আমি একাই পৃথিবী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম http://www.facebook.com/kalponikvalo তখন মাত্র কলেজে উঠেছি। ফার্স্ট ইয়ার ড্যাম কেয়ার স্লোগান মেনে এগিয়ে চলছে জীবন। এক্যুরিয়ামের ছোট মাছকে পুকুরে ফেললে যেই অবস্থা হয়, আমারও অবস্থা হয়েছিল অনেকটা সেইরকম। নতুন স্বাধীনতার স্বাদে নিজেকে বড়ই বেপরোয়া লাগে।
মনে প্রবল একটা প্রেম প্রেম ভাব। 'মন কি যে চায় বলো, যারে দেখি লাগে ভালো' টাইপের একটা অতি জটিল সমস্যা দেখা দিল। এই জটিল সমস্যার কারনে আমি সহ অতি অল্প কয়েকজন বাদে সবাই তাদের পছন্দের মানুষ মোটামুটি ঠিক করে ফেলল। আমাদের পরিনতি হলো কলেজের বাগানে বসে উদাস নয়নে প্রেমের কোন অখাদ্য কবিতা লেখা, কিংবা মোটামুটি অখ্যাত কোন কবির বিরহের কবিতাকে নিজের বলে চালানো।
একদিন শুনলাম ক্লাসে নাকি নতুন একটা মেয়ে আসবে।
নতুন ভর্তি হয়েছে। শুনলাম মেয়ে নাকি অতি রুপবতি। আমরা যারা বিরহের কবিতা লিখে কিছুটা কাতর, তাদের জন্য এই খবর কিছুটা ঈদের খুশির বার্তা নিয়ে এল। ঘোষনা দিলাম, এই নতুন মেয়ের দিকে কেউ যদি চোখ তুলে তাকায় তাহলে খবর আছে। আমার এই হুংকারে বাকিদের মধ্যে কিছুটা প্রতিবাদী মনভাব তৈরী করলেও আমার সাইজের কারনে তাদের সেই প্রতিবাদ ছাই চাপা আগুনে পরিনত হল।
পরদিন সকালে অনেক আগে কলেজে চলে এলাম। এসে একটা সুন্দর সিট বেছে নিলাম। আমার পাশে কাউকে বসতে দিলাম না। আমাদের কলেজে ছেলে মেয়ে একসাথে বসত। যে যেখানে সিট পায় সে সেখানেই বসত।
ক্লাস শুরু হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এখনও মেয়েটি আসছে না। আমি তো আমার পাশে কাউকে বসতে দিচ্ছি না। আশেপাশের সব সিটই ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। কিছুটা উৎকণ্ঠিত হলাম। তারপর হঠাৎ দেখি ক্লাসে একটা লুতুপুতু টাইপের একটা মেয়ে প্রবেশ করল।
মাঝখানে সিথি করা, চুলে দুটো বেনী করা, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। অতি মাত্রায় ফর্সা। যাই হোক, যারা আমার হুংকারে কিছুটা প্রতিবাদী ছিল, তারা অতি উৎসাগের সাথে সেই মেয়েকে আমার পাশে এনে বসাল। আমি তো কিছুটা বাকরুদ্ধ। ফাজিল ছেলেপেলেগুলোর হাসি আমার গায়ে তীরের মত বিঁধতে লাগল।
মনে মনে যতই আশা হত হইনা কেন, একটা মেয়েকে তো আর সরাসরি অবহেলা করা যায় না। তাই কিছুটা হেসেই নিজের পরিচয় দিলাম। মেয়েটাও দেখি হাসি দিয়ে পরিচয় হল, নাম স্বর্না। ক্লাসের ফাকে স্বর্নার সাথে তেমন আর কথা হলো না।
এর পরের পিরিয়ডে একটা সারপ্রাইজ ক্লাস টেস্ট ছিল।
পরীক্ষা শুরু হলো। হঠাৎ দেখি স্বর্না ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম কাঁদছ কেন? স্বর্না জবাব দেয়ার আগেই জামাল স্যার অনেকটা উড়ে আমার কাছে চলে আসলেন। এসেই কঠিন একটা ধমক দিয়ে বললেন, 'কি রে হিরো, ক্লাসের ভিতরেই ইভটিজিং শুরু করেছিস? পড়াশুনা তো কিছুই করস না। এই মেয়েকে কি বলেছিস?'
নতুন একটা মেয়ে সহ ক্লাসের অন্যান মেয়ের সামনে এই অপমান কি সহ্য করার মত! আমি কিছুটা রাগত স্বরে বললাম, ' আমি কি জানি স্যার, আমি তো লিখছিলাম, ওর কান্না দেখে আমি তো আরো জিজ্ঞেস করলাম কেন কাঁদছে?'
স্যারও ঘটনা জিজ্ঞেস করলেন।
ঘটনা যা জানলাম তা হলো, গত ক্লাসেও তার সাথে কেউ পরিচয় হয়নি, এই ক্লাসেও কেউ তার সাথে পরিচয় হয়নি। তাছাড়া পরীক্ষার ব্যাপারে তার কোন প্রিপারেশন নেই। আমি নাকি কোন সাহা্য্যই করছি না। এমন মহা নেকামির সাথে আমি পরিচিত ছিলাম না।
সব শুনে আমার মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হলো আর স্যার কিছুটা হতাশ হলেন।
আমাকে বকা দেয়ার একটা মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া হওয়াতে তিনি কিছুটা হতাশ এবং বিরক্ত। যাই হোক সেইদিন থেকে আমরা স্বর্নার সাথে পরিচিত হলাম। আমাদের বন্ধু মহলে তার নাম হলো, নেকা স্বর্না।
আসলে স্বর্না ছিল বাবা মা এর একমাত্র মেয়ে। তার বাবা বেশ ভালোই বড়লোক।
ধনীর দুলালী বলতে যা বুঝায় ও ছিল ঠিক সেই রকম। অতি আহলাদের মানুষ হওয়ার কারনে তার মধ্যে নেকামীর মাত্রা ছিল ভয়াবহ। একসময় যদিও এটা সবার গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আমার মত একজন মানুষের জন্য তা সহ্য করা সহজ ছিল না। তার নেকামী দেখলে আমি কিছুক্ষন পর পর মাথায় গিয়ে পানি দিয়ে আসতাম। আমি জীবনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, স্বর্না নামের কোন মেয়ের সাথে আমি আর কথাই বলব না।
তার দু'একটা নেকামীর উদহারন আপনাদের বলি। আমারা বিকেলে কলেজ শেষ হবার পর অংক স্যারের কাছে পড়তে যেতাম। একদিন স্যারের বাসায় পড়তে গেলাম। খুব সম্ভবত সেদিন সে একটা নতুন জামা পড়ে এসেছিল এসেই একে ওকে জিজ্ঞেস করতে লাগল, ড্রেসটা কেমন হয়েছে। যে কয়জন মেয়ে ছিল তারা কেউ হেসে বা কেউ মন্তব্য করে তাদের মতামত দিল।
হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করল, কেমন হয়েছে? আমি অংক করছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম কি কেমন হইছে?
পাশে থেকে সুমি আমাকে চিমটি কেটে বলল, 'আরে স্বর্না একটা নতুন ড্রেস পড়ে এসেছে। সেটার কথাই বলছে। '
আমি সাথে সাথে বললাম, 'ও নতুন জামার কথা বলছ? সর্যি বুঝতে পারি নাই। '
'তুমি বুঝতে পারছ না? আমাকে কেমন লাগছে তোমরা তো নিজে থেকে কেউ কিছু বললে না।
আমি সবাইকে জিজ্ঞেস করার পর না আমাকে বললা। ' এই বলেই স্বর্না ওড়না দিয়ে চোখের কোন মুছল। তারপর দেখি ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে তার বাবাকে ফোন দিল। ফোন দিয়ে ন্যাকা ন্যাকা স্বরে বলতে লাগল, ' বাপি বাপি জানো, আমার এই নতুন ড্রেসটা না কেউ পছন্দ করে নি। কেউ খেয়ালই করেনি যে আমি নতুন জামা পড়েছি।
'
এই বলে আবার দু'ফোটা চোখের জল। আমি উঠে গেলাম। উঠে মাথায় পানি দিয়ে আসলাম। এই মেয়ে পাশে থাকলেই একটু পর পর মাথায় পানি দিয়ে আসতে হয়। আমি নিশ্চিত সামনে আমার কঠিন ঠান্ডা লাগবে।
আরেকবার, আমরা টিফিন পিরিয়ডে বসে আসি। দেখি স্বর্না তার টিফিন খুব যত্ন নিয়ে বের করল। দেখলাম আসে পাসে সবাইকে খাওয়াচ্ছে। পায়েসের মত পাতলা কি যেন একটা। একটু হলুদ রং এর।
আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এল। ' এ্যাই, এটা খাও। আমি বানিয়েছি। '
' কি এটা?'
'আরে খেয়েই দেখো, আমার বাপি বলেছে এর চেয়ে মজার খাবার তিনি আর কখনও খান নি'
'বুঝলাম, ঠিক আছে কিন্তু জিনিসটা কি? পায়েস হলে আমি খাব না। আমি পুডিং হলে খেতাম।
'
হঠাৎ করে চোখের সামনে সামনে দেখলাম স্বর্নার ৩২ পাটি বাঁধানো দাঁত। আহলাদে গদ গদ হয়ে বলল, 'এটা তো পুডিংই। তোমার ইচ্ছা পূরন হয়েছে। নাও তুমি এটা শেষ করে ফেল। '
আমি চোখে মুখে অন্ধকার দেখলাম।
এই জিনিস দেখেই আমার অখাদ্য মনে হচ্ছিল। মনে মনে ভাবছিলাম এটা খেতে হলে মারা যাব। আমি চোখমুখ কঠোর করে বললাম, আমার পেট খারাপ স্বর্না। আমি কিছুই খেতে পারব না।
ব্যাস আবার কান্নাকাটি, বাবাকে ফোন।
আমাদের ক্লাসের সুমী নামের একটা মেয়ে ছিল। মাস্তান টাইপের। আমাকে এসে কঠিন ধমক দিয়ে বলল, 'তুই এটা খাবি। একটু খেলে কিছু হবে না। যদি না খাস তাহলে তোকে আমি এর চেয়েও খারাপ জিনিশ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করব।
'
কি আর করা, বাধ্য হয়েই খেতে হলো। আমার মনে হল আমি কাঁচা ডিমের সরবত খাচ্ছি। সুমীর কঠিন চাহুনী এবং স্বর্নার নেকামীর কান্নার কথা মনে করে আমি কোন মতে গিলে ফেললাম।
মনে মনে আবারো প্রতিজ্ঞা করলাম, স্বর্না থেকে আমি ১০০ হাত দূরে থাকব।
এই ছিল আমাদের স্বর্না।
পরবর্তীতে আমিও অনেক জ্বালিয়েছি। ইউনির্ভাসিটি উঠার পর আমাদের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। প্রথম প্রথম অনেক খুশি হলেও পরে আমরা তাকে অনেক মিস করেছি। আমরা বন্ধুরা আড্ডায় বসে এখনও তাকে অনেক মিস করি।
-----------------------------------------------------------------------------------
***যদি উপরের গল্প ভালো লাগে তাহলে এই অংশটুকু পড়ার দরকার নেই।
***
ছোট গল্পের কথাঃ
গুলশান ২ এর মোড়। অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে কিছু না পেয়ে ফুটপাত দিয়ে হাটা দিলাম। ল্যাব এইড এর সামনে আসার পর শুনলাম কে যেন ডাকছে। পিছে ফিরে তাকাতে দেখি গাড়ির ভিতর থেকে একটা সুন্দরী মেয়ে আমাকে ডাকছে। কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম।
ভাবলাম, এখন কত উপায় এ না ছিনতাই হয়। এই মেয়ে আবার তেমন কেউ না তো। ভালো করে চেয়ে দেখি আরে এটা তো আমাদের স্বর্না। অনেক পরির্বতন হয়ে গিয়েছে। আগের চাইতে অনেক সুন্দর হয়ে গিয়েছে।
অনেক দিন পর দেখা পেয়ে খুব ভালো লাগল। অনেকক্ষন কথা হলো। তবে অবাক হলাম, স্বর্না অনেক প্রাক্টিক্যাল হয়েছে। কথাবার্তায় আগের মত নেকামী ভাব নেই। জিজ্ঞেস করলাম বিয়ে শাদী হয়েছে কিনা।
এই প্রশ্নে কিছুটা চুপ হয়ে গেল। তারপর বলল, ও প্রেম করে বিয়ে করেছিল। কিন্তু ছেলেটা মোটেই ভালো ছিলনা। স্বর্নাকে অনেক অত্যাচার করত। যৌতুকের কারনে ওর গায়ে পর্যন্ত হাত তুলত।
কয়েক বছর আগে, ওর হাসবেন্ড ওকে প্রেগনেণ্ট অবস্থায় পেটে লাথি মারে। ওর মিস ক্যারেজ হয়ে যায়। বাবা মাকে কিছুই বলেনি সে। বেশ কিছুদিন আগে ওদের ডির্ভোস হয়ে যায়।
স্বর্নার ছোট মামা থাকে আমেরিকায়।
সেখানে চলে যাচ্ছে ও। আমি ওর হাসবেন্ডের ঠিকানা জানতে চাইলাম। প্রচন্ড রাগে আমার গা কাপছিল। স্বর্না মৃদ্যু হেসে বলল, দরকার নেই। একজন বোকা মেয়েকে সে মানুষ করতে পেরেছে, এই বা কম কিসের।
একজন নরম মেয়েকে সাহসী করতে পেরেছে, এই জন্যই তার সব দোষ মাফ।
যখন বিদায় নিচ্ছি , স্বর্না হেসে বলল, তোদের সবাইকে অনেক পেইন দিসি আমি তাই না। তাই মনে হয় একটু শাস্তি পেলাম। অবশ্য আমার শাস্তির দরকার ছিল। বাবা মা এত আদরে মানুষ করেছে, বাইরের জগৎ সর্ম্পকে কিছুই জানতাম না।
তাই তো আমার সাথে এমনটা হয়েছে। তুই ভালো থাকিস। আর তোকে রাগাতে আমার খুব মজা লাগত।
এরপর স্বর্না চলে যায়। আমি রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকি।
প্রচন্ড খারাপ লাগা শুরু হয়। মনে হয়ে, স্বর্না নেকামী তোকেই ভালো মানাত। তোকে কঠিন মানাচ্ছে না। আবার আগের মত হয়ে যা। এত কঠিনভাবে কঠিন হবার কোন মানে নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।