চোখের দেখা , মনের কল্পনাঃ আমার লেখা
“আগামী দুইমাসের ভেতর আমি নিজেকে পোড়া কয়লা বানিয়ে ছাড়বো। ” মরণ বলল জীবনকে।
ব্যাপার আর কিছুই না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মরণের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো নিত্যনৈমিত্তিক একটা দৃশ্য দেখে। মরণ দেখলো- জীবন বিছানায় তার পাশে বালিশে আধশোয়া অবস্থায় হেলান দিয়ে বসে ব্যানসন সিগারেট ফুঁকছে।
মধ্যমা আর তর্জনীর ফাঁকে সিগারেটটা ধরা আর বাকি তিনটা আঙুল শক্ত, টানটান, ফাঁকফাঁক হয়ে তিনদিকে দাঁড়িয়ে আছে।
আর সিগারেট ফুঁকার ধরনটাও স্বাভাবিক না। মানুষ আরামসে ধীরে-সুস্থে সিগারেট টানে। বাংলায় একটা শব্দ আছে- “ খিচ্চা”। জীবন খিচ্চা সিগারেট টানতেসে।
জোরেসোরে প্রতিটা টান। দুই আড়াই মিনিটের ভেতর সিগারেট শেষ করে আরেকটা ধরালো।
প্রথমে কিছুক্ষণ মরণ আধবোজা চোখে এটা সহ্য করলো। পরে হঠাৎই একটা কাজ করে বসলো। নতুন ধরানো জ্বলন্ত সিগারেটটা জীবনের মুখ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজের বাম হাতের কব্জির সামান্য উপরে ঠেশে ধরলো।
তার চিৎকার করতে ইচ্ছা হলো। সেই ইচ্ছাটা দমিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নাক দিয়ে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে লাগলো। চিৎকারগুলো নিশ্বাসের সাথে বের করার প্রয়াস।
আর তারসাথে চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পরতে লাগলো মরণের। চোখের ঘন পাতাগুলো সদ্য বৃষ্টিভেজা পাতার মত দেখাচ্ছে।
আর হাতে একটা গর্তের মত হয়ে গেছে।
মরণ ঘটনাটা একমিনিটের ভেতর ঘটালো। সময় একমিনিটের চেয়েও অনেক কম লেগেছে। কারণ জীবনের নাক মুখ দিয়ে এখনও ধোঁয়া বেরুচ্ছে আর সে হতভম্ভ হয়ে গেছে এই ঘটনায়।
মরণ অনেকবার, অনেকভাবে জীবনকে বাঁধা দিয়েছে, হুমকি দিয়েছে, বুঝিয়েছে যেন জীবন আর ধোঁয়া-টোয়া না খায়, হেরোইন না নেয়।
বেয়াড়া গরুর মতো জীবন প্রতিবারই মাথা ঝাঁকিয়ে মরণের সব আদেশ, অনুরোধ অগ্রাহ্য করেছে। তাই আজ কিছু না ভেবেই মরণ নিজেকে কষ্ট দিল জীবনকে শিক্ষা দেবার জন্য।
- “আরেকবার সিগারেট মুখে নিলে আমি আমার পুরা শরীর জ্বলন্ত সিগারেট দিয়া ফুঁটা করে ফেলমু। মাইন্ড ইট!” মরণ বলল।
জীবন বলল- “যেটা সম্ভব না সেটা বার বার ক্যান বলিস? আমি সিগারেট বা অন্য কোনকিছুই ছাড়তে পারমুনা।
”
এই ধরনের তর্ক আরও অনেকবার হয়েছে। মরণ এভাবে তর্ক করে করে, বুঝিয়ে বুঝিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছে। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে আস্তে আস্তে বলল- “আগামী দুইমাসের ভেতর আমি নিজেকে পোড়া কয়লা বানিয়ে ছাড়বো। ”
আর ওদিকে জীবন ঘরে বসে ছটফট করতে লাগলো। নিজের কষ্ট সহ্য করাটা কোন ব্যাপার না তার কাছে।
কিন্তু মরণের কোন কষ্ট সে দেখতে পারেনা। অথচ আজ মরণ নিজেকে আহত করলো তার কারণেই- ভেবে ভেবে জীবনের অশান্তি আরও বেড়ে গেলো। দুম দুম করে মেঝেতে পায়ের আঘাত করতে লাগলো। রাগ প্রকাশের ধরন এটা। রাগটা কি নিজের সাথে করছে নাকি মরণের সাথে করছে সেটা সে নিজেও বুঝতে পারছেনা।
এতক্ষণ পর্যন্ত ঘটনা এই ছিল। এবার ওদের পরিচয় দেয়া যাক। ওরা ৩ বছর যাবৎ পরস্পরকে চেনে। কিন্তু দেখা হলো ২ মাস আগে। মরণ বয়সে জীবনের চেয়ে ৩ বছরের বড়।
মরণ বর্তমানে একটা কোম্পানিতে নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে। পড়াশোনা শেষ করেছে একবছর আগে। চাকরি পেতে দেরি হয়ে গেলো কারণ মরণের মামার জোর নেই আর তারই সাথে সে একটু সরল আর বোকা। শেষমেশ চাকরিটা পেয়ে গেল।
২ মাস আগে পর্যন্ত জীবন ছেলেটা অসাধারণ ভাষায় একা, নিঃসঙ্গ ছিল আর সাধারণ ভাষায় এতিম ছিল।
ছেলেটার চেহারা এতই মায়াকাড়া যে চোখ পড়বেই এবং সেই চোখ ফেরানো দুস্কর। বড়লোক পালক বাবা-মা রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে পরে আর যত্ন আত্তি করেনি। ঘরের এককোণে কুকুর-বিলাইয়ের মত পড়ে থাকতো। একা এই মানুষটার কোন কাজ নেই তাই আকাজ করতে লাগলো। আকাজ বলতে নেশা।
নেশা করলেও তার বোধ বুদ্ধি লোপ পায়নি। কথাবার্তা, চলাফেরা স্বাভাবিক।
নিঃসঙ্গ বলে কথা বলার মানুষ খুঁজতো নিজের অজান্তেই। ফোনে উল্টাপাল্টা নাম্বারে ফোন দিয়ে জীবন কথা বলার চেষ্টা করতো। ভাল লাগলে কথা চালিয়ে যেত নাহলে রেখে দিয়ে নাম্বার চেঞ্জ করে নিত।
এভাবে কথা বলে ১ বার ছেঁকাও খেয়েছে। ছেঁকাখাওয়া পাবলিক বলে জীবনকে রাগিয়ে দেয় মরণ।
মরণের সাথে জীবনের পরিচয় ফোনে। ৩ বছর আগের একদুপুরে। মরণের সেদিন ক্লাস ছিলনা।
শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল। অপরিচিত ফোনটা আসে। ধরতেই লাইন কেটে যায়। মরণের এসব ব্যাপারে আগ্রহ নেই। তাই সিরিয়াসলি না নিয়ে বই পড়তে লাগলো।
৫-৬ বার কল আসে এরপর। ধরলেই কেটে দেয়। এভাবে একসময় কথা হয়। সেই কথা বলার পর থেকে ধীরে ধীরে ওরা কিভাবে দুই ভাইয়ের মত আপন হয়ে গেল সেটা গবেষণার বিষয়। দুইভাই বললে কম বলা হবে।
ভাইয়ের চেয়ে বেশি। জীবনের সব কথা শুনে মরণ ঠিক করেছিল- পড়াশোনা শেষে কাজ পেলেই জীবনকে নিয়ে আসবে ওর কাছে। নিজের কাছে রাখবে। আর ঠিক করেছিল ওর নেশাটা ছাড়িয়ে নেবে।
২ মাস ধরে জীবন, মরনের কাছে আছে।
জীবন প্রথমে আসতে চায়নি। একা একাই নাকি পার করে দিতে চায় সময়। মরণ কান ধরে, থাপড়িয়ে নিয়ে এসেছে। এখন দুইজনে সামনাসামনি থাকে। তবুও ফাজলামি কমেনি।
দুজন দুইপ্রান্তে বসে ফোনে আলাপ করে, মেসেজ চালাচালি করে। ওরা বলে এতে নাকি পুরনো স্মৃতি জিইয়ে রাখা হয়। মাঝে মাঝে জীবন কান্না করে, মরণ পাশে বসে হাত বুলিয়ে দেয় মাথায় আর হাসাতে চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে মরনের মন মনমরা হয়ে যায় আর তখন জীবন ঠিক একই কাজ করে। এদের ভালবাসা বাইরে থেকে বুঝা যায়না।
ভেতরে ঢুঁ মারতে পারলে দেখা যাবে।
মরনের বাবা –মা ছেলের বিয়ের ভাবনা ভাবছেন। কিন্তু মরণের ধারনা সে বিয়ে করলে জীবন আবার এতিম হয়ে পরবে। তাকে সময় দেয়া হবেনা ঠিকমত। তাই মরণ ঠিক করেছে সে বিয়ে করবেনা।
এই নিয়ে বাবা মায়ের সাথে ঝগড়া হয়।
মরণদের বাসার ছাদে একটা ঘর আছে। সেই ঘরটা জীবনকে দেয়া হয়েছে। যদিও মরণ , জীবনের সাথেই থাকে প্রায়ই। নিজেকে জীবনের বাবা মনে করে।
ছেলের চেয়েও বেশি আদর দেয়।
দিনগুলো চলছে এভাবেই। জীবন আরেকটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক করলো। কিন্তু সে নেশা ছাড়ল না। মেয়েটা ভালই কিন্তু সম্পর্কে টানাপড়েন আছে।
জীবনের এসব কাণ্ডকারখানা দেখে মরণ হাসে। তার কাছে এসব প্রেম প্রেম খেলা ছেলেমানুষি মনে হয়। প্রেম নিয়ে জীবনের সিরিয়াস ডায়ালগ শুনে মরণ হেসে খুন হয়। আর জীবন অবাক হয় এই ভেবে যে – মরণ জীবনে একটাও প্রপোজ পায়নি। মরণ তার ব্যাখ্যা নিজেই দিয়েছে।
সে সুন্দর চেহারার হাঁদারাম বলে কোন মেয়েই তাকে প্রপোজ করেনি।
২ দিন পর পরই জীবনের নেশা ছাড়ার বিষয় নিয়ে তুমুল ঝগড়া বাঁধে ওদের মাঝে। মরণ জীবনকে এত আদর করে, এত প্রশ্রয় দেয়, এত ভালোবাসে তবুও নেশা ছাড়েনা জীবন।
মরণ মনে মনে দুর্বল হয়ে পড়ে। নিজেকে ব্যর্থ মনে করে আর নেশা না ছাড়ানোর দায় নিজের উপরেই নেয়।
অফিসে যায় মনমরা হয়ে ফিরে আসে একইভাবে। কোনকোনদিন সারাদিন না খেয়ে রাতে কোনমতে খায় আবার কোনদিন একবেলাও খায়না। নেশা কিভাবে ছাড়ানো যেতে পারে এই চিন্তাই মাথায় ঘোরে সারাক্ষণ।
শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। আর ভেতরে ভেতরে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে তার দেহ।
বাইরে থেকে তেমন বোঝা যায়না। দিন চলতে থাকে।
জীবন তার নতুন প্রেমিকার সাথে দেখা করেছে একবার। ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিয়ে করবে অথবা করবেনা। কিন্তু যেটাই করুক, একসাথে থাকবে।
একটা বাচ্চা দত্তক নেবে। জীবন এই কাজটা করতে চায় কারন সে নিজে একজন এতিম ছিল। তাই সে একটা এতিম বাচ্চা নিতে চায় এবং তাকে নিজের বাবামায়ের আদরে বড় করতে চায়। জীবনের প্রেমিকাও রাজী হয়ে গেল এই সিদ্ধান্তে।
নেশাকে জীবন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে ।
সে বুঝতে পারে মরণ তাকে কতটা ভালোবাসে আর নেশা ছাড়াতে প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কিন্তু সে নেশা করাকে তার ব্যাক্তিগত বিষয় বলে অন্যদের এই ব্যপারে কথা বলতে নিষেধ করেছে। আর কথা বললেও পাত্তা দেয়না।
একদিন সন্ধ্যাবেলা মরণ তাড়াতাড়ি চলে এলো অফিস থেকে। শরীরটা ভাল যাচ্ছেনা তার।
জীবনকে কাছে ডাকলো। শীর্ণ হাতদুটো দিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল। জীবন তার ঘুমন্ত ভাইয়ের চুলে বিলি কেটে দিতে লাগল। হঠাৎ কি মনে করে জীবনের চোখে জল এলো।
সে তাকালো ঘুমন্ত মরনের দিকে। এই মানুষটা তাকে কত ভালবাসে সে নিজেও জানেনা।
পরদিন সকালে ডাক্তার এলো। মৃত মরণের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বাকী সবাইকে সহজ ভঙ্গিতে বললেন- “না খেতে খেতে এবং শরীরের প্রতি অত্যাচার করায় ভেতরে ভেতরে মরণের শরীরে রোগ বাসা বেঁধেছিল। খুব দেরী হয়ে গেল।
এমন কেসে রোগীরা সাধারণত .....................”
মরণকে শ্মশানে আনা হয়েছে। আগুন জ্বলছে মরণের দেহকে ঘিরে। জীবন পাথর হয়ে তাকিয়ে রইল চিতার দিকে আর কানে একটা কথাই বাজতে লাগলো তার- “আগামী দুইমাসের ভেতর আমি নিজেকে পোড়া কয়লা বানিয়ে ছাড়বো। ”
কিছুক্ষণ পর তার চোখ বেয়ে জলের ধারা নামলো। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
একজন ডোম(মরা পোড়ায় যারা) এসে প্যাকেটটা তুলে নিয়ে গেল। তারপর ওরা সবাই মিলে সিগারেট ফুঁকতে লাগলো। জীবন ওদেরকে দেখছে। না; এখন আর ওর গাঁজা, সিগারেটের নেশা নেই। এখন সে নতুন নেশা পেয়েছে।
চোখের জল ফেলার নেশা।
ডোমদের সিগারেটের ধোঁয়া আকাশে উঠতে লাগলো। আর জীবনের চোখের জল চিতার পাশের গরম মেঝেতে পরে শুকিয়ে যেতে লাগল। আবার পরতে লাগল, আবার শুকিয়ে গেল...... আবার ......... ।
জীবন দেখলো –চিতার একটা পোড়া কয়লার পিন্ড শোয়ানো।
নাহ! চোখের জল ফেলার নেশা জীবন ছাড়তে পারবেনা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।