Click This Link
গণগ্রন্থাগার চত্বরে প্রবেশ করেছি। সালাতুল মাগরিবের আজান ভেসে আসছিল কোনো মিনার থেকে—সম্ভবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ হবে, যে মসজিদের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন জাতীয় কবি, বিশ্বমানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম। চট করেই মনে এলো নজরুলের গান—‘দূর আজানের মধুর ধ্বনি/বাজে, বাজে, মসজিদের ওই মিনারে’। আরও একটু এগোলাম। আজানের ধ্বনি ছাপিয়ে শওকত ওসমান মিলনায়তন থেকে ভেসে এলো ‘আরতি’—‘শুভ্র সমুজ্জ্বল হে চির নির্মল ধ্রুব জ্যোতি’।
আরতি মানে আর্তি, আরাধনা, প্রার্থনা, আজ্ঞা, আদেশ ইত্যাদি। কিন্তু যে সংস্কৃতি থেকে ‘আরতি’ শব্দটি এসেছে, সে সংস্কৃতিতে ‘আরতি’ মানে ‘প্রদীপ ধূপ-ধুনা ইত্যাদি দ্বারা দেবমূর্তি বরণ করার হিন্দু ধর্মীয় বিধি। ’
‘বাংলাদেশ নজরুলসঙ্গীত সংস্থা’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রায় দুই বছর হলো। সংস্থার পক্ষ থেকে এটি ছিল নজরুলসঙ্গীত নিয়ে তৃতীয় আয়োজন। গত সোমবার সন্ধ্যায় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান মিলনায়তনে কবির ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ‘যাহা চাই যেন জয় করে পাই’ শিরোনামে সঙ্গীতানুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়।
হল কক্ষে প্রবেশ করে দেখলাম মূল অনুষ্ঠান এখনও শুরু হয়নি। শিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে ‘আরতি’র মহড়া দিচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে মঞ্চ খালি হয়ে গেল। প্রায় ২০ মিনিট পর শুরু হলো মূল অনুষ্ঠান—সমবেত কণ্ঠে ‘আরতি’ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। এরপর স্বাগত বক্তব্য রাখলেন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আনাম শাকিল।
তিনি নজরুলকে ‘জাতীয় চেতনার প্রতীক’ উল্লেখ করে বললেন, অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে কবি সারাজীবন যে সংগ্রাম করেছেন সে সংগ্রাম আর কবির সৃষ্টিভাণ্ডার আমাদের প্রতিনিয়ত অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে চলেছে। এরপর মঞ্চে এলেন কবির নাতনি ও সংস্থার অন্যতম কর্ণধার খিলখিল কাজী। তিনি বললেন, ‘বিশ্বজুড়ে যখন নজরুলকে জানার আগ্রহ ক্রমে বেড়েই চলেছে, তখন এদেশের বড় বড় মঞ্চে দাঁড়িয়ে নজরুলকে নিয়ে বিতর্কমূলক আলোচনার অবতারণা করছেন কেউ কেউ। নজরুলের প্রেম-বিয়ে নিয়ে কুিসত গল্পগুজব করছেন। তারা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কল্পকাহিনী আওড়াচ্ছেন।
বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক নামধারী এসব ব্যক্তির মুখ থেকে গল্প-গুজব বেরিয়ে আসা অত্যন্ত দুঃখজনক। ’ খিলখিল কারও নাম উল্লেখ না করলেও সচেতন দর্শক-শ্রোতার বুঝতে কষ্ট হয়নি, তিনি ড. গোলাম মুরশিদ, ড. মুস্তফা নূরুল ইসলামদের উদ্দেশে এসব কথা বলেছেন। এক পর্যায়ে কবি-নাতনি আবেগরুদ্ধ, কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি কবির নাতনি হিসেবে, একজন শিল্পী হিসেবে এ ধরনের বক্তব্যের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার জানাই এবং আপনাদেরও আহবান জানাই এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে। ’ খিলখিলের এ বক্তব্যের প্রতিধ্বনি অবশ্য আর কোনো শিল্পীর কণ্ঠেই শোনা যায়নি। তাহলে কি এই অপকর্ম অপ-প্রকল্পের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার দায় একা কবি-নাতনি খিলখিল কাজীরই? খিলখিল বললেন, ‘বাবা-চাচার কাছে শুনেছি দাদু যখনই কোনো নতুন গান তৈরি করতেন সে গান সবার আগে দাদু প্রমীলা নজরুল, বাবা ও চাচাকে শুনিয়েই তবে মুক্তি দিতেন।
তিনি তার গানের সুর ও বাণীর একটু হেরফেরও সহ্য করতে পারতেন না। আমাদের সংস্থা দাদুর গানের বাণী ও সুরকে সঠিকভাবে পরিবেশন করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ’
সংস্থার সভাপতি শিল্পী খালিদ হোসেন বললেন, ‘স্থানাভাবে আমাদের অনুষ্ঠান করতে দেরি হয়ে গেল। সেজন্য আমরা দুঃখিত। ’ তিনি বলেন, ‘নানা সমস্যায় আমাদের গতি যদিও অনেকটা মন্থর, তবু আমাদের লক্ষ্য সুস্থির।
নজরুলের গানের বাণী ও সুরকে সঠিক ও শুদ্ধভাবে পরিবেশনের সুস্থির লক্ষ্যে এগোনোর চেষ্টা আমরা অব্যাহত রাখব। ’
সংক্ষিপ্ত আলোচনা পর্বের পর শিল্পী খালিদ হোসেন পরিবেশন করলেন নজরুলের কাব্যগীতি ‘তোমার মনে ফুটবে যবে’। এরপর এলেন সুস্মিতা দেবনাথ। তিনি পরিবেশন করলেন ভক্তিগীতি ‘ওগো অন্তর্যামী’। আফরোজা খান নীতা পরিবেশন করেন ‘সাঁঝের পাখিরা ফিরিল কুলায়/তুমি ফিরিলে না ঘরে’।
এ গানে ‘আঁধার ঘরে জ্বলেনি প্রদীপ/মন যে কেমন করে’ পরিবেশন করতে গিয়ে শিল্পী আঁধারকে ‘আধার’ করে ফেলেছেন আর ‘মন যে কেমন করে’-এর মধ্যে মন কেমন করা ভাবটি ফুটে ওটেনি। খিলখিল কাজী পরিবেশন করলেন গজল ‘করুণ কেন অরুণ আঁখি/দাও গো সাকী দাও শারাব’।
খিলখিলের দরদী গলায় অন্তরঙ্গ পরিবেশনা ছিল চমত্কার। কাওসার বেগম নিশি গাইলেন ‘সে চলে গেছে বলে কি গো’। এটিও ছিল সুন্দর পরিবেশনা।
করিম হাসান খান গাইলেন ‘প্রাতে কোকিল ডাকে/নিশিথে পাপিয়া’ সুন্দর, তবে আরও একটু দরদ যেন দাবি করছিল। শারমীন সাথী ইসলাম গাইলেন ‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই’। এ গানে ‘দয়া করো দয়া করো’তে যে আর্তি ফোটার কথা, হৃদয়ে তা বাজেনি। সেলিনা হোসেন গাইলেন ‘তরুণ প্রেমিক প্রণয় বেদন’। শরীফা শিরীন গাইলেন ‘অরুণ রাঙা গোলাপ কলি’।
পরিবেশনা দুটি ছিল মোটামুটি। খায়রুল আনাম শাকিল গাইলেন ‘প্রথম প্রদীপ জ্বালো’। রাগপ্রধান এ গানটি তিনি বেশ ভালোই গেয়েছেন। তবে ‘মুখর করো’ তার কণ্ঠে কেন জানি ‘মোখর করো’ শোনাচ্ছিল। মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় গাইলেন ‘বধূ আমি ছুিন বুঝি বৃন্দাবনে/রাধিকার আঁখিজলে’।
বিজন মিস্ত্রী গাইলেন ‘হে প্রিয় আমারে দেব না ভুলিতে’। দু’জনই ভালো গেয়েছেন। মাহফুজা হক চামেলী গেয়েছেন ভক্তিগীতি ‘অন্তরে তুমি আছো চিরদিন’। এ পরিবেশনাটিও বেশ ভালো ছিল। এরপর ড. লীনা তাপসী খান গাইলেন রাগপ্রধান খেয়াল অঙ্গের গান ‘গগনে সঘন চমকিছে দামিনী’।
অপূর্ব পরিবেশনা শিল্পীর। এই অপূর্ব পরিবেশনার মধ্যেও ‘বিরহিনী কামিনী’র ‘বিরহিনী’ বিশেষত ‘নী’র ওপর একটু যদি জোর দিতেন তাহলে মন্দ হতো কি? সেলু বড়ুয়ার কণ্ঠে ‘কানন-গিরি-সিন্দু পার’, নাসিমা শাহীনের কণ্ঠে ‘তব মুখখানি খুঁজিয়া ফিরিব’, সঞ্চয় কবিরাজের কণ্ঠে ‘কেন কাঁদে পরাণ কী বেদনায়’, জোসেফ কমল রড্রিক্সের কণ্ঠে ‘কাঁদাব না আর সচি দুলাল’-এর পরিবেশনা ভালোই ছিল। দুই বোন রুমা ও ঝুমা দ্বৈত কণ্ঠে পরিবেশন করলেন ‘রুম ঝুম ঝুম বাদল নূপুর’—এদের পরিবেশনা আরও সুন্দর হতে পারত বলে মনে হয়েছে। এয়াকুব আলী খান গাইলেন কাব্যগীতি ‘কোন সে সুদূর অশোক কাননে বন্দিনী তুমি সীতা’। পরিবেশনা ছিল চমত্কার।
সুলতানা আফরোজ গাইলেন ‘বৃথা তুই তাহার ’পরে করিস অভিমান’। পরিবেশনা ভালোই। মইদুল ইসলাম গাইলেন ঠুমরি ‘বোলো বধূয়ারে নিরজনে’। পরিবেশনা ছিল চমত্কার। এটিএম সালেকুজ্জামান গাইলেন ‘হে পার্থ-সারথি/বাজাও বাজাও পাঞ্চ-জন্য শঙ্খ’।
পরিবেশনাটি ছিল বেশ ভালো। রেজাউল করিম গাইলেন ‘পাষাণের ভাঙলে ঘুম’। এ গানে ‘চমকে ওঠে মোর গগনে’-এ চমকটা ছিল না বলে মনে হয়েছে। ফকির শহীদুল ইসলাম গাইলেন খেলা শেষ হলো। অনুষ্ঠান শেষ হলো ‘মৃত্যু নাই দুঃখ নাই’ সমবেত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে।
অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা ছিল দুর্বল। উপস্থাপক শ্রোতাদের প্রয়োজনীয় তথ্য সব সময় পরিবেশন করতে পারেননি। অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের উপস্থিতিও ছিল কম। অর্ধেক হল ছিল খালি। সংগঠনের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘ভক্তিরস প্রধান গান দিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের অনুষ্ঠান।
’ অধিকাংশ গান ভক্তিরসেরই ছিল। কিন্তু অবাক করার মতো ব্যাপার ছিল—সব ভক্তিগীতিই হিন্দু ধর্মীয়, ইসলাম ধর্মীয় একটি ভক্তিগীতিও ছিল না অনুষ্ঠানে। আয়োজকরা ৩৪টি গানের একটি তালিকা দিয়েছেন, যেখানে ‘দেশে দেশে গেয়ে বেড়াই’ গানটি ছিল ইসলামী অনুষঙ্গের, কিন্তু এ গানটিও অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়নি। অনুষ্ঠান শেষে আয়োজকদের কাছে জানতে চাইলে তারা বললেন—এ গানটি যার গাওয়ার কথা ছিল তিনি কেন জানি গাইলেন না। অনুষ্ঠানের শিল্পী তালিকায় মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান শিল্পী ছিলেন।
২৪ জন মুসলিম, ৫ জন হিন্দু, ১ জন খ্রিস্টান, ১ জন বৌদ্ধ শিল্পীর নাম পাওয়া যায় তালিকায়। কিন্তু ২৪ জন শিল্পীর পক্ষে সম্ভব হয়নি একটিও ভক্তিরসের ইসলামী গান গাওয়া। এ ব্যাপারে দু’একজন শ্রোতাকেও অনুযোগ করতে দেখা গেল। ‘জড়তা ও দৈন্য হানো হানো/গীতার মন্ত্রে জীবন দানো’ গাওয়া হলো, অথচ অনুষ্ঠানে মুসলিম অনুষঙ্গের কোনো উপস্থিতি ছিলো না।
অনুষ্ঠানের মঞ্চসজ্জা মোটামুটি ভালো ছিল।
একক পরিবেশনার সময় মূল মঞ্চকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে, স্পট লাইট ব্যবহার করা হয়েছে। সাউন্ড সিস্টেম মাঝে মাঝে সমন্বয়হীন হয়ে গেছে। হারমোনিয়ামের পাশাপাশি কি-বোর্ড, তবলা ও বেহালা ছিল। যন্ত্রানুষঙ্গে সঙ্গত বেশ ভালোই ছিল। সার্বিকভাবে অনুষ্ঠানটিও ভালো ছিল বলা যায়।
তবে ইসলামী গানের অনুপস্থিতি অনুষ্ঠানের আবেদনকে একেবারেই ম্লান করে দিয়েছে। অথচ আয়োজকদের মধ্যে সেরা শিল্পীদের অধিকাংশই নজরুলের ইসলামী গান পরিবেশনে বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী। তারপরও কেন এমন হয়? ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।