসছে, মাছের ব্যবসা, হোটেলব্যবসা করছে, তাদের নিজেদের তাগিদেই তারা বিদ্যুত্এর জন্যে দৌড়-ঝাঁপ করবে আর আলো নিয়ে আসবে এটা মফিজুলের বিশ্বাস ৷ -:-

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।