আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাঁটা

ট্রেনটা মিস করে ফেললাম। পরের ট্রেন ঘণ্টা খানেক পরে। এদিকে ওয়েটিংরুমটা বড্ড নোংরা, ওটাতে বসার রুচি হচ্ছে না। আধঘণ্টা বাইরে পায়চারি করে তবু ওই আস্তাকুড়ের মধ্যে গিয়ে বসলাম। খানিক বাদে একটা রিনরিনে কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে চমকে গেলাম আমি।


-চিনতেই পারো নি, নাকি ভাণ করছ?
খুব চেনা স্বর। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেলাম ঝিল্লীর মুখ।
-থিয়েটার ছাড়ো নি বুঝি?
একই শহরে থেকেও কত বছর দেখা হয় নি, বা চেষ্টা করিনি দেখা করার আর আজকে এই অচেনা স্টেশনে দেখা হয়ে গেল। বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে পারছি না , এদিকে ঝিল্লির বাক্যবাণ চলছেই। বলে বসলাম
-তোমার স্মৃতিশক্তির পরীক্ষা নিচ্ছিলাম।

ফুলমার্কস পেয়েছ!
আড়চোখে দেখলাম ওর হাসি হাসি মুখটা কেমন নিভে গেছে। আমি এবার অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে ব্যাগ থেকে মাফলারটা বার করে গলায় জড়িয়ে নিলাম। ঝিল্লি একেবারে চুপ মেরে গেছে। এদিকে আমি উসখুস করছি। বললাম
-তারপর বলো কেমন আছো তোমরা?
-আমাদের খবর জানতে চাও? আমাদের খবর তো শহরের সবারই জানা...তুমি বুঝি জানো না? ভুলে গেছ হয়ত।

অবশ্য স্মৃতিশক্তির পরীক্ষায় তো তুমি বরাবরই ফেল!
এবার আমি ধরা পড়ে গেলাম। ঝিল্লির ডিভোর্সের খবরটা শুনেছি বেশ আগেই। তবু বিচ্ছিরি কৌতুহলটা চেপে রাখতে পারলাম না। এখন নিজের উপর রাগ হচ্ছে খুব। আমাকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে সেই পুরোনো ভঙ্গিতে মিটিমিটি হাসছে ঝিল্লি, ক্রূর হাসি।

বছর পাঁচেক আগে ওর বিয়ে আসরে আমাকে দেখে ঠিক এভাবেই কি হেসেছিল? কি জানি!
-একটু ওদিক থেকে ঘুরে আসি।
বলেই বাইরে চলে এলাম আমি। পকেট হাতড়ে সিগারেট বার করে ধরালাম।
(২)
প্রচণ্ড হৈ হুল্লোড় পুরো ঘর জুড়ে। মাথাটা দপদপ করছে আমার।

এই গেট টুগেদারের বুদ্ধিটা কেন যে মাথায় এসেছিল। তুলি প্রথমে রাজি হতে চায় নি, এতগুলো লোকের খাওয়াদাওয়ার আয়োজন বাসায় করতে গেলে হিমশিম খেতে হবে। ওর মেজাজ খারাপ দেখে আহ্লাদ করে আমি ওর বন্ধুদেরও আসতে বললাম, তাতেই রাজি হল।
তুলি দুদিন ধরে খুব খারাপ আচরন করছিল। বাঁকা কথা শোনাচ্ছিল কথায় কথায়।

বিকেলবেলা শব্দ করে চায়ের মগটা টেবিলে রেখে দিল। আর আমার ঘুমটা চটে গেল। ঘুম ভাঙতেই কেন যেন ঝিল্লির কথা মনে পড়ল আমার আর তড়াক করে বিছানা থেকে উঠে বসলাম। সেদিন স্টেশনে ঝিল্লির সাথে দেখা হওয়ার কথাটা বলেছিলাম তুলিকে। হ্যাঁ, তারপর থেকে ও এমন করছে! হঠাৎ কখনো ঝিল্লির প্রসঙ্গ এলে তুলি খুব গম্ভীর হয়ে যায়।

আমি নিজে থেকে ওর কথা বলিই না, মাঝেমাঝে খুব ঝগড়ার নেশায় পেলে তুলিই বরং ওর কথা বলে খুব সুখ পায়। পুরোনো কথাগুলো নিয়ে অশান্তি করে জানি না কী তৃপ্তি ও পায়!
এখন বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে তুলি। দিব্যি খোশমেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা ঘরে। হাসিমুখে আপ্যায়ন করছে অতিথিদের। বারবার আমার চোখ চলে যাচ্ছে সজলের দিকে।

তুলি কি ওর সাথে একটু বেশিই কথা বলছে? নাকি আমারই ভুল হচ্ছে। না , এইতো ছেলেটা আবার ওর পাশের সোফায় গিয়ে বসল। নিচু স্বরে কি যেন বলছে ওরা, তুলি খিলখিল করে হেসে উঠল। সজলের মুখটা বোকাবোকা দেখাচ্ছে। ছেলেটা কি আমার বৌয়ের প্রেমে পড়েছে নাকি? নাকি আগে থেকেই অমন গদগদ? ছেলেরা তো প্রেমে পড়লে বোকাটে হয়ে যায়।

আমিও হয়েছিলাম, ঝিল্লির প্রেমে। আর ঝিল্লি সেটা ঠিক বুঝতে পেরেছিল, অপেক্ষা করেছিল কবে আমি নিজে ওকে কথাটা বলব। কিন্তু আমার সে সাহস হয়ে ওঠে নি, ওর পাশে নিজেকে বড় বেমানান, নিষ্প্রভ মনে হত। তারপর একদিন সুপাত্রের লম্বা লাইন থেকে সেরা একজনকে বেছে নিয়ে গাঁটছড়া বেঁধে ফেলল ও।
-তুমি আরেকটা স্যান্ডউইচ নেবে?
তুলির ডাকে ওর দিকে তাকালাম।

মুখটা ঝলমল করছে। ওকে আজ এত সুন্দর দেখাচ্ছে! চোখ ভরে কাজল পরেছে, কপালে ছোট্ট টিপ, পরনে নীল রঙ্গের শাড়ি। ওর হাত ধরে বললাম
-একটু জিরিয়ে নাও তো, বসো আমার পাশে। তোমাকে টায়ার্ড দেখাচ্ছে।
-ছিঃ, হাত ছাড় তো, মোটেও টায়ার্ড না আমি’ বলেই আবার চলে গেল তুলি।


রাজিব, আমার স্কুলবেলার বন্ধু বলল
-শিশির, এবার চলি রে, অনেক রাত হল।
-আরেকটু বসে যা।
-এমন গেট টুগেদার প্রতিমাসে হলে বেশ ভালই হয়…কি বলিস? সামনের মাসে আমার বাসায় হলে কেমন হয়?
-হুম, ভাল।
আমার মাথায় অন্য একটা চিন্তা উঁকি দিচ্ছে। সজল ছেলেটা শুনলাম রাজিবদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে।


-কি হু হু করছিস? তাহলে ডেট ঠিক করে ফেলি?
এই রাজীবটা হচ্ছে আরেক আমুদে লোক, এখনই তার দিন তারিখ ঠিক করে ফেলা লাগবে, কোথাও ভুরিভোজ-হৈ হুল্লোড়ের হদিশ পেলেই ছুটে যায়।
-আমার সামনের মাসে অফিসের কাজে বাইরে যাওয়া লাগতে পারে, সম্ভব হবে না…
এসময় পাশের রুম থেকে তুলির বন্ধুরা বেড়িয়ে এল। একে একে বিদায় নিচ্ছে সবাই। বাসা খালি হতে হতে প্রায় এগারোটা বেজে গেল।
তুলি দ্রুত হাতে খাবারের প্লেটগুলো গুছাচ্ছে।

আমি সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে ওকে দেখছি। ঝিল্লির সাথে মেলাবার চেষ্টা করছি। না, তুলির সাথে প্রথমে দেখা হলে আমি ওর প্রেমেই পড়তাম, ঝিল্লির চেয়ে তুলি অনেক বেশি মায়াবি। এসব ভাবছি আর হঠাৎ মনে হল কথাটা। কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম কথাটা একটু কায়দা করে জিজ্ঞেস করতে হবে, নইলে তুলির মেজাজটা আবার বিগড়ে যাবে।


-আচ্ছা তুলি, তোমার ওই বন্ধুটা কি তোমার ডিপার্টমেন্টেই পড়ত?
-কার কথা বলছ?
-ওই যে রাজিবের প্রতিবেশি।
-ও সজল? ওকে চেন নি?
তুলি রান্নাঘর থেকে গলা উঁচু করে বলল
-সজলের কথা তোমাকে বলেছিলাম তো।
-কি বলেছিলে?
-প্রথমপ্রথম ও তো আমার সাথে কথা বলতেই ভয় পেত।
-কেন?
-প্রেমে পড়েছিল, তাই!
-তারপর?
-তারপর কদিন যেতে না যেতেই আমরা খুব বন্ধু হয়ে গেলাম।
-বন্ধু হয়ে গেলে? ও কিন্তু এখনও তোমার প্রেমেই পড়ে আছে।


তুলি শোবার ঘরে চলে গেছে। ভাগ্যিস শুনতে পায় নি কথাটা। ঝগড়ায় আর কাজ নেই। আমিও ওই ঘরের দিকে পা বাড়ালাম।


সোর্স: http://www.sachalayatan.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।