আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চীনের খাওয়া-দাওয়া

ভুল করেছি,প্রায়শ্চিত্য করবো না, তা তো হয় না বৈচিত্র্যময় দুনিয়ায় প্রত্যেকটি জাতির ঐতিহ্যগত অভ্যাসে ভিন্নতা লক্ষ্যণীয়। বিশেষ করে চীনা জাতির সাথে অন্যান্য জাতির এই পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান। যেমন খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে চাইনিজদের অভ্যাসের কিছু নমুনা: (১) সকালের নাস্তা খুব ভোরে খাওয়া। যথাসম্ভব ঘুম থেকে ওঠার পরপরই খেয়ে কাজ শুরু করা। আমি ক্লাসে শিক্ষককে সকালের খাবারের সময় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম।

জবাবে উনি একটা ঘটনা বললেন: একদিন খুব সকালে রাস্তায় এক বয়স্ক নারীর [পৌরসভার রোড ক্লিনার] কাছে সকালের খাবার কোথায় খাওয়া যায় জানতে চাইলে তিনি অবাক হয়ে বলেন, এখন ৬টা বাজে। অথচ তুমি এখনও খাওনি! আমি তো ৫টার সময় খেয়েছি। চীনে পাড়া-মহল্লায় খাবারের দোকানে ভোর সাড়ে ৫টায় পিক আওয়ার শুরু হয়ে যায়। হকাররাও রকমারি নাস্তা নিয়ে রাস্তায় বসে পড়ে। চাইনিজদের সকালের মেন্যু হিসেবে ‘ডাম্পলিং’ বা ‘চিয়াওজি’ সবচেয়ে প্রিয়, এর সঙ্গে ‘চৌ’।

চৌ হচ্ছে আমাদের দেশের জাউ এর মত যা সাধারণত আমরা পেট খারাপ হলে খেয়ে থাকি। তবে চৌ জাউ এর তুলনায় অনেক পাতলা। এছাড়াও আছে ম্যান থৌ, পাওজি। ম্যান থৌ অনেকটা মুঠো পিঠার মত তবে অনেক নরম, ভেতরে অন্য কিছু থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইনিং হলগুলোতে সকাল ৮টার পর ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে তেমন কিছু পাওয়া যায় না, আর সাড়ে ৮টায় বন্ধ হয়ে যায়।

একারণে অনেকটা বাধ্য হয়েই আমি ৮টার আগেই খাবার সেরে নিই। (২) দুপুরের খাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইনিং হলগুলো সকাল ১০:৪০-এ খুলে দেয়, ১২ টার পরে গেলে প্রায় সময়ই খাবার পাওয়া যায় না। অনেক সময় ২/১টা তরকারি থাকলেও ভাত শেষ হয়ে যায় কিংবা ভাত থাকলেও তরকারি থাকে না। আমি একদিন এ অবস্থার শিকার হলাম। কি আর করা! শুধু তরকারি খেয়েই দিন পার করলাম।

অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইনিং হলে মুসলিম ছাত্রদের জন্য পৃথক ব্যবস্হা আছে। যেখানে তারা ক্লাস শেষ করে যেতে একটু দেরি হলেও যেন খাবার পায় [এখানে দেরি বলতে অবশ্যই সেটা ১২ টার আগে] সে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অন্যথায় মুসলিমদের সমস্যা হয়। কেননা অন্যরা প্রায় সব ধরনের খাবার খেতে পারে কিন্তু মুসলিমরা শুধু ‘হালাল’ খাবার খায়। তাই তাদের জন্য হালাল খাবারের বিশেষ এই ব্যবস্হা।

(৩)রাতের খাবারের ব্যাপারে চাইনিজরা মনে করে তাড়াতাড়ি খাওয়া উচিত যাতে ঘুমানোর আগেই খাবার হজম হয়ে যায়। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইনিং হল বিকেল ৫টায় খোলে আর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বন্ধ হয়। চিন্তা করা যায়!!! তাই সাড়ে ৬টার আগেই রাতের খাবার খাওয়া শেষ করতে হয়। তবে চাইনিজদের নিয়ম অনুযায়ী ডাইনিংয়ে ৩ বেলা তো খাই-ই, অধিকন্তু রাত ৯টায় রুমে আরও একবার রান্না করে খাই। কেননা আমার ঘুমানোর অভ্যাস রাত ১টা থেকে ২টায়।

সেখানে কি বিকেল ৫টায় খেয়ে থাকা সম্ভব? অধিকাংশ চাইনিজ বিশেষ করে শহরাঞ্চলের প্রায় কেউই রান্না করে না,বলতে গেলে আসলে রান্না পারেই না, চাইনিজ মেয়েরাও না। আমার ল্যাবের এক মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছিলাম “তুমি কি কি রান্না করতে পার?” জবাবে সে বলল, “আমি একটা জিনিস রান্না করতে পারি। ” তখন আমি খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি (কারণ, আমি শুনেছি বর্তমান প্রজন্মের চাইনিজ মেয়েরা রান্না পারে না)? হতাশ হলাম তার উত্তর শুনে। সে বলল, “আমি ডিম সিদ্ধ করতে পারি। ” এরা এখন রেস্টুরেন্টে খেতে অভ্যস্ত, এমনকি কাউকে দাওয়াত দিলেও তাকে সাথে নিয়ে রেস্টুরেন্টেই যায়।

এই অভিজ্ঞতাটা হয় যখন আমি প্রথমবারের মত এক চাইনিজ ফ্যামিলির বাসায় গিয়েছিলাম। সেখানে তাদের সঙ্গে গল্প করে অনেকটা সময় কাটানোর পর যখন ডিনার করার সময় হল তখন রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। চায়নাতে এখন এটাই ট্রেন্ড। মেহমানকে খাওয়ানোর জন্য বাসা-বাড়িতে না, রেস্টুরেন্টে দাওয়াত দেয়। চাইনিজরা রেস্টুরেন্টে অনেক সময় নিয়ে খায়।

তারা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে গল্প করে না বরং গল্পের ফাঁকে ফাঁকে খায়। আর একটা ব্যাপার বেশ লক্ষণীয়, তা হচ্ছে ভালো রেস্টুরেন্ট এমনকি পাড়া-মহল্লার ছোট ছোট হোটেলেও খাবার আগে থেকে রান্না করা থাকে না। গ্রাহক অর্ডার দেওয়ার পর রান্না শুরু করে, কারণ চাইনিজরা খাবার গরম গরম খেতে পছন্দ করে। আর তাদের সবকিছু তরতাজা চাই। বিশেষ করে এখানে তাজা মাছ বিক্রি হয়।

সুপারশপ যেমন Walmart, Metro, Carrefour এগুলোতে মাছ অ্যাকুরিয়ামের মধ্যে রাখে বিক্রির জন্য। এমনকি রাস্তার দোকানদাররাও মাছ বড় ড্রামে পানির মধ্যে রাখে। কারণ তাজা মাছের দাম মরা মাছের তুলনায় দ্বিগুণ। চাইনিজরা রেস্টুরেন্টে ২/৩ ঘন্টা সময় নিয়ে খায়, অর্থাৎ গল্প এবং খাওয়া চলে একসঙ্গে। আমার থিসিস অ্যাডভাইজর তার অধীনস্হ Phd & Masters ছাত্রদের জন্য মাঝেমধ্যেই খাওয়ার আয়োজন করেন।

প্রত্যেকবারই ওখানে অনেক সময় কাটাই, একবার বিকেল ৫টা হতে সাড়ে ৯টা মোট সাড়ে ৪ঘণ্টা খাওয়ার টেবিলে ছিলাম। রেস্টুরেন্টে বাংলাদেশের মত সারি সারি চেয়ার-টেবিলের সিস্টেম আছে আবার রুমভিত্তিকও আছে। এক একটা রুমে এক একটা বড় বড় টেবিল, অর্থাৎ নিরিবিলি পরিবেশে গল্প গুজবের মধ্যে খাওয়ার ব্যবস্থা। বাংলাদেশে সাধারণত কপোত-কপোতীরা রেস্টুরেন্টে একটু বেশি সময় নিয়ে খায়, গল্প-গুজব করে। কেননা সেটা তাদের ডেটিং এর একটা অংশ।

এদের দেখি খাওয়ার সময়ই এরা যা গল্প করে, বলা যায় এটা তাদের বিনোদনের একটা অংশ। বন্ধুরা সবাই মিলে একসাথে গল্প করা মানেই সেটা হবে খাওয়ার টেবিলে। চীনে ভারি খাবার-দাবার ছাড়া কোনো পার্টির কথা চিন্তা করা যায় না। এদিক থেকে চীন এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে বেশ মিল আছে। ছোট বড় সব খাবার হোটেলে অবশ্যই টয়লেট আছে, আর একটু উন্নতমানের হোটেলগুলোতে রুমের ভেতরে টেলিভিশন, ক্যাসেট প্ল্যেয়ার, সাউন্ডবক্স অর্থাৎ সঙ্গীত উপভোগের জন্য যা যা প্রয়োজন সবই আছে।

খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে তারা ক্যারাওকি সিস্টেমে মূল গানের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে গান গায়, মিউজিক ভিডিওতে টিভি পর্দায় লিরিক (গানের কথা) দেখা যায়, ওটার সাথে সুর মিলিয়ে গান গায়। চাইনিজদের রাতের খাবার তাড়াতাড়ি করা প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলি। একবার চাইনিজ বন্ধুরা আমাকে হু-গুয়ো [hot-pot] খাওয়ার দাওয়াত দেয়। এজন্য ওদের সঙ্গে দুপুর সাড়ে ৩টার সময় রেস্টুরেন্টে গিয়ে ঢুকতে হয় ডিনার করার জন্য। কারণ হিসেবে ওরা বলে, দেরি করে গেলে টেবিল খালি পাওয়া যাবে না।

ব্যাপারটা অনেকটা ঢাবি’র টিএসসি ক্যাফেটেরিয়াতে খাওয়ার লাইন দেওয়ার মত। সবাই আগেই গিয়ে টেবিল দখল করে ফেলে। হু-গুয়ো খাবার কায়দাটা হচ্ছে-- ওয়েটার সবকিছু দিয়ে যাবে, যেমন কাঁচা মাংস, সবজি, মাছ। তারপর টেবিলের মাঝখানে রাখা কড়াই এর গরম পানিতে একটা একটা করে উপকরণ ছেড়ে দেয়, ওয়েটার মসলা আলাদাভাবে দিয়ে যায়, নিজের ইচ্ছামতো মসলা দিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে রান্না করে তারপর গরম গরম কড়াই থেকে তুলে খায়। ‘রান্না খারাপ হইছে, লবণ-ঝাল বেশি হইছে বা কম হইছে,’ এসব কথা ওয়েটারকে বলার সুযোগ নেই, হোটেলের ক্যাশে গিয়ে পরিবেশ গরম করারও উপায় নেই! চীনে হাজারো রকমের খাবার আছে, বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন রকমের খাবার।

এরই একটা সিচুয়ান প্রদেশের ‘শৈয়ে-চ্যু-য়্যু’ যা সারা চীনে বিখ্যাত, শৈয়ে-চ্যু-য়্যু হল একটা গোটা মাছ বড় একটা ডিশে বিভিন্ন রকমের মসলা দিয়ে রান্না করা। এটা খুবই ঝাল খাবার। কারণ, সিচুয়ান প্রদেশের লোকজন ঝাল খাবার পছন্দ করে। চীনের যে এলাকার আবহাওয়া গরম সেখানকার লোকজন ঝাল খাবার পছন্দ করে আর যে এলাকার আবহাওয়া ঠান্ডা সেখানকার লোকজন ঝাল খাবার পছন্দ করে না। চীনারা ভোজনরসিক এটা যেমন সত্য তেমনি এরা রেস্টুরেন্টে প্রচুর খাবার নষ্ট করে, অনেক বেশি মেন্যু অর্ডার দেয় কিন্তু শেষ করতে পারে না।

শুধু যে বড় লোকরাই অপচয় করে তা না, মধ্যবিত্তরাও করে। বাপের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলা ছাত্ররাও করে। চাইনিজ ছাত্রদের ক্লাস চলাকালীন [বছরে ৮ মাস] সময়ে কাজ করার কোনো সুযোগ নেই, সারাদিন দৌঁড়ের ওপরে থাকে [হোম ওয়ার্ক, পরীক্ষা ইত্যাকার কারণে]। আমি যতবার চাইনিজদের সাথে খেতে গেছি- ততবারই দেখেছি ওরা যতটুকু খাবার খায় তার সমপরিমাণ অপচয় করে। চীনারা south-china, north-china শব্দ দুটো বিদেশিদের কাছে কথা প্রসঙ্গে খুব বলে থাকে।

কারণ খাওয়া-দাওয়াসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত ক্ষেত্রে দুই অঞ্চলের লোকজনের মধ্যে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। চীনের দক্ষিণাঞ্চলের লোকজনের অভ্যাস চা খাওয়া, এই অঞ্চলেই প্রথম চা আবাদ শুরু হয়েছে- সেখান থেকে গোটা দুনিয়াতে ছড়িয়ে গেছে। এরা ল্যু ছা [green tea] বেশি পছন্দ করে যদিও অধিকাংশ বাংলাদেশি এটা পছন্দ করে না। অনেক কোম্পানি ল্যু ছা বোতলজাত করে [পানির বোতলের মত] বিক্রি করে এখানে কিছু চাইনিজ খাবারের ফটুক আছে বিবরণ সহ চীনের উত্তরাঞ্চলের লোকজনের চা খাওয়ার অভ্যাস খুবই কম, এরা এতটাই বিয়ার খেতে পছন্দ করে যে পানির পরিবর্তে খায়। চীনে আর একটা জিনিস পাওয়া যায় পিং-হোং ছা [Ice tea]. এই চা বেশ মিস্টি এবং ঠাণ্ডা, গরমের সময় খেতে ভালো লাগে।

এছাড়া আছে ‘বেইজিং খাও-ইয়া,’ এটাও পুরো চীনে বিখ্যাত, খাও-ইয়া হল রোস্টেড হাঁস; উওর-পূর্ব চীনের কুঅ-পাউ-রৌ। দ্রষ্টব্য: এই লেখায় আমি চীনের হারবিন শহরের সময় উল্লেখ করেছি। তাই অন্যান্য শহরের ক্ষেত্রে সময়টা ভিন্ন হবে। চীনের পূর্ব অংশের সঙ্গে পশ্চিম অংশের সময়ের পার্থক্য ২ঘণ্টা। http://www.banglanews24.com যদিও আমি এই বিষয়ে আগে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম তারপরও একটি অনলাইন পত্রিকার জন্য নতুন করে লেখা এই কলামটা শেয়ার করলাম যাতে ঐ সময় যারা মিস করেছেন তারা পড়তে পারেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।