কিছুতেই খাপ খাওয়াতে না পারা একজন মানুষ, খাপ খাওয়াতে সদা ব্যস্ত, ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ, কিন্তু হাল ছাড়ছি না। ‘পশু পাখি সহজেই পশু পাখি, তরু লতা সহজেই তরুলতা,
মানুষ প্রাণপণ চেষ্টায় মানুষ’
আজ থেকে ১০ বছর আগে এস এস সি পরীক্ষায় ভাব সম্প্রসারণ পড়েছিলাম, মানুষ হতে গেলে কত কী চেষ্টা করতে হয়। কত ধরণের বিধি নিষেধের বেড়া জাল মেনে চলতে হয় এসব, বয়স তখন অল্প ছিল, নিজের জগৎ ছিল খুব ছোট, সময়ের সাথে সাথে বয়স বেড়েছে, উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের জন্যে সেই ছোট্ট গন্ডি পেরিয়ে গিয়েছি আরো বড় দুনিয়ায়, সেখানে গিয়ে ভালো করে বুঝেছি মানুষ হতে গেলে কী কী লাগে, দুনিয়া যত বড় হয়েছে মানুষ হবার শর্ত তত বেড়েছে। আর তার সাথে নানান ঝুট ঝামেলা তো ছিলই, এসবের মাঝে আমরা বেড়ে উঠেছি, মা বাবা শিখিয়েছেন মানুষ হবার নানান আদব কেতা, কিন্তু এত কিছুর পরেও কোথায় যেন ফাঁক থেকে যায়, আমরা ঠিক ‘মানুষ’ হতে পারি না, আমরা যারা মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত, তাঁদের প্রতিটা ক্ষেত্রে কেবল পরীক্ষা দিয়ে যেতেই হয়। যে অব্দি আমাদের জীবন নিরাপদ না হয়, কিন্তু, জীবন নিরাপদ হতে হতে প্রায়ই মরণ এসে একেবারে নিশ্চিন্ত করে দেয় আমাদের, এই হোল আমাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত জীবনের সাধারণ চিত্র।
আমরা সব কিছুতেই পিছিয়ে, লেখাপড়া, জ্ঞান-বুদ্ধি, স্মার্টনেস ইত্যাদি আমাদের মাঝে খুবই কম, আমরা খাপ খাওয়াতে পারি না কোন কিছুর সাথেই। আমাদের অবস্থা অনেকটা সিঙ্গেল খাটের মত, মাথা এঁটে গেলেও পা বাইরে চলে যায়, একটু চিৎ হলেই বিছানা থেকে ধপাস, আমরা বড় বড় জগৎ খ্যাত লেখকের বইও পড়তে জানি না, দস্তভয়েস্কি, তলস্তয়, গারসিয়া মার্কেজ প্রমুখের জ্ঞানগর্ভ বাণী আমাদের মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়, স্পর্শ করে না। সব কিছুতেই আমরা অপটু, গতর খাটানো কিছুটা পারি বলেই হয়ত দুনিয়া থেকে মুছে যায় নি আমাদের নাম নিশানা, কিন্তু, কিছু লোক ছিলেন যাঁরা চেয়েছেন আমরাও বাঁচি বাঁচার মত, জানতে যেন পারি জীবনের স্বরূপ, বুঝতে পারি সহজে, কাজ তাঁরা করেছেন অক্লান্তভাবে, দেশে দেশে এমন লোক দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন মার্টিন লুথার কিং, আফ্রিকায় নেলসন মেন্ডেলা, এশিয়ায় মাদার তেরেসা, সকলেই মানুষের অধিকার রক্ষায় এগিয়ে এসেছেন, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে।
আমাদের দেশে সেরকম সমস্যা কখনো ছিল না, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য সবসময় ছিল, আরেকটা বিষয় ছিল আজো আছে, পদ্মা নদির মাঝির জেলে পল্লির মত, ‘এখানে যার যার ধর্ম আলাদা, কিন্তু একটা যায়গায় সকলেই এক, সকলেই দরিদ্র’। না আমরা শুধু অর্থের দিক দিয়েই দরিদ্র নই, দরিদ্র আমরা নানাভাবে, সেই দারিদ্র্য ঘোচানোর সামর্থ্য আমাদের নেই, কিন্তু এটা যে আমাদের অহংকার হতে পারে, মুখ না লুকিয়ে বুক উঁচু করে বেঁচে থাকবার প্রেরণা হতে পারে, সেটা সকলের সামনে দ্বিধাহীন চিত্তে যে মানুষটি তুলে ধরেছিলেন তিনি হুমায়ূন আহমেদ, আমাদের বসার ঘর থেকে শুরু করে রান্না ঘর অব্দি তিনি পাঠক দর্শকদের ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন সূক্ষ্ম রসের ধারা, সে ধারায় আমরা অবগাহন করেছি, মোটা মলাটের ভারি বই পড়বার ‘জ্ঞান’ আমাদের নেই, দর্শনের উচ্চস্তরে পৌঁছুবার বোঝা বইবার কাঁধও আমাদের ছিল না, তিনি সেটা বুঝতে পেরেছিলেন, তাই আমাদের অন্তরকে নাড়া দিয়েছেন হিমু সৃষ্টি করে, তার নানাবিধ অদ্ভূত এবং এলেবেলে কান্ড কারখানার মধ্য দিয়ে আমাদের নিয়ে যেতে চেয়েছেন বাঁধন হারা পৃথিবীতে, আবার বল্গা হরিণের মত অতি আনন্দে যেন বোধ না হারাই তার জন্যে এনেছেন মিসির আলিকে, জীবনের ঘাত প্রতিঘাত সইতে যেন পারি আমরা, যুক্তি তর্ক বিচক্ষণতার যায়গাও আমাদের করে দিয়েছেন, সমাজের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে শিখিয়েছেন শ্রাবনের জলধারায় ভিজতে, জোছনার টানে ছুটতে শিখিয়েছেন বনে, স্বপ্নের বীজ বুনেছেন মনের গহিনে, সে যেদিন মহিরুহ হয়ে উঠলো মানুষ তো নিজেই চমকে গেল, তার এসব চেষ্টাকে অনেক ‘জ্ঞানী’ বলেছেন ফালতু, অর্থহীন, বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যহিন, অতি সস্তা, হুমায়ূন কান দেননি, দেননি বলেই হয়ত দেশের তরুণ প্রজন্মের বড় অংশ মাদক, নোংরা রাজনীতি, নৈরাজ্য থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখতে পেরেছে, মোটা চশমাওয়ালা, মোটা বই পড়নেওয়ালা, মোটা মোটা জ্ঞানগর্ভ কথা বলা লোকেদের কাছে তিনি সবসময় চক্ষুশূল ছিলেন, নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্তরাও তো সমাজের উঁচুতলার মানুষের কাছে ঐ রকম।
হুমায়ূন শিখিয়েছেন ঐ সিঙ্গেল খাটেই নিজের সাথে আরো অনেক কিছুই এঁটে যেতে পারে, কল্পনার ময়ূরাক্ষী নদি বের করে এনে আমাদের তার টলটলে স্বচ্ছ জলে সাঁতার কাটবার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, সেই মানুষটা সশরীরে আমাদের মাঝে আর নেই, এটা বেদনাদায়ক, এই শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে তিনি তো ছিলেন, সকল ঝড় মাথায় নিয়ে হাসতে শিখিয়েছিলেন, বিপদে বুকে বল নিয়ে লড়াই করবার সাহস যুগিয়েছিলেন, শুধু নিজে নয় অন্যকেও হাসাতে দীক্ষা দিয়েছিলেন, তিনি প্রস্থান করে গেছেন, তার স্বপ্নেরা যায় নি, আমরা আজীবন হুমায়ূন আহমেদকে লালন করব, তার মত করে হাসি খুশিতে মেতে থাকব, এটা হয়ত তাঁকে অন্যলোকে শান্তি দেবে, সেটাই হয়ত তাঁর চাওয়া ছিল। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।