রাজা
আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, নাগরিক ডিসকোর্সে ঢাকাই ছবির নায়কেরা উপেক্ষিত। বাংলাদেশের সিনেমাকাশে পপুলার চলচ্চিত্র নক্ষত্রদের পতন হয়েছে বেশ আগেই।
কিন্তু চিত্রনায়ক এম এ জলিল অনন্ত যখন প্রায়-বিস্মৃত ছেঁড়াখোঁড়া সিনেমার পোস্টার থেকে দু’হাতে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে উড়ে এসে জুড়ে বসেন প্রাত্যহিক সংলাপে, পত্রিকা-টক শো, ফেসবুক-ব্লগ, মায় প্রতিবাদ পোস্টারে; তখন এই ইন্টারটেক্সুয়াল উপস্থিতি অস্বীকার করা কঠিন বৈকি! অবিরত যখন বাংলাদেশে প্রেক্ষাগৃহ ভেঙ্গে তৈরি হচ্ছে শপিং মল, বড় রূপালী পর্দার আচ্ছন্ন আকর্ষণের বদলে দর্শক ভিনদেশী সিনেমা দেখার জন্য সাধ্যানুসারে বেছে নিয়েছেন টিভি, পিসি, ল্যাপটপের ছোটপর্দা; তখন উপেক্ষিত নায়কের প্রত্যাবর্তন কেন হয়? কীভাবে হয়? কীভাবে অনন্ত জলিল অনর্থ বাঁধাচ্ছেন বলে মনে হলেও, আবার অর্থও (সবধহরহম) তৈরি করেন?
মুনাফা, বিনোদন, কিম্বা জীবনযাপনের জন্য কোন বৃহৎ-বয়ান তৈরি করার যে ক্ষমতা এফডিসি-কেন্দ্রিক বাংলাদেশের ফিল্ম ইন্ড্রাস্টির কম-বেশি মাত্রায় একসময় ছিল, এখন তা নেই। অতি সম্প্রতি শিল্প বলে ঘোষিত হওয়া দীর্ঘদিনের অবহেলিত এই খাতে বৃহৎ বা মৌলিক কোনো উৎপাদনের বদলে প্রধানত চোরাই মাল ও নকল সংস্করণের ব্যবসা চলে। এই বাজারে গ্রেসামের সূত্র ধরে (ইধফ সড়হবু ফৎরাবং ড়ঁঃ ঃযব মড়ড়ফ) অন্য-সম্ভাবনার নির্মাতারা বিতাড়িত হয়েছেন।
সুতরাং ভালো বাজারী সিনেমার জন্যও যে কাঁচামাল, উৎপাদন উপকরণ ও কর্মী দরকার তাতে ঘাটতি চলছে দীর্ঘকাল। স্বাভাবিকভাবেই এই ঘাটতি নায়ক নির্মাণেও ঘটেছে।
জনপ্রিয় ধারার চলচ্চিত্রে নায়ক অপরিহার্য উপাদান। চলচ্চিত্রের অন্যান্য ধারা নায়ক-কেন্দ্রিকতার বদলে যেভাবে একাধিক প্রটাগনিস্ট উপস্থিত করে; সেখানে পপুলার নায়ক ছাঁচে-ঢালা পৌরুষের প্রতীক। তিনি এমনকি পুরুষের চেয়ে পুরুষালী।
একেবারে পুরুষোত্তম। বাস্তব জীবনে পুংলিঙ্গের যে বিভিন্নতা, যে নানা মাপের আকৃতি-প্রকৃতি, ভীতি-দুর্বলতা; পুরুষোত্তমের তা থাকতে নেই। তার থাকে অতিশক্তি। দুষ্টের দমনে তিনি একাই একশো। বিশেষত এ উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্রে পপুলার নায়ককে দেখা যায়, নীতির প্রশ্নে যুধিষ্ঠির, অস্ত্র-দক্ষতায় অর্জুন, বাহুবলে ভীম, রমণীমোহনে কৃষ্ণ, চেহারায় কন্দর্প, নৃত্যগীতে গন্ধর্ব।
যে পুরুষোত্তমকে পৌরাণিক কাহিনীও নির্মাণ করতে পারে নি, প্রযুক্তি ব্যবহারে জনপ্রিয় সিনেমা সেই একনায়কে সর্বগুণ সমন্বিত করতে পারে। এই নায়ক-নির্ভর নির্মাণ থেকে বাংলাদেশের ফর্মুলা ফিল্ম কখনো বেরিয়ে আসেনি।
মোটা দাগে বললে, বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ের পালাবদলে, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়েও, জনপ্রিয় ধারার নায়কেরা জনগণমনে কোনো না কোনোভাবে অধিনায়ক হয়েছেন বলেই তারা জনপ্রিয় ছিলেন। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে নায়কের ভূমিকায় ছিলেন গ্রাম থেকে প্রথম শহরে পদার্পণ করা নব্য মধ্যবিত্তের ফার্স্ট-ক্লাস-ফার্স্ট হওয়া, শুদ্ধ বাংলা বলা চরিত্র। অথবা, তখনও আদর্শ গ্রামীণ জীবনের রোমান্টিকতা পুষে রাখা লোককাহিনীর নায়ক।
সংঘর্ষ মূলত ছিল শহুরে ধনী কিম্বা গ্রামীণ অভিজাত কোনো পিতৃতান্ত্রিক চরিত্রের সাথে আদর্শবাদী নায়কের। আরও ছিল, যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবার গড়ে ওঠার ক্ষেত্র হিসেবে প্রেমের রোমান্টিকতা, যৌথ পরিবারে নায়িকাকে কেন্দ্র করে নানাবিধ কলহ, ও পরবর্তী কালে সংঘাত নিরসক মধুর মিলন। প্রধানত রাজ্জাক, কিছুমাত্রায় আজিম ও অন্যান্যরা এই নায়ক কাঠামোকে দেহ দিয়েছেন। সত্তুরের দশকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পর্দায় এসেছেন একটি নতুন দেশ ও জাতি গঠন আর অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে, নতুন সুবিধাবাদী একটি শ্রেণী গঠনের সময়ে, তখনও মূল্যবোধ ও আদর্শ আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টায়, ‘আমরা নষ্ট হয়েছি কিন্তু পচে যাইনি’ বলা অস্থির নায়কেরা। এই পরিবর্তন চলতে থাকে আশির দশক পর্যন্ত।
রাজ্জাক তখন গু-া, সোহেল রানা আইনে বিশ্বাসী, আর ফারুক লাঠিয়াল। একইসাথে পারিবারিক জীবনের স্থিততা ধরে রাখার রূপায়ণ করে গেছেন আলমগীর-প্রবীর মিত্ররা। এরমধ্যে আমদানী বন্ধ থাকলেও বিশ্ববাজারের প্রভাব পড়েছে সিনেমায়। হলিউডের হাত ধরে এ্যাকশনে গেছে বলিউড। উন্মুক্ত আকাশ আর মাটিতে ভিসিআর পরিচিত করে তুলছে মারদাঙ্গা হিরোদের।
সুতরাং ঢালিউডের ফিল্মি-দুনিয়াতেও প্রয়োজন হয়ে পড়েছে ‘সামাজিক-এ্যাকশন’ ছবির। একদা খলনায়ক জসীমও তখন ‘ফাইটিং হিরো’ হয়েছেন। মাঠে নেমেছেন বাপ্পারাজ। নব্বুই দশকে এসে গ্রামীণ দারিদ্র্যে আরও প্রকট হয়েছে, সাবসিসটেন্ট অর্থনীতিতে ভাঙ্গণ ধরেছে। অসংখ্য মানুষ শহরমুখো হচ্ছে উন্নতি লাভের জন্য নয়, স্রেফ বেঁচে থাকার প্রয়োজনে।
এদের বসবাস বস্তিতে। জীবিকা অনিশ্চিত। ক্রোধ অনেক, কিন্তু প্রকাশের সুযোগ নেই। এ সময়ের বস্তিবাসী রাগী নায়কের মধ্য দিয়ে সে ক্রোধের কিঞ্চিত বিমোক্ষণ (ঈধঃযধৎংরং) ঘটে। মাঝে মাঝে সালমান শাহ-নাইমের কিশোর প্রেম, কিম্বা ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ প্রণীত প্রেমের প্রশ্নে অকুতোভয় নারীনির্মাণ থাকলেও এসময়ে মূলত এই রাগী নায়কেরা পর্দায় দুর্নীতিবাজ পলিটিশিয়ান-পুলিশ থেকে ধর্ষক চোরাকারবারীদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন একাই।
পর্দায় নিজেরাও নানাধরনের সন্ত্রাসমূলক কিংবা অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য হলেও ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’ এই নীতি থেকে নায়কের বিচ্যুতি ঘটেনি। বলিউডের একই ধারার সিনেমায় অমিতাভ বচ্চনের মতো ঢালিউডে এসময়ের নায়কের প্রায় একক প্রতিমূর্তি ছিলেন মান্না।
নতুন শতাব্দীর শুরু থেকে ক্রমাগত নায়কোচিত এই স্থানে শূন্যতা চোখে পড়ে। মান্নার মৃত্যু সেই শূণ্যতাকে প্রকট করে আরও। ইতোমধ্যে ‘অশ্লীলতা বিরোধী’ আন্দোলন ও সম্মার্জন শুরু হওয়ায়, অন্যদিকে ‘অশ্লীলতা-হীন’ অথচ পপুলার সিনেমা নির্মাণের অন্যান্য শর্ত যথাযথভাবে উপস্থিত না থাকায়; সিনেমার পর্দা কোনো শক্তিমান নায়ক ইমেজ আর উপহার দেয় না।
একদা সর্ব-সমস্যা-সমাধানে-সক্ষম নায়কের অথরিটি ক্ষুন্ন হয়। দেশী নায়ক বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যান, কিন্তু দর্শকের সম্মিলিত মানসে ‘মেড ইন বিশ্ববাজার’ মার্কামারা নায়কের মানসপ্রতিমা তৈরি হতেই থাকে। সেই নায়ক হলিউডী ইংরেজী বলিয়ে চৌকষ, বলিউডী পেশীপ্যাকসমৃদ্ধ দেহী, কুংফু-কারাতে-বন্দুকযুদ্ধে এক্সপার্ট। মনোযোগহীন এফডিসি টিম টিম করে জ্বলতে থাকে। দুর্বল-বাজেটের অধিকাংশ পকেটে পুরে, আগ্রহহীন নগর-দর্শকের অগোচরে, নায়কপ্রতিমরা আসে যায়; কিন্তু হিরোর আগমন ঘটে না।
নায়ক-অভিলাষী দর্শকের এই দুঃসময়ে ত্রাণ নিয়ে হেলিকপ্টার থেকে অবতরণ করলেন ‘এ্যাকশন হিরো অনন্ত জলিল’। আগ্রহী অডিয়েন্সের স্পেকটেক্যালে দর্শনের (এধুব) জন্য নিজেকে প্রদর্শন করলেন। কিন্তু ইতোমধ্যে নির্মিত সুপারহিরোর ছাঁচের কাছে তাকে আর নায়কোচিত মনে হলো না অনেকের। তার দেহে স্ট্যালোন-শোয়ার্জনেগার, হৃত্বিক-আমীর খানের পেশীবহুল পৌরুষ নেই। সালমান-শাহরুখের নৃত্যকৌশলের কাছে তিনি তুচ্ছ।
অমিতাভ বচ্চনের মতো খাদে বলা পুরুষালী স্বরের আত্মবিশ্বাস অনুপস্থিত। তদুপরি তিনি ‘ভুল’ উচ্চারণে কথা বলেন। নিকট অতীতে বাংলাদেশের ‘রাগী নায়ক’ মান্নার উচ্চারণ নিয়ে ঠিক এই কৌতুক হয়নি। তার কারণ হয়তো মান্না মূলত পর্দায় নগরের গরীব মানুষের প্রতিনিধি হিসেবেই রেপ্রিজেন্টেড হতেন। কিন্তু, পর্দায় অনন্তের উপস্থাপন এলিট (শিল্পপতি, কর্মকর্তা) সমাজের একজন হিসেবে।
পর্দার বাইরেও তিনি ”এজুকেটেড” বলেই নিজের পরিচয় দেন; অন্য নায়কের সাথে নিজের ভিন্নতা তৈরি করতে চান এই বলে যে, “সাকিব খানের সিনেমা তো রিকশাওয়ালারা দেখে”।
সোশ্যাল-মিডিয়া ও আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগে দর্শক-প্রতিক্রিয়ার অনুধাবন প্রচেষ্টায় আমার ধারণা হলো, দর্শকের কাছে অনন্ত জলিলের সেই অতিপুরুষ হওয়ার প্রত্যাশা তৈরি এবং পরবর্তীতে না হয়ে উঠতে পারাকেই মনে হয়েছে প্রহসন। মনে হয়েছে, নায়কের মানসমূর্তির সাথে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তার সংলাপের অসঙ্গতি নিয়ে তাই ঠাট্টা-তামাশা চলতে থাকে। চায়ের টেবিলে বা ঘাসের আড্ডায় তার অনুকরণ বা অতিঅনুকরণে ‘ই..স..ট..প..’ বা ‘আর ইউ পোম গানা?’ বলা শুরু হয়।
অসঙ্গতি তো সমাজের অন্যান্য অংশেও দৃশ্যমান। নেতা, আইনরক্ষক, বা বুদ্ধিজীবীর মানসপ্রতিমার সঙ্গে বাস্তব জীবনের সংস্করণও প্রায়শই বিশ্বাসঘাতকতা করে। তাই এক হিরোর ক্যারিক্যাচার দিয়েই আরেক প্রধানকে তামাশা করে প্ল্যাকার্ড বানায় শিক্ষার্থীরা। জনসংস্কৃতিতে সিনেমার সংলাপ কথনের অংশ হয়ে ওঠা নতুন কিছু নয়। বাংলায় “এবার তোকে ছেড়ে দেব না শয়তান .. হা হা হা”; হিন্দীতে “আব তেরা কেয়া হোগা কালিয়া,” কিম্বা হলিউডী “আই’ল্ বি ব্যাক” এর মতো অজস্র উদাহরণ মনে করা যায়, যেগুলো কোনো সংলাপ বা চরিত্রকে রীতিমত আইকনিক করে তুলেছে।
সুতরাং ফিল্মীজগতে ঠাট্টা তামাশার মধ্য দিয়েও পপ নায়ক নির্মাণ হতে পারে। দক্ষিণ ভারতীয় সুপারস্টার রজনীকান্তের ব্যাঙ্গাত্মক অথচ বিশাল নির্মাণ তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
অন্যদিকে, অনন্তের মধ্যে অনন্ত সম্ভাবনাময় নায়ক খুঁজে পাবার প্রচেষ্টাও সমতালে দৃশ্যমান। এ নায়ক অনেক টাকা লগ্নী করে, প্রাযুক্তিক শক্তিতে মুমূর্ষ চলচ্চিত্র শিল্পকে জীবনদানের নায়ক। এ নায়ক হিন্দী সংস্কৃতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়িয়ে নায়ক।
এ নায়ক দেশের বাইরে বাস করা বাংলাদেশীর জন্য আত্মপরিচিতি প্রতিষ্ঠার নায়ক। ইতোমধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে তার জন্য সাপোর্ট গ্র“প তৈরি হয়েছে। তাকে উপহাস না করার জন্য আবেদন করা হয়েছে। নায়কের উপহাসকারীরা ভিলেন বলে চিহ্নিত হয়েছেন বা আত্মগ্লানিতে ভুগছেন।
কৌতুক বা সমবেদনা আকর্ষণ, যেভাবেই হোক না কেন, নায়ক অনন্ত জলিলের যে নির্মাণ আলোচনায় আসে তা প্রধানত একক হিরোর হেজামনির মধ্য দিয়েই।
এ নায়ক অনেকের মধ্যে এবং অনেকের সঙ্গে প্রতিদিনের সংগ্রামের একজন নয়। বাস্তবে অসম্ভব, সেই অতিশক্তিমান, অতিপুরুষ, সকল সমস্যার এক এবং অদ্বিতীয় ম্যাজিক সমাধানকারীর ফ্যান্টাসি রয়ে যায় দর্শকের প্রত্যাশা আর সংশয়ে দোল-দোলানো। কৌতুকে-ক্রিটিকে প্রশ্নবিদ্ধ। তাই আর শেষ হয় না প্রকৃত নায়কের সন্ধানে খোঁজ দি সার্চ। তবে, ঢাকার সিনেমা নায়ককে নাগরিক আলোচনা-সংশ্লেষে ফিরিয়ে আনার জন্য অনন্ত জলিল – আপনাকে ‘মোস্ট ওয়েলকাম’।
গীতি আরা নাসরীন : অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।