আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘’বিশ্বজিত, ক্ষমা করো আমাদের’’

“আর আমারে মারিস নে মা, আর আমারে মারিস নে মা...... বলি মা তোর চরণ ধরে”............ আমি এই বাংলায় জন্ম নেওয়া কোন এক স্বাধীন মনের যুবক। ৭১ আমি দেখিনি তবে শুনেছি সত্য ইতিহাস,সত্য সব কথার জ্বলন আমার বাবার মুখে, দাদুর মুখে। স্বাধীনতার নায়ক কে আর কারা-ই বা দেশ দ্রোহী ছিল সেই সব কথা ঘোলাটে থাকলেও স্বাধীনতা অর্জনে আমরা কতটুকু বিসর্জন দিয়েছি সে কথা ‘আওয়ামী’ পন্থী আর ‘বি ন পি’ পন্থী অথবা অন্য সব দলের সবাই জানি। মায়ের সামনে মেয়ে ধর্ষিত আর অজস্র লাশের অজস্র নৃশংস দৃশ্য এই বাংলার মাটি, আকাশ, বাতাস সমস্ত আজীবন সাক্ষী। গণতন্ত্রের বড় প্রয়োজন ছিল আমাদের! আমাদের মৌলিক অধিকার থেকে শুরু করে সমস্ত অধিকার ফিরে পাবার বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল মনে, তাইতো মহৎ কিছু লোকদের দৃঢ়তার স্পর্শে আমরা সাত কোটি বাঙালি সেইদিন শপথ নিয়েছিলাম সমস্ত কিছু বিসর্জনে প্রকৃত গণতন্ত্র আনবো।

আমাদের খেটে খাওয়া মানুষদের চোখে আয়েশি ঘুম ফিরিয়ে আনবো। হায়রে আমার সাধের গণতন্ত্র! স্বাধীনতার ৪১ বছরে আমরাই জন্ম দিয়েছি অজস্র ইয়াহিয়া খান। ৭১ সালের ইয়াহিয়া খানের মুখ এখন রাস্তায় রাস্তায় মোড়ে মোড়ে খুঁজে পাওয়া যায়। স্বাধীন এই বাংলাদেশে । আহারে... ভাবতেই কষ্টের করুণ সুর বেজে উঠে এই মনে! কিছুদিন আগে বিশ্বজিতের স্বাধীন বাংলা দেখে নির্বাক তাকিয়েছিল আমাদের ১৬ কোটি বাঙালি।

বিশ্বজিতের চোখের ভাষা ছিল আমাদের জন্য বিরাট এক উপহার। ডিসেম্বর মাস স্মরণ করেছি আমরা। এই ঘটনা যদি একাত্তরে হতো হয়তো স্বাধীনতা ৯ মাসের অনেক আগেই শেষ হয়ে যেত! কিন্তু এক ইয়াহিয়া খান তা করেনি, আমাদের এই স্বাধীন দেশের অজস্র ইয়াহিয়া খান করে দেখাল। বিশ্বজিতের রক্ত এখন আর কথা বলেনা, আমাদের দেশের হাজারো খেটে খাওয়া মানুষের রক্তের মতো তারও রক্ত অনেক সস্তা আর বোবা। চাপাতি দিয়ে বানানো তার শরীরের বিচ্ছিন্ন অংশ গুলো আমাদের আয়েশি নাস্তার টেবিলে সাজানো খাবারের মতোই।

বিশ্বজিত তুমি ভুল করেছো এই বাংলায় জন্ম নিয়ে, এই ভুলটা খুবই যথেষ্ট তোমার এই পরিণতির। আজ থেকে পাঁচ কিংবা ছয় বছর আগের একটা ঘটনা আমার খুব মনে পড়ে। আমাদের এলাকার পৌরসভা পরিষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কুকুর নিধন করার। সদ্য উন্নতির পথে হাটা এই শহরে কুকুর খুব একটা মানায়না অথবা অন্য কোন কারণ যা আমার জানা নেই! দুই-তিন দিনে বিশ থেকে পঁচিশ টি কুকুর মারা হয় । আমাদের শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শীতলক্ষ্যা নদীতে মরা কুকুর গুলো ফেলে দেওয়া হয়েছিলো, মরা এই কুকুর গুলো নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে শহরের ই কাছাকাছি কোন একটা গ্রামের ঘাঁটে গিয়ে লাগে।

আর শহরের বাকি সমস্ত কুকুর গুলো চলে গিয়েছিল সেই ঘাঁটে আর সারা রাত ধরে আহাজারির মতো সুর করে কুউ...... কুউ...... শব্দ করেছিলো। বোবা প্রাণী গুলোর চোখের কোণে ছিল নির্মমতার প্রতিবাদ, একটা কুকুর ও শহরের ভিতরে দেখা যায়নি, সব গুলো জড়ো হয়েছিলো সেই ঘাঁটে। কতো টুকু মর্ম বিদারী সেই কুকুরগুলোর আহাজারি আজো আমার কান আমার হৃদয় আর এই আকাশ,বাতাস আর ঈশ্বর সাক্ষী। আমার মতো আরও অধিকাংশ মানুষের চোখে পানি এসে গিয়েছিল সেই দৃশ্য দেখে। দৃশ্যটি নজরে এসেছিলো পৌরসভা পরিষদের তারপর কুকুর মারা বন্ধ হয়েছিলো।

হায়রে আমরা মানুষ!!! বিশ্বজিতের দেহ ক্ষত বিক্ষত হয় আর আমরা ক্যামেরা নিয়ে ছুটি তার পিছু-কিছু ক্লোজ ছবি নেয়া যায় কিনা! আর আমরা টিভিতে খবর দেখি গরম একটা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে! বি ন পি পল্লীতে খবর রটে যায় নতুন কোন ইস্যু পাওয়া যায় কিনা। আওয়ামী পল্লী ব্যস্ত থাকে সোনার ছেলেদের কিভাবে নিষ্পাপ প্রমাণ করা যায়! আইনের বড় বড় কর্তাদের বিছানায় চলে ফিসফাস, নতুন ফ্ল্যাট অথবা বাড়ি কেনার প্ল্যান! আর আমরা স্বাধীন জনতা খবরের কাগজে কিংবা টিভিতে খুঁজতে থাকি বিশ্বজিতের অতিরঞ্জিত রক্ত! বিকৃত আমাদের মস্তিষ্ক খুঁজে যায় আরও কাছের কোন দৃশ্য পাওয়া যায় কিনা! আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগে, একজন ব্যবসায়ীকে চাদা না দেয়ার কারনে গুলি করে মারা হয়েছিলো ঢাকার কোন একটা স্থানে, পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো পরের দিন। আহারে......!!! তার লাশ টি যেখানে পড়েছিল সেখানে তার পালিত কুকুরটি ঠাই বসেছিল। লাশ সরিয়ে নেওয়ার পরও কুকুরটি সরেনি। এইভাবে কয়েকদিন না খাওয়া অবস্থায় বসে থেকে কুকুরটি সেখানেই মারা যায়।

একটা কুকুরের অনশন আর মৌন ঘৃণা দেখে আমার মনটা বেদনায় হু হু করে উঠেছিলো... তারপর ভুলে গেছি সব। আমি এবং আমরা মানুষ! বিশ্বজিত, তুমি ক্ষমা করো আমায় এবং আমাদের! আমরা মানুষ! আমরা কুকুর নই! হাজারো ক্ষুদিরাম বসুর রক্ত আমাদের ভাবায়না এখন ..................... আর আমারে মারিস নে মা... আর আমারে মারিস নে মা... বলি মা তোর চরণ ধরে...... গণতান্ত্রিক আমাদের এই মাতৃভূমির কাছে তোমার বেঁচে থাকার আকুতি ১৬ কোটি মানুষের বত্রিশ কোটি কানে একটু ও আলোড়ন তোলে না এখন! তোমার তরে কেউ অনশন করেনা, করেনা আহাজারি। কোন ধর্ম কোন দল কোন মানবতার সভ্য সমাজ তোমার স্বাভাবিক মৃত্যুর আশ্বাস দিতে পারেনা। আমার বিকৃত মস্তিষ্ক আরও বিকৃত হয়ে যায় যখন দেখি মিডিয়াতে আওয়ামীলীগের ক্ষমতাশীল কিছু সভ্য মানুষেরা বিবৃতি দেয়, “এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা” অথবা খুনিরা সবাই জামাতের সদস্য। হায়রে দেশের নেতা! কোন একবারও কি তাদের মনে আসেনা “বিশ্বজিত যদি আমার সন্তান হতো”? নিজেকে বিশ্বজিতের স্থানে দাড় করিয়ে দিয়ে আমার বাবা-মার মুখ খানি আমি কল্পনা করতে চেষ্টা করেছিলাম...... বিশ্বজিতের সেই শেষ শূন্য চাহনির মতো আমার দৃষ্টিরও কোথাও ঠাই হয়না।

রক্তে রক্তে আমার শুধু খুন চলাফেরা করে। মানুষ নাম নিয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করেনা! ইচ্ছে করে দেশের সমস্ত মিডিয়া জড়ো করে একের পর এক চাপাতি চালাই বেজন্মা এইসব রাজনীতিবিদ দের শরীরে। জানি আমি কিছুই হয়তো করতে পারবোনা! আমাদের মাথা আমাদের শরীর কিনে নিয়েছে ওরা। কারো বাবা কারো স্বামী আবার কেউ কেউ ধর্মের বলি দিয়ে এনেছে এই বাংলাদেশ। আমাদের কোন অধিকার নেই এইদেশে একটু শান্তিতে নিশ্বাস ফেলার........................... কবে যে এইদেশ আবার স্বাধীন হবে, কবে যে মানবতা মুক্তি পাবে এইসব হায়েনাদের হাত থেকে! জানি এইপথ অনেক দূর।

ইয়াহিয়া খানদের হাতেই বারবার রক্তাক্ত হবে এইদেশ, একবার... দুইবার ... তিনবার... এইভাবে সহস্র বছর যতদিন না আমরা এক বিশ্বজিতের জন্য ১৬ কোটি জনতা একসাথে কাঁদতে পারব, যতদিন না ১৬ কোটি জনতার মৌনতা বিস্ফোরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়বে প্রতিবাদের আগুন এইসব বেজন্মাদের ঘরে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.