সিয়া রাজবংশ ছিল ইতিহাসে চীনের প্রথম রাজবংশ। খ্রিস্টপুর্ব একবিংশ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টপুর্ব ষোড়শ শতাব্দি পর্যন্ত সিয়া রাজবংশ প্রায় ৫০০ বছর স্থায়ী ছিল। সিয়া রাজবংশের ১৪টি প্রজন্মের ১৭ জন রাজা সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বর্তমান চীনের সানসি প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চল ও হোনান প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল ছিল সিয়া রাজবংশের প্রধান শাসনাধীন অঞ্চল ।
সিয়া রাজবংশের প্রথম সম্রাট দা ইয়ু ছিলেন একজন ঐতিহাসিক বীর।
কথিত আছে, তিনি হোয়াংহো নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণে সাফল্য অর্জন করে উপজাতির মানুষদের সমর্থন পেয়েছিলেন এবং অবশেষে সিয়া রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ব্যক্তি মালিকানাধীন সমাজ যে দীর্ঘস্থায়ী আদিম সমাজের স্থলাভিষিক্ত হয়, সিয়া রাজ্য প্রতিষ্ঠা তার নিদর্শন। এরপর চীন দাস সমাজে প্রবেশ করে।
সিয়া রাজবংশের শেষভাগে রাজপরিবারে রাজনৈতিক গোলযোগ দেখা দেয়। শ্রেণীগত দ্বন্দ্ব দিন দিন তীব্র আকার ধারণ করে ।
বিশেষ করে সিয়া রাজবংশের শেষ রাজা সিয়াজিয়ে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর অতি বিলাসী জীবন যাপন করতেন, প্রতিদিন তার আদুরে রক্ষিতাদের সঙ্গে মদ খেতে খেতে আনন্দ-ফূর্তি করতেন। তিনি রাজকীয়কার্যে বিন্দুমাত্র মনোযোগ দিতেন না এবং প্রজাদের দুঃখ দুর্দশার ওপর নজর রাখতেন না। তিনি যেমন অহংকারী, তেমনই নিষ্ঠুর। মন্ত্রীদের মধ্যে কেউ রাজ্যের শাসনে মন দেওয়ার প্রস্তাব দিলে সিয়াজিয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে হত্যা করার আদেশ জারি করেন। এই কারণে দেশের ছোটো ছোটো রাজ্য পর পর বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
সাং নামক একটি ছোটো রাজ্য সেই সুযোগে সিয়াজিয়ের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালায় এবং অবশেষে সিয়াজিয়ের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে। রাজা সিয়াজিয়ে রাজধানী ছেড়ে নানছাওয়ে পালিয়ে যান এবং সেখানে তার মৃত্যু হয়। সেই সঙ্গে সিয়া রাজত্ব বিলুপ্ত হয় ।
সিয়া রাজবংশ সম্পর্কিত ঐতিহাসিক তথ্য নেহায়েত অপ্রতুল বলে ইতিহাসে সিয়া রাজবংশের অস্তিত্ব নিয়েই চীনের পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কিন্তু চীনের ঐতিহাসিক গ্রন্থে (ইতিহাসের আলেখ্য) স্পষ্টভাবে সিয়া রাজবংশের কুলজী বর্ণনা করা হয়েছে।
১৯৫৯ সালে চীনের সিয়াসুতে যে খননকাজ আরম্ভ হয়, তাতে সিয়া সংস্কৃতি সন্ধানের সূত্রপাত ঘটে। বর্তমানে অধিকাংশ পণ্ডিত মনে করেন , প্রধানত: হো নান প্রদেশের ইয়ান শির 'এর লি থৌ' ধ্বংসাবশেষে সিয়া রাজত্বকালের সংস্কৃতির সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। পরীক্ষা করে জানা গিয়েছে, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৯০০ সালে 'এর লি থৌ' সংস্কৃতির জন্ম এবং তা সিয়া অব্দে পড়ে। 'এর লি থৌ' সংস্কৃতি যে সিয়া রাজত্বকালের সংস্কৃতির অংশ বিশেষ তার প্রত্যক্ষ প্রমান পাওয়া না গেলেও “ এর লি থৌ” ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া প্রচুর প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য সিয়া রাজবংশের সংস্কৃতির অনুসন্ধানে যথেষ্ট প্রেরণা যুগিয়েছে ।
'এর লি থৌ' ধ্বংসাবশেষ থেকে উৎপাদনকার্যে ব্যবহৃত যে সব হাতিয়ার পাওয়া গিয়েছে তার বেশীর ভাগ পাথর দিয়ে তৈরি।
তবে হাড় ও ঝিনুকের খোল দিয়ে তৈরি হাতিয়ারের ব্যবহারও তখন প্রচলিত ছিল। কিছু বাড়ির ভিত, খাদ ও কবরের প্রাচীরে কাঠের কৃষিযন্ত্র দিয়ে মাটি খোঁড়ার চিহ্ন দৃষ্ট। তখনকার মেহনতী মানুষ এই সব সহজ হাতিয়ার ব্যবহার করে জলসেচ আর কৃষি উৎপাদনে কঠোর পরিশ্রম ও বিজ্ঞতার পরিচয় রেখা দিয়েছিল। সিয়া রাজবংশের শাসনামলে তৈরি বৃহৎ তামার যন্ত্র এখনো আবিস্কৃত হয়নি, কিন্তু 'এর লি থৌ' ধ্বংসাবশেষ থেকে তামার চাকু, কুড়ালি, বাটালি, তীর, অস্ত্র আর পেয়ালা পাওয়া গিয়েছে। এছাড়া মৃত পাত্র, তামার গুঁড়ো আর মুচির টুকরো, অপেক্ষাকৃত উন্নতমানের জেডপাথরের পাত্র, সবুজ বল খোদিত অলংকার এবং পাথরের বাদ্যযন্ত্রও পাওয়া গিয়েছে।
এই থেকে বোঝা যায়, তখনকার হস্তশিল্পের প্রকৌশল আর কাজকর্মের শ্রেণীবিভাগে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছিল।
'তা তাই লি জি' নামক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক গ্রন্থে সিয়া রাজত্বকালের যে পঞ্জিকা উল্লেখ করা হয়েছে, তা থেকে বোঝা যায় যে , তখনকার মানুষ ধ্রুব তারার অবস্থান অনুসারে এক এক মাস নির্ণয় করতে পারতেন। বস্তুত: এটিই চীনের প্রাচীনতম পঞ্জিকা। এই পঞ্জিকায় বারো মাসের প্রতিটি মাসে, তারকাপুঞ্জের অবস্থান, আবহাওয়া, উদ্ভিদ এবং করণীয় কৃষিকাজ আর রাজনৈতিক কাজকর্ম বিবৃত হয়েছে। এতে যেমন সিয়া রাজত্বকালের কৃষি উৎপাদনের মান প্রতিফলিত হয়েছে তেমনই চীনের প্রাচীনতম বৈজ্ঞানিক বিদ্যা সংরক্ষিত রয়েছে ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।