আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যাহা চাই তাহা পাই না

বসে আছি পথ চেয়ে.... মানুষের অভাব বা চাহিদার কোনো শেষ নেই। একটা অভাব মিটলে কিংবা একটা চাহিদা পূরণ হলেই আরেকটা সামনে চলে আসে। সেটা পূরণ হলে আরেকটা। এভাবে চলতেই থাকে। মানুষের মন কখনও কোনকিছুতেই তৃপ্ত বা সন্তুষ্ট হয় না।

সবার মনের মধ্যে সারাক্ষণ একটা দীর্ঘশ্বাস- আহা! আমার যদি এটা থাকত। আহা! আমার যদি ওটা হতো। এই এটা-ওটা-সেটার চিন্তাতেই মানুষের জীবন কেটে যায়; কোনো-না-কোনো অভাব বা অতৃপ্তি নিয়েই মানুষকে চিতা কিংবা কবরে যেতে হয়। মানুষের চাহিদা অসীম হলেও সবার চাহিদা বা অভাব এক রকম নয়। আমাদের সমাজে মানুষ যেমন বিচিত্র, বিভিন্ন মানুষের অভাব বা চাহিদাও তেমনি বিচিত্র।

তবে সাধারণত কেউই অল্পে তুষ্ট হয় না বা হতে চায় না। একজন নিরন্ন মানুষকে তার চাহিদার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবে, দু’বেলা দু’মুঠো খাবার পেলেই সে সন্তুষ্ট। তার এই চাহিদা পূরণ করুন, এরপর সে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই চাইবে। সেটা পূরণ হলে চাইবে একটু মোটা কাপড়ের ব্যবস্থা। এই চাহিদা পূরণ হলে সে চাইবে একটু বিনোদনের ব্যবস্থা।

এভাবে এক পর্যায়ে মোটা ভাত, মোটা কাপড় ও মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের দাবি ত্যাগ করে ক্রমেই সে ভাল পুষ্টিকর খাবার, আরামদায়ক থাকার ব্যবস্থা, আকর্ষণীয় পোশাকের দাবি তুলবে। তার দাবি ও চাহিদা ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে। সব শেষে সে গদি চাইবে। না হলে সংবিধান পরিবর্তনের দাবি তুলবে। মানুষের চাহিদার কোনো শেষ নেই।

আর যে যত বেশি পায় সে তত বেশি চায়। প্রেমবঞ্চিত কোনো যুবককে তার চাহিদার কথা বললে, সে প্রথমেই একজন প্রেয়সী চাইবে। এরপর সে চাইবে একজন স্ত্রী। স্ত্রীর অভাব পূরণ হলে সে হয়ত চাইবে পরকীয়া। এরপর আরও আরও কিছু।

... একজন বেকারকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তুমি কী চাও? সে উত্তরে বলবে, যে কোনো ধরনের একটা চাকরি চাই, কাজ চাই। বেতন যাই হোক, কোনো আপত্তি নেই। এরপর কাজ বা চাকরি পেলেই তার চাহিদা বাড়তে থাকে। কেন বেতন বাড়ে না, প্রমোশন হয় না- এসব নিয়ে তার মনোবেদনা ও আফসোসের কোনো সীমা থাকে না। তবে সবার চাহিদা বা আকাক্সক্ষা একরকম নয়।

গরিবের এক রকম চাহিদা, আবার বড় লোকের আরেক রকম। নেতার চাহিদা এক রকম, জনতার আরেক রকম। বিভিন্ন জনের চাহিদার মধ্যে রকমফের আছে। তারতম্য আছে। কোটিপতি সারাক্ষণ আরও বেশি টাকার স্বপ্ন দেখে এবং যে কোনো উপায়ে সেই টাকা উপার্জনের চেষ্টা করে।

আবার হাভাতের স্বপ্নজুড়ে কেবল থাকে খাবার। কাড়ি কাড়ি ভাত। কেউ টাকা চায়, কেউ ক্ষমতা চায়, কেউ নারী চায়, কেউ চায় সুরা। আবার কেউ দামি বাড়ি-গাড়ি চায়, কেউ আমোদ-ফুর্তি করার সুযোগ চায়, কেউ খ্যাতি চায়, কেউ চায় ক্ষমতা, কেউ চায় দেখিয়ে দিতে, প্রতিশোধ নিতে। কেউ-বা চায় ভালবাসা।

অনেকে আবার যে কোনো উপায়ে বিখ্যাত বা আলোচিত হতে চায়। কেউ কোলাহল চায়, কেউ চায় নির্জনতা। কেউ চায় বন্ধন, কেউ-বা মুক্তি। কারও পছন্দ কাজ, কারও আবার অলসতা। কেউ চায় ব্যথা দিতে আবার অনেকে ভালবাসে ‘কষ্ট পেতে’।

কেউ গান শুনতে পছন্দ করে, আবার কেউ পছন্দ করে গান গাইতে। কেউ কবিতা লিখে আনন্দ পায়, কেউ কবিতা পড়ে আনন্দ পায়। অনেকে কবিদের গালাগাল করে আনন্দ পায়। অনেকে আবার ছাপার অক্ষরে নাম প্রকাশ করতে কিংবা টিভিতে একটু চেহারা দেখাতে পছন্দ করে। মোট কথা, মানুষের চাওয়া-পাওয়ার কোনো শেষ নেই।

এই চাওয়া বিচিত্রও বটে। মানুষের আকাক্সক্ষার এই ভিন্নতা প্রসঙ্গে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন-‘কেউ হাসি চায়, কেউ ভালবাসা, কেউ চায় মিঠে কথা/কেউ চায় ফের নয়নের জল, কেউ চায় এর ব্যথা’। যে ব্যক্তি সারাজীবন রাজনীতির নামে সময় কাটিয়ে ফতুর হয়েছেন তার এক রকম দুঃখ। তিনি চান যে কোনো একটি মন্ত্রীর পদ। হোক না তা দফতরবিহীন কিংবা যে কোনো অদরকারি দফতরের।

আর ‘পশু’ মন্ত্রী যিনি হয়েছেন, তার আফসোস ইস! আমাকে যদি অন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দেওয়া হতো! যিনি দফতরবিহীন মন্ত্রী, তার আক্ষেপ তাকে যদি একটা দফতর দেওয়া হতো। প্রধানমন্ত্রীর ভাবেন, তিনি যদি আসছে টার্মেও প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারতেন। এভাবে দেখা যায়, কেউই তার বর্তমান অবস্থা নিয়ে, পদ-পদবি-ক্ষমতা নিয়ে সুখী নয়। মানুষ হিসেবে আমাদের সীমাবদ্ধতা হলো আমাদের জীবনের বেশিরভাগ চাহিদাই পূরণ হয় না। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি নিয়ে আমাদের জীবনে হাহাকারের কোনো শেষ নেই।

একটা অতৃপ্তি, নেই নেই ভাব, না পাওয়ার বেদনা প্রতিনিয়ত আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে। সে জন্য বিরহের গান আমাদের দেশে বেশি জনপ্রিয়। যার কোথাও কেউ নেই, কোনোকালে কেউ ছিল না, সেও মাঝে-মধ্যেই আনমোনা হয়ে যায়। যেন জীবন থেকে পরম কাক্সিক্ষত কেউ চলে গেছে, একটুর জন্য ‘কী না হইতে পারিত’ গোছের কেউ হারিয়ে গেছে-এমন একটা ভাব নিয়ে বেঁচে থাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

এই পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে আমাদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ, অভিযোগ-অনুযোগ অনুতাপের কোনো শেষ নেই। ওসব করে কোনো লাভ হয় না, প্রতিকার পাওয়া যায় না। তারপরও আমরা সেসব করি। আমাদের দেশে যারা সাধারণ মানুষ, তাদের চাহিদা-আকাক্সক্ষা, ক্ষোভ-বিক্ষোভ-দুঃখ-বেদনার কাহিনী অবশ্য কেউই জানতে বা শুনতে চায় না। সাধারণ মানুষ হচ্ছে আম-জনতা।

আম যেমন একগাছে শত শত হাজার হাজার থাকলেও তাদের কোনো চাহিদা বা ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাম নেই, আম-জনতাও ঠিক তাই। আলাদাভাবে আমের দাম থাকলেও তা জনতার সামনে বসে যখন ‘আম-জনতায়’ পরিণত হয় ‌তখনই তার দাম, গুরুত্ব, উপযোগিতা হ্রাস পায়। এতে বোঝা যায় যে জনতা বা মানুষের দাম আমাদের সমাজে ফল-মূলের চেয়েও কম। কাজেই চাওয়া-পাওয়া নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। রবি ঠাকুরের বাণীই আমাদের অমোঘ নিয়তি-যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই , যাহা পাই তাহা চাই না ।

..তা কী রাজনীতিতে, কী ব্যক্তিগত জীবনে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.