আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঝরাপাতা ভালো লাগে, ভালো লাগে শরৎ

আমার অফিসটা যে গলিতে তার নাম Chemin d’Entre Bois। ফ্রেঞ্চ ভাষায় ক অক্ষর গোমাংস আমি ভেবেছিলাম, চেমিন ডেন্ট্রে বইস। আমার যার কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেবার কথা, তাকে পেলাম পরদিন। জিজ্ঞেস করলাম, এই বিদ্ঘুটে নামের মানে কি? আমার বিচিত্র উচ্চারণ শুনে সে যা বোঝার বুঝে নিলো, অট্টহাসি চাপা দিয়ে মৃদু হেসে বলল, এটার উচ্চারণ শমাঁ দন্ত্রে বোয়া, যার অর্থ বনে ঢোকার পথ। কেমন যেন বেকুব বনে গেলাম।

সিএইচ এর শ তো বুঝলাম, কিন্তু ই আর আই দিয়ে কেমন করে অ আর আ উচ্চারণ হয় ভেবে ভেবে বৃথাই অনেকটা সময় নষ্ট হলো, কূলকিনারা হলো না। তবে এক রুমের জানালা দিয়ে দেখলাম দূরে টিলামত একটা জায়গায় একসারি গাছ দেখা যাচ্ছে। এটাই কি সেই বন নাকি?
নতুন জায়গায় এসেছি, তাও আবার মাত্র পাঁচ দিনের জন্য। ভাওবাট্টা বুঝে নিয়ে সপরিবারে আবার আসব, পাকাপাকিভাবে। কাজের মধ্যেই কেটে যাচ্ছিলো সময়, এদিক সেদিক দেখার সুযোগ হয় নি।

। দুই একদিন পরে রিসেপশনের পাশে মিটিং রুমের জানালাটা দিয়ে যেই না উঁকি দিয়েছি, চোখদুটো যেন জুড়িয়ে গেলো। বাইরে ঘন সবুজের মেলা বসেছে, একটা বন, অফিসের মতো জায়গার পাশে যা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। আমি মেইন রোড থেকে সোজা অনেকদূর এসে অফিস বিল্ডিং সামনে রেখে বাঁয়ে মোড় নিই, যে রাস্তা সোজা চলে গেছে সেটা বেশিদূর দেখার সুযোগ হয় না, কারণ সেটা ঢালু হয়ে বেঁকে গেছে একটু সামনেই। তার আড়ালে যে এই বস্তু লুকিয়ে ছিলো কে জানত! রাস্তার নামকরণের সার্থকতা এতক্ষণে ধরতে পারলাম।


বনটাকে অনেক বড় মনে হচ্ছিলো। বিশাল এক খাদের ভেতর থেকে ধাপে ধাপে ডালপালা ছড়িয়ে বেড়ে উঠেছে ছোটবড় অনেক গাছ, যতদূর দেখা যায় ঘন পত্রপল্লব আর কালচে খয়েরী শাখাপ্রশাখা। আমি আসলে বনের লম্বালম্বি অংশটা দেখছিলাম, পরে জেনেছি আড়াআড়ি অল্প দূরেই ঘরবাড়ি রয়েছে, শীতকালে গাছগুলো পাতাশূন্য হয়ে গেলে চোখে পড়ে। আমি ভাবছিলাম, শহরের শেষপ্রান্তে চলে এসেছি বুঝি। মোটামুটি ব্যস্ত শহরের মাঝখানে একটা আস্ত বন থাকবে, এ আমার দূরতম কল্পনাতেও ছিলো না।

এখন দেখি, এই অঞ্চলে এটাই দস্তুর। কিছুদূর পরপরই গাছপালায় ঠাসা ঘন বন চোখে পড়ে, সেটা শহরের মাঝেও হতে পারে, আবার একপাশেও।
একদিন এক বারবিকিউ এর দাওয়াতে এরকম একটা বনে চলে গেলাম, সে অবশ্য এখানে আসার অনেক পরের কথা। বাইরে থেকে কিছুটা জংলা মনে হচ্ছিলো, ভেতরে গিয়ে দেখি, ঘরের আঙিনার মত পরিষ্কার। গাছ দিয়ে ঘেরা গোলমত একটা জায়গাতে ঝোপ ঝাড় কেটে রাখা, ঘাসগুলোও বড় নয়, কিছু জায়গা তো একেবারে ঘাসশূন্য, সমতল।

এক কোণে বারবিকিউ এর চুলা রাখা আছে, সেখানে কেবল কয়লা ঢেলে দিলেই প্রস্তুতি শেষ। অল্পদূরেই একটা রেস্তোরাঁ রয়েছে, ধরে নিলাম এটা তাদেরই কাজ, খদ্দের টেনে আনার কৌশল। তা নইলে বনের এককোণে কানা গলিতে কে আসবে খেতে? সঙ্গীরা জানালেন এটা মোটেই সেরকম ব্যাপার নয়। রেস্তোরাঁ গেস্ট দিয়ে মোটামুটি পূর্ণ থাকে, তারা সেখানেই কাজ করেন, জেনেই বলছেন। এই ব্যবস্থা করেছে জেলা অফিস, তাদের নাগরিকরা যেন দুদণ্ড নিরিবিলি সময় কাটাতে পারে প্রকৃতির সাথে, সেজন্য।

প্রায় প্রতিটি বনে এরকম অসংখ্য জায়গা আছে।
হিংসায় চোখ ছোট ছোট হয়ে গেল। আমার মস্ত বদভ্যাস, বিদেশের কিছু দেখলেই দেশের সাথে তুলনা করে বসি। কল্পনায় দেখার চেষ্টা করলাম, বনবিভাগের লোকজন ঢাকার একপাশে একটা বনে জনসাধারণের জন্য পিকনিক স্পট বানাচ্ছে। জমল না।

বরং ভেসে উঠল মীরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে দেখা দৃশ্যগুলো। কোথাও চুপচাপ বসার জায়গা নেই, হকাররা এসে তাদের বিক্রয়পণ্য সাধছে একটু পরপর। এক প্রেমিক প্রেমিকা যুগলকে ঘিরে ধরেছে কিছু বখাটে ছেলেপিলে, বিস্তারিত দেখবার সাহস হয় নি, পালিয়ে গেছি। সংরক্ষিত জায়গাতেই এই অবস্থা, খোলা বনে গেলে কি ঘটত?
মাঝে মাঝে ভাবি, এইসব তুলনা করার আমি কে? আমি তো বিপদ দেখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছি অনেক আগেই। নাইজেরিয়া আর দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে কপালের ফেরে এসে পড়েছি সুইজারল্যান্ডে, পৃথিবীর অন্যতম সেরা বাসস্থান বলে যার স্বীকৃতি প্রায় সব রকম পরিমাপেই।

ক’দিন আগে ঢাকা পেয়েছে দ্বিতীয় নিকৃষ্টতম শহরের তকমা, দুটোর মধ্যে কোনভাবেই তুলনা চলতে পারে না। যখন ছাত্র ছিলাম, যখন ছিলো যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময়, তখন দেশের বিপদে আপদে কোনরকম মাথা ঘামাইনি, এখন মায়াকান্নাগুলো আসলে একরকম ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু নয়।
ধান ভানতে শিবের গীতে চলে গেছি, বলছিলাম আমার অফিসের পাশের বনটার কথা। কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, ঐ পর্যন্তই। কখনো ভেতরে ঢুকে ঘুরেফিরে দেখতে যাই নি।

যদি জানতাম পোষা বন, তবে যেতাম নিশ্চয়ই। দিন গড়িয়ে গ্রীষ্মকাল শেষ হয়ে শরৎকাল চলে আসে। আমাকে অবাক করে দিয়ে সবুজ পাতা বদলে যেতে থাকে লাল, কমলা, হলুদ, খয়েরী, ম্যাজেন্টা ইত্যাদির বিভিন্ন শেডে। আসন্ন শীতের হুমকিতে তারা শয়ে শয়ে ঝরে পড়ে, গালিচার মত ঢেকে দেয় পথচারীদের পায়ে চলা পথ। শহরের উঁচু কোথাও দাঁড়ালে লেক জেনেভা আংশিক দেখা যায়, সূর্য ডোবার আগে যখন আকাশে লালচে কমলা আভা খেলা করে, তখন মনে হয় জলে স্থলে অন্তরীক্ষে সর্বত্র আগুন লাগিয়ে দিয়েছে কেউ।

এমন শরৎ কারো ভালো না লেগে পারে?
এই বছরের মাঝামাঝি ঢাকায় ছুটি কাটাতে গিয়েছিলাম। একটা ইমেইল পেয়ে মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল। অফিসে পার্কিং স্পেসের তুলনায় গাড়ি দ্বিগুণ হয়ে যাওয়াতে কিছু লোক আর পার্কিং পাবে না, তাদের গাড়ি রাখতে হবে জেলা কর্তৃপক্ষের গণ পার্কিংয়ে, অফিসে আসতে হবে সেখান থেকে বাসে চড়ে (পনেরো মিনিট, একবার বাস বদলে এবং বেশ কিছুটা পায়ে হেঁটে)। তবে ইমেইলে পরামর্শ দেয়া আছে, এমপ্লয়ীরা যদি বাস না ধরে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে যায়, তাহলে সেটা সময় সাশ্রয়ী হতে পারে! বুঝুন!
ঢাকা থেকে আসার পর এমনিতেই মনমেজাজ ভালো নেই, একরাশ বিরক্তি নিয়ে পার্কিংয়ে গাড়ি রেখে জঙ্গলের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলাম। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই বিরক্তি উধাও হয়ে তার জায়গা নিলো মুগ্ধতা।

শহরের এই অংশে আগে আসা হয় নি। এখানে বেশিরভাগ বাড়িই একতলা, সামনে পেছনে বিশাল বাগান, তাতে ফুটে আছে হরেক রকমের ফুল। সীমানা দেয়ালের পরিবর্তে আছে ছেঁটে চৌকোণা করে রাখা ঝোপঝাড়, তাতে আবার লাল কমলা গুটি গুটি ফল ধরেছে, অনেকটা খেজুর গাছের মত। এই এলাকায় লোহার একজন কারিগর ছিলেন কোনকালে, তার বাড়ির আঙ্গিনায় প্রজাপতি, পাখি থেকে শুরু করে ড্রাগন, ডাইনোসরের ধাতব প্রতিকৃতি সবই আছে। আশে পাশের বাড়ির মালিকেরা হয় একটা দুটো করে উপহার পেয়েছিলেন, নয়তো কিনে নিয়েছিলেন, সবার বাড়িতেই সেগুলো এখন ফুলবাগানের শোভা বাড়াচ্ছে।

একজন আবার এককাঠি সরেস, বারান্দায় রেখেছেন কোন একটি কেবল কারের গনডোলা, দেখেই বোঝা যায় বহু আগের। গাঢ় আকাশী রঙ ফিকে হতে হতে এখন প্রায় সাদাটে হয়ে গেছে।
বাড়িঘর পেছনে ফেলে একসময় বনে ঢোকার মুখটা চলে আসে, নিরাপত্তা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা হয় না, এখানে কোন ধরণের বিপদের আশংকা নেই, জানা হয়ে গেছে এই দুই বছরে।
উঁচু উঁচু গাছের ফাঁক দিয়ে একেবেঁকে ঢালু রাস্তা নেমে গেছে, রাস্তা চিনে নিতে অসুবিধা হয় না। বোঝাই যায় খাদের দিকে যাচ্ছি, পুরো নেমে গেলে আবার রাস্তাটা উঠতে থাকবে লোকালয়ের দিকে।

দুয়েক জায়গায় দিক দেখানো সাইনবোর্ডও রাখা আছে, চাইলেও হারানো সম্ভব নয়। একটি বাঁকে এসে হঠাৎ লোহার একটা কাঠামো চোখে পড়ে, এগোলে বুঝতে পারি, একটা কংক্রিটের সিঁড়ি, তাতে রেলিং লাগানো। বাহ, খাদের তলা পর্যন্ত যাবার উত্তম ব্যবস্থা দেখা যায়! কিন্তু না, সিঁড়ি নেমে গিয়ে শেষ হয়েছে একটা ব্রিজে, তলা দিয়ে কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে একটা পাহাড়ী নদী। খুবই অগভীর, পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত পানি উঠবে কিনা সন্দেহ। একটু দূর থেকে ভেসে আসছে শোঁ শোঁ শব্দ, সেখানে নিশ্চয়ই পাথুরে কোন বাধা আছে।

মন এমন ভালো হয়ে গেলো, মনে মনে অফিসকে ধন্যবাদ দিলাম আমার পার্কিং সুবিধা তুলে নেবার জন্য। নইলে এই জায়গা হয়তো কখনোই দেখা হয়ে উঠত না।
দিন কয়েক আগে জনাব জিপসি দিয়েছিলেন ঝরা পাতার পোস্ট। শেষ ছবিটা দেখে এতো ভালো লাগলো, এমন পথ ধরেই হয়তো মানুষের হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে অজানায়। তিনি অবশ্য ফিরছিলেন।

সেই দেখে আমারও সাধ হলো কিছু পাতা ঝরা ছবি সবার সাথে ভাগ করে নিতে। উত্তর গোলার্ধের সচলদের শরতাভিনন্দন।
বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ সচল অনুপম ত্রিবেদি, যার পোস্ট থেকে শেখা কিভাবে টোনম্যাপিং করতে হয়

এমন একটা বাড়ি বানাতে হবে অবসরজীবন যাপনের জন্য

অফিস থেকে বের হয়ে নীচে নামলেই একটা ব্রিজ। একদিন বের হয়ে পড়লাম ক্যামেরা হাতে

এই পথ দিয়ে নামতে হয়

কাঁচা পথ ধরে নদীর ধারে হেঁটে চলেছি

বৃষ্টি হওয়াতে একটু প্যাচপ্যাচে

একটু এগোলে দেখা যাবে অনেক পুরোনো একটা কাঠের সাঁকো

এটাকে পাওয়া ছিলো একটা আবিষ্কারের মত

সাঁকো থেকে দেখা নদী

সাঁকোর অন্যপাশে একটা মিনিয়েচার জলপ্রপাত। এখান থেকেই শোঁ শোঁ শব্দ পেয়েছিলাম প্রথমদিন

এর পর পথ কেবলই ওপরে উঠে গেছে

আর নদীটা নেমে গেছে ধাপে ধাপে

ওপরে উঠতে উঠতে পেছন ফিরে একটা ছবি তুলে নিলাম

পথ অফুরান

কাঁচার রাজত্ব শেষ, এবার পীচ ঢালা পথ।

খুব বেশি চিন্তা ভারাক্রান্ত থাকলে লাঞ্চ বক্স নিয়ে বনে চলে আসি, এই বেঞ্চিটায় বসে খাই দাই।

ফিরি অন্যদিক দিয়ে

বাঁকগুলো ঘুরে ঘুরে যেতে ভালো লাগে ভীষণ

একসময় আবার ব্রিজটার কাছে চলে আসি

এখান থেকে চোখ তুলে তাকালে গাছপালার ফাঁকে অফিস ভবনটা চোখে পড়ে, আবার ফিরতে হবে কাজের যাঁতাকলে

এই স্বপ্নসেতুর ওপারেই যাবজ্জীবন একঘেয়েমি

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।