আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্ফুলিঙ্গ (পাকিস্তানীদের চোখে একাত্তর)



একাত্তরে বাংলাদেশের মাটিতে পশ্চিম পাকিস্তানের পরাজয়ের পর কিছু পাকিস্তানী অফিসার দেশে ফিরে গিয়ে যুদ্ধের স্মৃতিকথা লেখেন। কেউ কেউ নির্মোহ ভাবে সত্যটিকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন আবার কেউ গা-বাঁচিয়ে লিখেছেন। দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপানোর প্রবণতাও লক্ষ্যণীয়। এসবকিছুর মাঝেই একাত্তর নিয়ে অনেক অজানা কাহিনী উঠে এসেছে। পাকিস্তানি জেনারেল/অফিসারদের লেখা বইগুলো থেকে সেই ইতিহাসের চুম্বক অংশগুলো আমি এ লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

একটি কথা না বললেই নয় যে, আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে গুটি কয়েক মানুষ বিকৃত করার চেষ্টা করে আসছে। নানা রকম শেখানো বুলি ও ছলচাতুরী ব্যবহার করে তৎকালীন দেশদ্রোহীদের কাপুরুষতাকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এবং দুঃখজনকভাবেই তা করা হয় ইসলামের নামে। ধর্মকে ব্যক্তিস্বার্থে বা গোষ্ঠীস্বার্থে ব্যবহারের জন্য করা হয় জঘন্য মিথ্যাচার। যে মিথ্যার মুখোমুখি আমাকেও হতে হয়েছিল।

কিন্তু মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যই হচ্ছে একমাত্র অস্ত্র। যা পাকিস্তানি জেনারেলদের লেখায় উঠে এসেছে। এখানে আমি সেই সত্যই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ১৯৭১সালে বাংলাদেশ ও ভারতের নিকট পশ্চিম পাকিস্তানের করুণ পরাজয়ের পর এর কারন নির্ণয়ের জন্য প্রেসিডেন্ট ভুট্টো ১৯৭১ সালের ২৬ডিসেম্বর তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেন যার প্রধান ছিলেন বিচারপতি হামুদুর রহমান। এই কমিশনের রিপোর্টকে হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট নামে অভিহিত করা হয় যেখানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে দায়িত্বপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের জবানবন্দি রয়েছে।

রিপোর্টটি পারভেজ মোশাররফ সরকার ৩০ডিসেম্বর ২০০০সালে স্পর্শকাতর অংশগুলো বাদ দিয়ে প্রকাশ করে। যা দিব্য প্রকাশ ২০০১ সালে “একাত্তরের গণহত্যা হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট” নামে প্রকাশ করে। বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন বশীর আলহেলাল। আমি এখানে রেফারেন্স হিসেবে ‘২য় মুদ্রন মে ২০০৯’ ব্যবহার করেছি। ১৯৭০ এর প্রথম দিকে রাজনৈতিক তৎপরতার উপর থেকে বাঁধা তুলে নেওয়া হল।

রাজনৈতিক প্লাবনের ধারা যা দীর্ঘ্যকাল অবরুদ্ধ ছিল, দ্রুত ছাপিয়ে উঠলো। এই জোয়ারের শুরুতেই শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি জনসমর্থন প্রমাণ হয়ে গেল এবং সময় পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হতে লাগলো যে, আওয়ামী লীগের জাদুকরী শক্তির অধিকারী ওই নেতা ও ৬-দফা কর্মসূচি সম্পর্কে জনমনে বিরাট সমর্থন রয়েছে। এডমিরাল আহসান –এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-১৯ (এগ-হারকরি- একাত্তরের গণহত্যা-হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট) কিছু লোক চাইছিল ক্রমবর্ধমান বাঙ্গালী জাতি-পূজাকে পশ্চিম পাকিস্তান শক্ত হাতে ঠেকাক। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে তারা উপনিবেশের লোক বলে মনে করতো। এডমিরাল আহসান –এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-২১ (৭০এর ঘূর্ণিঝড়ের পর) ইয়াহিয়া ঢাকায় অল্প সময় থাকেন এবং ঘূর্ণিঝড়ে দুর্গত এলাকাগুলোর পরিমাপ নেওয়ার পর নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত করেন, শেখ মুজিব ও অন্য নেতারা যতো বলেন ততো ক্ষতি হয়নি।

তিনি তাড়াহুড়ো করে ইসলামাবাদ চলে যান। তারপর হেলিকপ্টার পাঠাতে অনাবশ্যক দেরি করা হয়। সাহায্যের কাজের জন্য ওগুলোর জলদি দরকার ছিল। কিন্তু তার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে কেন্দ্রের বৈষম্যমূলক ব্যবহার তিনি স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন। যখন পূর্ব কমান্ডের কমান্ডার জেনারেল ইয়াকুবের কাছে আমি ত্রাণকার্যের জন্য সেনাবাহিনীর সেবা প্রদানের কথা বললাম, তিনি জবাব দিলেন, তার কাছে ফালতু খরচ নেই।

এডমিরাল আহসান –এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-২১ ১৯৭১এর ২২ফেব্রুয়ারির দিকে আমাকে গভর্নর আর সামরিক আইন প্রশাসকদের সম্মেলনে অংশগ্রহনের জন্য ডাকা হল। রাওয়ালপিন্ডিতে পৌছালে আমি ভারি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। সামরিক তৎপরতা শুরু হয়েছে দেখা গেল। মন্ত্রিপরিষদ বাতিল হয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি বিমান সার্ভিস বন্ধ হয়েছে, জলপথে সরঞ্জাম যাচ্ছে।

পিন্ডিতে ‘পরিকল্পনা মোতাবেক সামরিক সমাধানের’ খোলাখুলি কথাবার্তা হচ্ছে। এডমিরাল আহসান –এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-২৬ বস্তুত, চক্ষুষ্মান যে কোনো ব্যক্তিই সহজে দেখতে পাচ্ছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমানই এই ব্যাপারের শেষ বাঙ্গালী যাঁর সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান কথা বলতে পারতো ও কোনো একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে পারতো। বাংলার নৌজোয়ান যারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কালে বয়সে খুব ছোট ছিল তারা বড়ই হয়ে উঠেছিল ঘৃণা আর অপমানের মধ্যে। অবশিষ্ট দেশের প্রতি তাদের কোনো ভালবাসা ও সৌহার্দ্য ছিল না। এডমিরাল আহসান –এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-২৬ (১৯৭১, ২৫ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ফেব্রুয়ারির ভেতর শেখ মুজিবকে এডমিরাল আহসান) আমি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলাম যে, কেবল তিনিই রয়েছেন যিনি এখোনো পাকিস্তানকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন।

শেখ মুজিব বিচলিত, হতবুদ্ধি হয়ে থাকলেন কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যে নিজেকে সামলে নিলেন। তিনি আমাকে বললেন, তিনি ধমককে ডরান না, আর বাংলার জনগনকে তিনি ধোঁকা দেবেন না। এডমিরাল আহসান –এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-২৭ (এডমিরাল আহসান – ১সেপ্টেম্বর ১৯৬৯সালে পুর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন এবং ১মার্চ ১৯৭১পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন) বিচারপতি হামুদুর রহমানকে জেনারেল নিয়াজি একটি চিঠি লিখেছিলেন তাতে নিয়াজি জেনারেল টিক্কা খানকে বেলুচিস্তানের কসাই এবং পূর্ব পাকিস্তানের কসাই বলে উল্লেখ করেন। (উল্লেখ্য যে, ১৯৭১সালের ২৫মার্চের কালরাত্রের অপারেশনের সময় জেনারেল টিক্কা খান ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের কমান্ডার ও গভর্নর) এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-৩০ (জেনারেল টিক্কা খান হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট প্রসঙ্গে) আমি এই রিপোর্ট প্রকাশের দাবি করবো না, কিন্তু রাজনীতিবিদদের এ দাবি করা উচিত, যাতে জাতি জানতে পারে আসলে হয়েছিল কী? চিফ অব আর্মি স্টাফের ক্ষমতা বলে আমি রিপোর্ট প্রকাশের অনুমতি দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে জেনারেল জিয়াউল হক সেনাবাহিনীকে খুশি রাখার নীতি অনুযায়ী রিপোর্ট হিমাগারে নিক্ষেপ করেন।

এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-২৬ ১০ডিসেম্বর সূর্যাস্তের সময় আমাকে ঢাকার কমান্ডার মেজর জেনারেল জমশেদ ধানমন্ডির পিলখানায় তার সদর দপ্তরে আসতে বললেন। তার কমান্ড পোস্টের কাছে পৌছে আমি দেখি সেখানে অনেক গাড়ি। তিনি তার মোর্চা থেকে বেরোচ্ছিলেন। তিনি আমাকে তার কারে যেতে বললেন। কয়েক মিনিট পরে জানতে চাইলাম, এতো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে কেনো? বললেন, ‘এই ব্যাপারে কথা বলতেই আমরা নিয়াজির কাছে যাচ্ছি’।

তখনো কোর হেড কোয়ার্টার্সের রাস্তায়ই আমরা আছি, উনি আমাকে বললেন, তিনি বহুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী ও অন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করার আদেশ পেয়েছেন। বললাম, ‘কেনো, কিসের জন্য? এখন ওই কাজ করার সময় নয়’। আমরা যখন নিয়াজির দপ্তরে গিয়ে পৌছলাম, জমশেদ ওই কথা ওঠালেন। নিয়াজি আমার মত জানতে চাইলে বললাম, ‘এখন সময় নয়। আপনি আগে যাদের গ্রেপ্তার করেছিলেন আপনাকে তাদের হিসাব দিতে হবে।

দয়া করে এর বেশি গ্রেপ্তার করবেন না’। উনি মেনে নিলেন। আমার সন্দেহ, প্রথম আদেশ বাতিল করার আদেশ জারি করা হয়নি, তাই কিছু লোক গ্রেপ্তার করা হয়। আমি আজ পর্যন্ত জানি না তাদের কোথায় রাখা হয়েছিল। সম্ভবত তাদের এমন এলাকায় রাখা হয়েছিল যার হেফাজত মুজাহিদরা করছিল।

(এখানে মুজাহিদ বলতে রাজাকারদের বোঝানো হয়েছে) মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী-এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-৪২ (ভারতে বন্দী থাকা অবস্থায়) ভারতীয় বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার লাজলি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমার কাছে এলেন। তার প্রথম প্রশ্নঃ আপনার বিরুদ্ধে ১৬-১৭ ডিসেম্বরের মধ্যরাতে দুশ বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে, এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী? বললাম, জেনারেল নিয়াজি সিঁড়ির উপর বসে রয়েছেন, গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করুন ১০ডিসেম্বর আমি ওইসব ব্যক্তির গ্রেপ্তারির বিরোধিতা করেছিলাম কিনা। যদি আমি তাদের গ্রেপ্তারিরই বিরোধিতা করে থাকি তাহলে তাদের হত্যা করার আদেশ কেনো দেব? মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী-এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-৪৩ (উল্লেখ্য যে, এই সেই মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী যাকে ১৯৭১ সালের ১৪ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যার রূপকার বলে ধরা হয় এবং তিনি ছিলেন ২৫মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের অন্যতম প্ল্যানমেকার) যদি পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার কারনসমূহের অনুসন্ধান করতে হয় তাহলে লাহোর প্রস্তাব থেকে তা করতে হবে। বিস্তৃত বিবরণ দিতে গেলে, বারবার বলতে হবে, ইয়াহিয়া যখন ক্ষমতা পেলেন তখন বাঙ্গালীর জাতীয়তার চেতনা ফুলে-ফলে পূর্ণ বিকশিত হয়ে গেছে। তাদের রাজনৈতিক অধিকার ও আশা-আকাঙ্ক্ষা অগ্রাহ্য হওয়ার পরিণামে তাদের হতাশার বোধ বেড়ে গিয়ে তা প্রাদেশিক স্বশাসন ও শেষ পর্যন্ত ৬দফার রূপ লাভ করে।

বাঙ্গালীরা পুরাদস্তুর আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। অতএব, ঘটনাস্থলে আমার পৌঁছানোর আগেই বিচ্ছিন্নতার তৎপরতা শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং নিছক এক স্টাফ অফিসাররূপে আমার হাতে কোনো ক্ষমতা ছিল না। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী-এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-৪৫ আমাদের মুজিবকে ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত ছিল। কেননা তিনি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী-এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-৪৬ আমাদের পরাজয় ও পরিণামস্বরূপ অস্ত্রসমর্পণের একটি বড় কারন পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে প্রায় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ও সামরিক ব্যক্তিদের ক্রমান্বয়ী শত্রুতা।

বছরের পর বছর আমাদের অসামরিক ও সামরিক প্রশাসনের দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের যে করূণ অবস্থার সৃষ্টি করে রাখা হয়েছিল, প্রাথমিকভাবে এ শত্রুতা ছিল তারই পরিণাম। লে. জেনারেল(অবঃ) এরশাদ আহমদ খান-এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-৬৩ কমিশনের মতে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা ২৫মার্চ খারাপ হয়ে যায়, যখন ইয়াহিয়া খান সেখানে মানুষের বিরুদ্ধে সামরিক তৎপরতা শুরু করেন। এক ব্রিটিশ সাংবাদিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী হলে দেখা ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছেনঃ ৩টা সোয়া ৩টার দিকে ৩৫০থেকে ৪০০ পাকিস্তানি মিলিটারি ওখানে হামলা করে। তারা এক এক করে তাদের কাপড় খুলে নেয়। আতঙ্কে তাদের মুখ থেকে চিৎকার বের হচ্ছিল।

শাড়ি, সালোয়ার আর ব্রা টেনে টেনে এক দিকে ফেলে দেওয়া হল। মেয়েদেরকে তাদের স্তন ধরে দাঁড় করানো হল এবং ছড়ি দিয়ে পেটানো হল। বৃহৎ সংখ্যক সামরিক ও অসামরিক অফিসার যারা কমিশনের সামনে হাজির হয়েছিলেন তারা সেই ভয়াবহ দিনগুলোর বিবরণ দিয়েছেন। ওই সময়ের ঢাকার অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার মোহাম্মদ আশরফ বলেন, ‘সামরিক তৎপরতার পর বাঙ্গালীদেরকে নিজ বাসভূমে পরবাসী করে দেওয়া হয়েছিল’। ব্রিগেডিয়ার ইকবালুর রহমান শরিফ কমিশনকে বলেন, সামরিক ইউনিট গুলোর পরিক্রমাকালে তিনি দেখেছেন, জেনারেল গুল হাসান সৈন্যদের বলতেনঃ ‘তোমরা কতজন বাঙ্গালী কতল করেছ?’ আর এক সাক্ষ্য অনুযায়ী, যেদিন লে.জেনারেল এ.এ.কে.নিয়াজি পূর্ব পাকিস্তানে বাহিনীগুলোর কমান্ড লাভ করেন, তিনি তার লোকদের বলেনঃ ‘এ শত্রুর এলাকা।

যা কিছু হাতের কাছে পাও নিয়ে নাও। আমরা বার্মায় তাই করতাম’। বাঙ্গালী, তা সৈন্য হোক বা সাধারণ নাগরিক, হিন্দু হোক বা মুসলমান, তাকে শত্রু মনে করা হত। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ও জওয়ানদের বৃহৎ সংখ্যায় মেরে ফেলা হয়। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের গণহত্যার বিবরণ দিতে গিয়ে এক সাক্ষী, ৯ডিভিশনের জিএসও লে.কর্নেল মনসুরুল হক বলেনঃ সিও লে.কর্নেল ইয়াকুব মালিকের হুকুমে এক অফিসারের মাত্র আঙ্গুলের ইশারায় ১৭জন অফিসার ও ৯১৫জন জওয়ান খতম করে দেওয়া হয়।

১৬ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ, ৯ডিভিশনের জিওসি মে. জেনারেল এ.এইচ আনসারী এবং ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকের সিদ্দিকী প্রকাশ করেন যে, সাতজন সিনিয়র অফিসার ও তাদের ইউনিটগুলো ব্যাপকভাবে লুটপাট করে। তার মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের সিরাজগঞ্জ ট্রেজারি থেকে এক কোটি পয়ত্রিশ লাখ টাকার চুরিও রয়েছে। ওই অফিসারদের মধ্যে ছিলেন ব্রি.জাহানজেব আরবাব, লে.কর্নেল মোজাফফর আলী খান জাহেদ, লে. কর্নেল বশারত আহমদ, লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজ, লে.কর্নেল মোহাম্মদ তোফায়েল ও মেজর মোহাম্মদ হোসেন শাহ্‌। কমিশনের রিপোর্ট-এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-৬৫-৬৬ কমিশনের সিদ্ধান্তে লেখা হয়েছিলঃ ‘সামরিক কমান্ডারগণ মিলিটারি নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। সামরিক আইনের অধীন নিছক প্রথাগতভাবে চলে আসা প্রশাসনের দরুন এই কমান্ডাররা প্রকৃতিগতভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত অ পেশাগতভাবে অযগ্য হয়ে পড়েছিলেন।

তাদের ইচ্ছার অভাব ছিল আর সংকল্পের ত্রুটি ছিল। তারা যুদ্ধ করার যোগ্য ছিলেন না’। কমিশনের রিপোর্ট-এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-৬৬ পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি বাহিনী যে জুলুম ও অত্যাচার চালিয়েছে তার তদন্ত করার জন্য একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন আদালত বা তদন্ত কমিশন গঠন করা দরকার এবং যেসব ব্যক্তি পাশবিক অত্যাচার ও নির্যাতন এবং নৈতিক অপরাধে অপরাধী প্রমানিত হবেন তাদের যথাবিধি শাস্তি দেওয়া যায়। কমিশন রিপোর্টের সুপারিশ-এগ-হারকরি-পৃষ্ঠা-৬৮ ‘উইটনেস্ টু সারেন্ডার’ সিদ্দিক সালিকের লেখা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি অনন্য গ্রন্থ। মেজর সিদ্দিক সালিক ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োগ প্রাপ্ত কমান্ডারদের জনসংযোগ অফিসার।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করার পূর্বে তিনি ছিলেন লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী সাহিত্যের প্রভাষক। পরবর্তিতে তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হন এবং সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হকের প্রেস সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। ১৯৮৮সালের ১৭আগস্ট প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিমান মধ্য আকাশে ধ্বংস হলে প্রেসিডেন্ট ও তার সফরসঙ্গীদের সাথে তিনিও প্রাণ হারান। উইটনেস্ টু সারেন্ডার বাংলায় অনুবাদ করেছেন মাসুদুল হক ‘নিয়াজির আত্মসমর্পনের দলিল’ নামে যা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৮সালে। আমি এখানে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ কতৃক মুদ্রিত ফেব্রুয়ারি ২০০৭ এর সংস্করণটি ব্যবহার করেছি।

(পাকিস্তান থেকে তেজগাও বিমানবন্দরে নামার পর) অবশেষে সামরিক বাহিনীর একটি গাড়ি আমাকে পৌছে দিতে চাইলো। গাড়ির পাশ দিয়ে এক বাঙ্গালী কিশোর হেঁটে যাচ্ছিল। তাকে ড্রাইভার আদেশ করলো আমার সুটকেস জিপে তুলে দিতে। ছিন্নবস্ত্র পরিহিত কিশোরটি ড্রাইভারের আদেশ হৃষ্টচিত্তে নিল না, বরং ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তার প্রভুর দিকে তাকালো এবং আদেশ পালন করলো। তার সাদা চোখের মণি আমার দিকে ঘুরলো।

শরীরের কালো রঙের ভেতর সাদা মণির দৃষ্টিকে দারুণ মর্মভেদি মনে হল। আমি তাকে পয়সা দিতে গেলে ড্রাইভার আর্তচিৎকার করে উঠল, ‘করছেন কী? এই হারামজাদাদের আর নষ্ট করবেন না’। উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-১৪ (ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিতে যাওয়ার পথে) যাওয়ার পথে বাস্তবতার নতুন যাত্রা আমার মানসপটে প্রতিভাত হয়ে উঠল। এমন ধরনের দারিদ্র্যের দৃশ্য নজরে এলো-যা কাজের খোঁজে আসা আয়াদের ভিড় জমানোর কারনটা আমার কাছে সহজবোধ্য করে তুললো। মেয়েরা তালি দেওয়া ময়লা এক চিলতে কাপড় জড়িয়ে আব্রু ঢাকার চেষ্টা করছে।

পুরুষ হ্রস্ব শরীরের এবং ক্ষুধার্ত। চলন্ত গাড়িতে বসেও তাদের বুকের কালো চামড়ার পাতলা স্তরে ঢাকা হাড় গোনা যায়। আমি সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, বাংলার দরিদ্ররা পশ্চিম পাকিস্তানের দরিদ্রদের থেকেও দরিদ্রতর। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর অর্থনৈতিক শোষণ সম্পর্কিত অভিযোগের অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার হতে শুরু করল। নিজেকে অপরাধী মনে হল।

উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-১৫ বাঙ্গালীদের সঙ্গে প্রাথমিক যোগাযোগের পর আমার ধারণা হল, পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে মানসিক ক্ষেত্রে পুরোপুরি বিচ্ছেদ ঘটে গেছে। জোড়া কী আর লাগবে? অথবা দু অংশের বন্ধন কী পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে? উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-২০ (লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব সামরিক আইনের দন্তহীনতা সম্পর্কে) পাকিস্তানের জনগণের কাছে সামরিক আইন একটি ভীতির প্রতিমূর্তি। কিন্তু তারা এও ভুলে গেছে যে, এই সামরিক সরকার দেশকে গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যাচ্ছে। মূলত সামরিক আইন এবং গণতন্ত্রের সম্পর্ক বৈরিতামূলক। সামরিক আইনের ঐতিহ্যগত ধারা গণতন্ত্রের অঙ্কুরোদগমন করতে দেয় না।

লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব - উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৩৩ (৭০এর নির্বাচনের পর) বস্তুত নির্বাচনের আগের দিনই আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে গেল। ৭ডিসেম্বর মুজিবুর রহমানের প্রকৃ্ত বিজয়কে শুধু আনুষ্ঠানিকতার মালা পরানো হলো। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিজয়ী হবে – অনেকেই নভেম্বরের শেষাশেষি থেকে তাদের এই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে থাকে। উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৩৪ (নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণ করলে নিজের ভাগ্যে কী ঘটবে তা নিয়ে অনেক সরকারি কর্মকর্তার মাঝে ভীতির সঞ্চার হয়েছিল বিশেষ করে পাকিস্তানপন্থীদের মাঝে) সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের একজন সিনিয়র অফিসারের কথা মনে পরলো। তিনি বলেছিলেন, ‘ক্ষমতায় যাওয়ার পর শেখ সাহেব যদি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সমস্ত কাগজপত্র চেয়ে পাঠান তাহলে নিশ্চয়ই বেশ কয়েক জায়গায় আমার নাম দেখতে পাবেন।

এবং ভুলে যাওয়া ও ক্ষমা করার মত উদার মুজিব নন’। সামরিক বাহিনীর যেসব অফিসার তাদের চাকরি জীবনে কখনোই মুজিবকে অসন্তুষ্ট করেননি, তারা ছয় দফার পক্ষে উচ্চকণ্ঠে প্রচারাভিযানে নেমে পড়লেন। আওয়ামী লীগের কর্মসূচির গুণাগুণ নির্ণয়ের ব্যাপারে বক্তব্য রাখাকালে তারা একে অপরকে ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলেন। উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৩৪ (৭০এর নির্বাচনের পর ডিসেম্বরের শেষ দিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আস্থাভাজন এক জেনারেল ঢাকায় আসেন এবং গভর্নমেন্ট হাউজে নিচের মন্তব্যটি করেন) গভর্নমেন্ট হাউজে সুস্বাদু ভোজ পর্ব সমাধার পর ঘরোয়া পর্যায়ে আলাপচারিতাকালে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘চিন্তা করো না.... আমাদের ওপর শাসন চালাতে এই কালো জারজদের সুযোগ দেব না’। উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৩৮ নির্বাচনোত্তর পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের এই মোকাবেলা ঢাকায় আমাদের কাছে নতুন ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো।

যে সমস্ত জুনিয়র অফিসার রাজনৈতিক জটিল সমস্যাবলি নিয়ে কদাচিৎ মাথা ঘামায়, তাদের ওপর এর কী প্রভাব পরবে, তা বুঝতে পারি। যারা ভুট্টোকে তাদের আশা-আকাংক্ষার পক্ষে সর্বজয়ী বীর মনে করলো তারা বললো, কিভাবে একটি প্রদেশ সারা দেশ শাসন করতে পারে? অন্যরা যাদের মনে স্থানীয় অবস্থার প্রতি খাঁটি দরদ রয়েছে – তারা বললো, ‘তেইশ বছর ধরে আমরা তাদের(বাঙ্গালীদের) ওপর আধিপত্য করেছি। এখন তাদের সময়। সব সময় তাদের ঠকানো উচিৎ নয়’। উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৩৮ ঢাকা সমাবেশের পর দিনই ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের তেইশতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী দিবস।

মনে হলো লক্ষ্য অর্জনে মুজিব থেকে ছাত্ররাই অধিকতর অধৈর্য হয়ে উঠেছে। তারা তার উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করলো তাদের ইচ্ছার কাছে তাকে আত্মসমর্পন করতে। কিন্তু তিনি ধৈর্য ধারণের পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘যদি প্রয়োজন পরে তাহলে আমি বিপ্লবের ডাক দেব। ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের অপেক্ষা করতে হবে’। উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৪১ (২মার্চ রাতে সেনাবাহিনীর গুলিতে ৬জন নিহত হয়) পরদিন তারা(আওয়ামী লীগ) মৃতদেহগুলো নিয়ে শহরের প্রধান প্রধান রাস্তায় মিছিল করলো।

এরপর মুজিব মৃতদেহগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে একজন বাগ্মী হিসেবে নিজের শ্রেষ্ঠতম প্রতিভার পরিচয় দিলেন। তার আগুনঝরা বক্তৃতা মিছিলে এমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলো যে, তারা তার জন্য জীবন বাজি রেখে যে কোন ধরণের ভয়াবহ কাজে তাৎক্ষনিক ভাবে নেমে যেতে পারে। উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৫৪ (৬মার্চ ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের জন্য একটি বার্তা পাঠান যাতে ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে অনুরোধ করেন দ্রুত কোন সিদ্ধান্ত না নেওয়ার জন্য। বার্তাটি একজন ব্রিগেডিয়ার ধনামন্ডিতে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসেন) একজন ব্রিগেডিয়ার নিজে ধানমন্ডির বাসভবনে গিয়ে মুজিবের হাতে বার্তাটি পৌঁছে দিয়ে এলেন। ফিরে এসে তিনি মুজিবের আতিথেয়তা ভদ্র আচরণ, বাসভবনের সামনে দাঁড়ানো ডজন ডজন গাড়ি, শত শত মানুষ ইত্যাদি সম্পর্কে অনর্গল বলে যেতে থাকেন।

বলেন, ‘বাড়ির চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলো যেন কোন উৎসবের রৌদ্রে অবগাহন কড়ছে’। উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৫৯ (৭মার্চ) সেই চরম সন্ধিক্ষণ এসে গেল। মুজিবের ভাষণ দেবার কথা ছিল ২টা ৩০মিনিটে(স্থানীয় সময়)। রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র মুজিবের ভাষণ নিজ উদ্যোগে সরাসরি প্রচারের ব্যবস্থা সম্পন্ন করে। রেডিওর ঘোষকরা আগে থেকেই রেসকোর্স থেকে ইস্পাত দৃঢ় লক্ষ দর্শকের নজিরবিহীন উদ্দীপনার কথা প্রচার করতে শুরু করে।

এ ব্যপারে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দফতর হস্তক্ষেপ করল এবং এই বাজে ব্যপারটি বন্ধ করার নির্দেশ দিল। আমি বেতার কেন্দ্রে আদেশটি জানিয়ে দিলাম। আদেশটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোনের অপর প্রান্তের বাঙ্গালী বন্ধুটি তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। বললেন, ‘আমরা যদি সাড়ে সাত কোটি জনগণের কন্ঠকে প্রচার করতে না পারি তাহলে আমরা কাজই করবো না’। এই কথার সাথে সাথে বেতার কেন্দ্র নীরব হয়ে গেল।

(এরপর সারাদিন বেতার নীরব ছিল, পরদিন সকাল ৮টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ প্রচারের মধ্যদিয়ে বেতার কেন্দ্র আবার চালু হয়) উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৬০ (লে. জেনারেল টিক্কা খান ৭মার্চ ঢাকায় আসেন এবং তিনি একাধারে গভর্নর, সামরিক আইন প্রশাসক ও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন) মুজিবুর রহমান তখনও প্রদেশ চালিয়ে যাচ্ছেন। আর জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে শপথ নেবার জন্য কোনো বিচারপতি খুঁজে পেলেন না। ‘অসুস্থ শরীরের কারণে’ পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মি. জাস্টিস সিদ্দিকী শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনায় অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেন। মূলত তিনি প্রদেশের ডি ফ্যাক্টো শাসক আওয়ামী লীগকে ক্ষুদ্ধ করতে চাইলেন না। উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৬২ ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ তার শাসনকে সংহত করার জন্য একের পর এক নির্দেশ (মোট সংখ্যা ৩১) জারি করে চললো।

এইসব নির্দেশাবলি সমাজের সর্বস্তরে তথা সরকারের সব বিভাগ, কলকারখানা, রাষ্ট্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বাঁকি সব প্রতিষ্ঠানই মেনে চললো। এমনকি সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন রেডিও এবং টিভিও মুজিবের আদেশ অনুসারে চলতে থাকে। উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৬২ তিনি(শেখ মুজিব) সেনাবাহিনীকে রেল ও সড়কে প্রবেশ করতে না দিতে জনগণের প্রতি আহবান জানালেন। স্থানীয় ঠিকাদাররা সরবরাহ বন্ধ করে দিল। ফলে খাদ্যের জন্য অফিসার ও জোয়ানরা মজুদ শুকনো রেশনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পরে।

তবু তারা আদেশ মেনে চললো। উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৬২ (১৫মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আলোচনার উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসেন) ব্রিফিং শেষে প্রেসিডেন্ট বললেন, ‘ভাবনার কিছুই নেই। মুজিবের ব্যবস্থা কালকেই করছি আমি। তাকে আমার মনের ইচ্ছা একটুখানি জাণীয়ে দেব। শীতল চেহারা দেখাবো এবং তাকে দ্বিপ্রাহরিক ভোজেও আমন্ত্রণ জানাবো না।

এরপর পরদিন আমি তার সাথে দেখা করবো এবং এতে তার মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হয়, সেটা দেখবো। যদি তিনি ভদ্র আচরণ না করেন, তাহলে আমি জবাবটা জানিয়ে দেব’। একটি নিস্তব্ধতা নেমে এলো। একটি অস্বস্তিকর মুহূর্ত। এই সময় দীর্ঘকায় ঋজু দেহের পেশীবহুল এক ব্যক্তি গর্বোন্নত স্কন্ধদেশ সোজা করে দাঁড়ালেন।

এবং কিছু বলার জন্য অনুমতি চাইলেন। মাথা নেড়ে তাকে অনুমতি দেয়া হল। তিনি মুখ খুললেন, ‘স্যার অবস্থা খুবই নাজুক। অপরিহার্যভাবে এটা একটি রাজনৈতিক ব্যাপার এবং রাজনৈতিকভাবেই এর সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। নইলে হাজার হাজার নিরপরাধ নারী, পুরুষ ও শিশু নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে’।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনছিলেন এবং অন্যরা শুনছিলেন দুরু দুরু বক্ষে। প্রেসিডেন্ট মাথা নাড়লেন। যেন চাবুক দিয়ে আঘাত করলেন, এমনি স্বরে বললেন, ‘মিঠঠি, আমি জানি সেটা ...আমি জানি’। মিঠঠি বসে পরলেন। (কয়েকদিন পর তার দায়িত্ব থেকে তাকে নীরবে অব্যাহতি দেওয়া হল।

পরবর্তী সময়ে তিনি শুধু নিজের মনোবলের উপরই টিকে ছিলেন। ) উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৬৬-৬৭ (মিঠঠি-তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল মেজর জেনারেল এ ও মিঠঠি) মূলত পূর্ববর্তী মাসের প্রথম পনের দিনেই সমঝোতামূলক সমাধানের সাধারণ ভিত্তি বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই সময়টিতে মুজিব শক্ত হাতে প্রদেশটি শাসন করলেন। বেসামরিক প্রশাসন ও জনগণের ওপর তার নিরঙ্কুশ আধিপত্য ছিল। তার এই ডি ফ্যাকটো নিয়ন্ত্রণের পেছনে সমর্থন জুগিয়েছিল গত নির্বাচনে জনগণের দেয়া শক্তিশালী ম্যান্ডেট।

কেন তা হলে মুজিব স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ভাগাভাগি করবেন? তিনি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত একজন অতিথির জন্য কিছুটা জায়গা ছেড়ে দিতে পারেন –যদি ওই অতিথিটি তার খসড়া শাসনতন্ত্র অনুমোদনে পালটা সাড়া দেন। উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৬৭ ওই বৈঠকেই জেনারেল ফরমান হালকা নীল কাগজের অফিসিয়াল প্যাডের ওপর একটি সাধারণ কাঠ পেন্সিল দিয়ে নতুন পরিকল্পনাটি লিপিবদ্ধ করেন। আমি জেনারেল ফরমানের নির্দোষ হাতের মূল পরিকল্পনাটি দেখেছিলাম। পরিকল্পনার দ্বিতীয় অংশটি লেখেন জেনারেল খাদিম। তাতে প্রাপ্য সমর সম্ভারের বণ্টন ও বিভিন্ন ব্রিগেড ও ইউনিটের কাজ ভাগ করে দেয়া হয়েছিল।

১৬টি প্যারা সম্বলিত পাঁচ পৃষ্ঠাব্যাপি এই পরিকল্পনার নামকরণ করা হল অপারেশন সার্চ লাইট। উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৬৯ এইভাবে ২৩মার্চের সূর্য উদিত হল। তারিখটি ঐতিহাসিক পাকিস্তান দিবসের স্মৃতিবার্ষিকীর দিন। এই দিনে, ১৯৪০সালে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। আওয়ামী লীগ এই দিনটিকে ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করলো।

তারা পাকিস্তানের পতাকা পোড়ালো, কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়লো এবং তার কুশপুত্তলিকা দাহ করলো। অন্যদিকে তারা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ালো এবং শেখ মুজিব নিজেই এর অংশী ছিলেন। সকালে তিনি তার বাড়িতে একটি ছাত্র প্রতিনিধি দলকে অভ্যর্থনা জানান এবং তার বাড়ির ছাদে (ডি ফ্যাকটো প্রেসিডেন্ট ভবন) বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের অনুমতি দেন। বাড়ির সামনে দিয়ে মার্চপাস্ট করে এগিয়ে যাওয়া ছাত্রদের সালাম গ্রহণ করেন। সারা শহর ছেয়ে যায় গাঢ় মেরুন ও সোনালী রঙের পতাকায়।

পাকিস্তানের পতাকা তখন মাত্র দুইটি স্থানে দেখা গেল। একটি গভর্নমেন্ট হাউসে ও অন্যটি সামরিক আইন সদর দফতরে। কিছু চতুর ছেলে গভর্নমেন্ট হাউসের পশ্চিম প্রবেশ দ্বারে বাংলাদেশের একটি ছোট্ট পতাকা সেঁটে দিয়েছিল। কিন্তু সংযুক্ত পাকিস্তানের প্রতীক হয়ে তখনো প্রধান ভবনের শীর্ষে পাকিস্তানের পতাকা উড়ছিল। অবশ্য সেটাকে অত্যন্ত নিঃসঙ্গ দেখাচ্ছিল।

বাঙ্গালী যুবকরা ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানে নগরীর রাজপথ প্রকম্পিত করে তুললো। উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৭৩ (একাত্তরের ২৫মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অত্যন্ত গোপনে ঢাকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন, যদিও তা গোপন থাকেনি) লে.কর্নেল এ আর চৌধুরী ছিলেন ইয়াহিয়ার স্টাফদের একজন। তিনি দেখলেন প্রেসিডেন্টের মালামাল ডজ গাড়িতে করে বিমান বন্দরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মুজিবুর রহমানকে জানিয়ে দিলেন। সন্ধ্যে সাতটায় জেনারেল ইয়াহিয়া খান পিএএফ গেট দিয়ে বিমান বন্দরে ঢুকলেন বিমানে চড়ার জন্য।

উইং কমান্ডার খন্দকার তার অফিসে বসে এ দৃশ্যটি দেখলেন। সাথে সাথে মুজিবকে জানিয়ে দিলেন। পনের মিনিট পর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে একজন বিদেশী সাংবাদিক টেলিফোন করলেন আমাকে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘মেজর, প্রেসিডেন্ট চলে গেছেন, খবরটি কি সত্য?’ ইতিমধ্যে রাত্রি পা পা করে এগিয়ে এলো। কিন্তু কেউই তখনো জানতো না যে, এ রাত্রির শেষটা একটি অনাময় সকাল হয়ে আর আসবে না।

উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৭৫ (২৫মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট শুরুর আগমুহূর্তে) আকাশে তারার মেলা, শহর গভীর ঘুমে নিমগ্ন। বসন্তের ঢাকার রাত যেমন মনোরম হয়, তেমনই ছিল রাতটি। একমাত্র রক্তক্ষয়ী হত্যাযজ্ঞ ছাড়া অন্য সবকিছুর জন্যই পরিবেশটি ছিল মোহনীয়। উইটনেস্ টু সারেন্ডার-পৃষ্ঠা-৭৭ নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সামরিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। এখন আঘাত হানার নির্ধারিত মুহূর্তে (এইচ আওয়ার) প্রর্যন্ত স্থির থাকার চিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে গেল।

নরকের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল। যখন প্রথম গুলিটি বর্ষিত হল, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিওর সরকারি তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ওই কণ্ঠের বাণী মনে হল আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করলেন। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডকুমেন্টস’ এ ওই ঘোষণার পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল।

ঘোষণায় বলা হয়, ‘এই-ই হয়তো আপনাদের জন্য আমার শেষ বাণী হতে পারে। আজকে থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আহবান জানাচ্ছি – যে যেখানেই থাকুন, এবং হাতে যার যা আছে তা-ই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। ততদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে যতদিন না দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর শেষ সৈন্যটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত হচ্ছে এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হচ্ছে’। আমি রেডিওর ওই ঘোষণাটি শুনিনি।

শুধু শুনলাম, রকেট ল্যান্সারের গোলার প্রচণ্ড শব্দ। মুজিবের বাসভবন অভিমুখী রাস্তার প্রতিবন্ধক অপসারণ করছে কমান্ডোরা রকেট গোলা বর্ষণ করে। হামলাকারী প্লাটুনের সঙ্গে ছিলেন কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জেড এ খান ও কোম্পানি কমান্ডার মেজর বিল্লাল। কমান্ডোরা মুজিবের বাড়ির কাছাকাছি হলে গেটে অবস্থানরত সশস্ত্র পাহারাদারদের গুলির মুখে পড়লো তারা। পাহারাদারদের দ্রুত অকেজো করে ফেলা হল এবং মুহূর্তে পঞ্চাশজন শক্তিশালী সৈন্য দৌড়ে চার ফুট উঁচু বাড়ির দেয়াল লাফিয়ে উঠোনে নামলো।

স্টেনগানের ব্রাস্ট ফায়ার করে তারা তাদের উপস্থিতি জানান দিল এবং চিৎকার করে শেখ মুজিবকে বেরিয়ে আসার আহবান জানালো। কিন্তু কোনো সাড়া এলো না। তারপর দুপদাপ শব্দ তুলে হড়হুড়ি করে বারান্দায় উঠলো তারা। এরপর দোতলায়। অবশেষে মুজিবের শোবার ঘর খুঁজে বের করলো।

দরজা বাইরে থেকে তালা মারা ছিল। একটি বুলেট ঝুলন্ত ইস্পাত খণ্ডকে বিদীর্ণ করে। সঙ্গে সঙ্গ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।