রাত বর্ণনঃ
আকাশে মেঘ উড়ে উড়ে যায়। ছেঁড়া ছেড়া মেঘ। আর উজ্জ্বল পুর্ণিমা। আলোয় ভুবন ভরা। আকাশ সাদা অন্ধকার হয়ে আছে; অদ্ভুত সুন্দর।
রাত তখন মধ্যভাগে। চন্দ্র চলে গেছে পুর্বাকাশে। পাটালীপুত্রের এক মাথায় কবি কালীদাসের কুটির। কবি কালিদাসের বসতবাড়ী। কিছু কলাগাছ আর ঝোঁপঝাড়ে আচ্ছাদিত সাথে রঙ্গন,চন্দ্রমল্লিকা আর বকুলের মৌ মৌ গন্ধ।
কবি একা থাকেন, একাকী!! তাঁর মনে চিরবিচ্ছেদ। অনন্ত বিচ্ছেদ। মাঝে মাঝে চোখের জল মুছেন। অদ্ভুত সুন্দর তার দেহায়বয়ব। গৌর বর্ণ।
ধুতি আর গায়ে উড়নি আর গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। কবি বয়সের সাথে খেলছেন। লিখে চলেছেন কালীদাস-
ঊড়িছে সারস আর হলুদ পাখি
তোমার আঁচল,
ঊড়ে উড়ে যায়,
আমার মনে দক্ষিনা হাওয়ায়।
পাখিদের ডানা ঝাপটানো আর হু হু দক্ষিন হাওয়া, মেঘহীন আকাশে ঊড়ে উড়ে যায় হাল্কা সাদা মেঘ। লিখতে থাকেন-
দক্ষিন মেঘ উত্তরে যায়
আমি বসে ঘরে,
বন্ধু গেলো দূর বিদেশে
আমি নদীর ধারে।
কান্দে নিশি কান্দে প্রভাত
আর কান্দে রাতের কালো
একা একা বলি তোমায়
বাসি তোমায় ভালো।
লিখে চলেন কবি। নিজের আবেগকে কলমের ডগায় নিয়ে। চোখে অশ্রুজল। হা ! জীবনের দিগন্তে তাকান।
দেখেন নিরন্তর চলে যাওয়া। পিতৃদেব!! চলে গেছেন তাঁকে ছেড়ে। মিলিয়ে গেছেন দিগন্তে। ভালোবাসা চলে যায়। শ্মশানে ছাই হয়ে যায়।
ভালোবাসা ছাই।
সোনালী প্রভাতঃ
চারিদিকে পাখিদের কিচির মিচির। সকাল হয়ে যায়। আলোয় ভুবন ভরা। কবি চোখ মেললেন।
যাবেন নদীর ঘাটে; স্নান সেরে সুর্যদেবের প্রার্থনা সেরে ফিরবেন তাঁর কুঞ্জে। হাটছেন কবি। দক্ষিনা সমীরণ বয়ে যায়। আকাশ নির্চল। নির্বাক।
কবি শান্ত। শুধু পায়ের শব্দ। চারিদিকে ধু ধু ফসলের মাঠ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ভালোবাসা দেখেন শুধু কবি।
নির্ভার নিস্তরংগ সকাল। কবির সকাল। নদীর পারে সুন সান নীরবতা। ঘাটে গিয়ে কবি পানিতে হাত রাখেন। আহা।
কি শীতল। মা গঙ্গা। শীতল জলের দেবী। উত্তর থেকে ভালোবাসা নিয়ে দক্ষিনে যায়। মা ধন ধান্যে বসুমতি।
মা ফসল দাও। বৃক্ষ দাও। প্রান দাও। বাতাস দাও। মা বাঁচিয়ে রাখো।
মা রক্ষা করো। বিড় বিড় করে আওড়ে যান কবি। মায়ের ভালোবাসার কাঙ্গাল কবি।
হাত দিয়ে জল সরিয়ে নেমে যান গঙ্গার কোলে। আকাশে তাকান।
সুর্যদেব এখনো ঊঠেনি। দু হাত উপরে তুলে প্রার্থনার ভঙ্গিতে চোখ মুদে গেয়ে চলেন প্রশস্তিগাঁথা। অবিরাম। অবিচল। একটু পরে হৈ হট্টগোল।
আসছে মানুষ। ধুতি পরনে। পৈতা লাগানো ব্রাহ্মন সব। একজন এসে বললেন-
-মহাকবি মহাকালবধু মাধবিকা স্নান করবেন।
-তথাস্তু।
বিশেষ পালকি থেকে নামলেন মহাকুলবধু মাধবিকা। যেনো চাঁদ নেমে এলো আকাশ থেকে। পায়ের আলোয় উদ্ভাসিত দশদিক। কবি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন। মুখে রাজ্যের নির্লিপ্ততা নিয়ে নেমে আসলেন মাধবিকা।
একটু দুরের ঘাটে। ইশারায় জানালেন। কবি এখানেই থাকুন।
কবি দশ পনেরো হাত দূরে দেখলেন চন্দ্রের আলো। মুগ্ধবিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন।
একোন নারী!! একোন সৃষ্টি। হাজার তারা জ্বল জ্বল করছে যার উঠানে। হা ইশ্বর। রুপে রুপেশ্বরী। তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
দাসীরা করবীপুস্প ছিটাচ্ছে জল আর তার মাঝে স্নান সারছেন মহাকুল বধু মাধবিকা। আহা। চলে গেলেন মহাকুলবধু। রেখে গেলেন কবির মনে দুঃখের পাঁচালী। কবি স্নান সেরে ফিরলেন বসত গৃহে।
সাথে আকন্ঠ পিপাসা। হাহ। এতো রুপ!!
যেতে যেতে মাধবিকাঃ
মহাকুলবধু মাধবিকা যাওয়ার পথে ভাবতে লাগলেন কাকে দেখলেন? দাসীদের জিজ্ঞেস করলেনঃ ওলো দাসী কে ছিলো নদীর ঘাটে।
-মা কবি কালিদাস।
-কবি কালিদাস!
ভাবেন মহাকুলবধু।
আহ কি সুন্দর গৌরকান্তি। যেনো প্রভাত সুর্য। তিনি তো বিগতাযৌবনা। তার যৌবন ছিড়েখুড়ে খেয়েছে রাজা বিক্রমাদিত্য। এখন চেয়েও দেখেননা রাজা।
জীবনটা ঊড়ে গেলো মেঘের মতো। সারাজীবন লাঞ্চনা আর গঞ্জনা আর অত্যাচার। রাজা সুরা-সাকি নিয়ে ব্যস্ত। ভালো করে চেয়ে দেখেনি এই সুন্দর আকাশ-বাতাস-নদী কিংবা সুন্দর সকাল। মাধবিকা আদেশ দিলেন-
কবি কে তাঁর প্রাসাদ থেকে সকালের জল খাবার পাঠানো হোক।
দাসী অবাক হয়ে বললো- তাই হবে মা রাণী। সুর্য তখনো উঠি উঠি করছে। মাধবিকার পৃথিবীকে সুন্দর মনে হলো। বেঁচে থাকাও অনেক আকর্ষনীয় মনে হতে লাগলো। নিজের ঠোঁটে-মুখে হাত বুলাচ্ছেন আর ভাবছেন তিনি যে বিগত যৌবনা! কি দিবেন কাকে? হাহ!!
প্রথম পত্রঃ
কালিদাসের বাড়ীতে পৌঁছে গেলো রাজবধুর জল খাবার।
নানা প্রকার মিষ্টি,ফল-ফলাদি আর একটা করবী ফুল। অবাক কালিদাস। এ যে নিবেদন। কালিদাস নিজেও জানেন তিনিও বিগতযৌবন। তাঁর জীবন শুধু বিরহকাতর।
ভালোবাসা পাগল। লিখলেন কালিদাস মাধবিকাকে-
প্রভাত-করবী শুদ্ধ সুন্দর
আলো ছায়ার খেলা,
নাই-নাই দিন গেলো
ভাংবে মিলন মেলা।
চন্দনের রেখা আঁকা সেই মুখ কল্পনা করে কবি হাসি মুখে বসে রইলেন ঘরের দাওয়ায়। উড়ছে হাওয়া। উড়ছে মেঘ।
কবির প্রিয় মেঘ। আবারো কি মেঘ দুত!!
দিন কাটেনাঃ
মহাকালবধু মাধবিকা বসে আছেন পালঙ্কে। বিগতাযৌবনা নারী ভাবছেন কবি কালিদাস কি লিখলেন? কেন কবির এতো বিরহ? দাসী দীঘল চুলে সুগন্ধী মেখে দিয়ে কাঁকই দিয়ে আঁচড়াচ্ছে আর মহাকুলবধু ভাবছেন কবি’র কথা। আজ পৃথিবী কিংবা অন্য কিছু মাথায় নেই। তাঁর তো আসলে কিছু করার নেই।
এই দাসীরা জানেনা মহাকুলবধু নিজেও দাসী। রাজার রক্ষিতা। তাঁর কোনো সুখ-দুঃখ নেই। রাজার অন্যান্য আদেশের মতো তিনিও আদেশের পুতুল। তিনি রাজাজ্ঞায় নিবেদিত।
তিনি মানুষ না!! নারী মাত্র!! ছিঁড়ে খুড়ে খেয়ে উচ্ছিষ্ট নারীমাত্র। কবির কবিতা তাঁর হাতে। জানালায় চোখ। তিনিতো খাঁচার পাখি-একলা পাখি-সোনার শিকলে বন্ধী অন্ধ পাখি। ডানা ঝাপ্টানো ছাড়া কি করার আছে? রাজার পাখি।
সুখী ময়না পাখি। দিন কাটেনা-দিন কাটেনা-দিন কাটেনা। মনে অশান্তি। আর ডাকে গংগা। মা গংগা।
শান্ত গঙ্গা। স্থির গংগা!!
অভিসার যাত্রাঃ
রাত দ্বিপ্রহরে মহাকুলবধু দাসী সমবিভহরে যাত্রা করলেন কবি কুঠিরের উদ্দেশ্যে। সাথে বিশ্বস্থ দাসী। পাটালীপুত্র নগরী ঘুমে আচেতন। শুধু নগর দ্বারে জ্বলছে মশাল আর প্রহরীর হাঁক-ডাক।
কলাপাতায় বাতাসের শব্দ। কবি কি কোনো বাঁশি বাজাচ্ছেন। আজকে অনেকদিন পর মহাকুলবধুর হৃদয়ে দামামা বাজছে। কাড়া নাকাড়া। মহাকাল্বধু নিবেদন করবেন পুজো-কবি হৃদয়ে।
আর কত ভাগ্যের সাথে পাশা খেলা। আহ জীবন। নগরবাহিরে কালিদাসের কুঠি। নগরদ্বারে রাজকীয় পালকি দেখে প্রবেশদার খুলে দিলো পাহারাদার। দশ বেহারার পালকি হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে কালিদাস গৃহের উদ্দেশ্যে।
নীরব দশদিক। শুধু বেহারাদের হুহুমনা হুহুমনা শব্দ।
প্রথম অভিসারঃ
কবি তার কুড়েঘরে বসে আছেন একা একা। রাতের সৌন্দর্য দেখছেন। এসে থামলো রাজকীয় দশ বেহারার পাল্কী।
নেমে এলেন মহাকুল্বধু মাধবিকা। সোজা কবির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। বললেনঃ
-আমি মাধবিকা।
কালিদাস প্রণাম করলেন বললেন-আসুন! কোথায় বসতে দেই, আমি অভাজন কবি কালিদাস।
-কবি পৃথিবীর সবচেয়ে অভাজন নারী, ভালোবাসা স্পর্শ করেনি আমায়।
শুধু কামনার আগুন ছিঁড়ে খুড়ে খেয়েছে আমায়।
কবি নিরুত্তর। আঙ্গুলের ডগার মাটিতে তাঁর দৃষ্টি। চুপ মেরে থাকেন। মহাকালবধু তাকালেন নিরাবরন কবিগৃহে।
কোনো আড়ম্বর নেই।
-কবি আমি পুজো দিতে এলাম তোমাকে।
-আমি এক অভাজন কবি। পুজোতো আমার প্রাপ্য না মহাকুলবধু। আপনি মহাকুলবধু।
-না আমি মাধবিকা; শুধু মাধবিকা।
কবি স্বগতোক্তি করেন-
চন্দ্র যদি পথ ভুলে
কুঁড়ে ঘরে এলে
শান্ত মন এখন মাতাল
হৃদয় উথাল-পাতাল।
চন্দ্রের শুভ্র আলো এসে পড়ছে কবি গৃহে। এক আলো ছায়ার খেলার আর নিরাভরন এক নারী। খসে পড়লো রাজ আঁচল।
এ আর সেই সকালের শুভ্র চন্দ্র না। এ যে মাতংগ নারী আজন্ম পিপাসা। কবি পুজো নিলেন। শান্ত দশদিক।
কলঙ্ক কাজলঃ
রাজদরবারে ডাক পড়লো।
নগর কোতোয়াল এসে বলে গেলো। রাজা কবির সাথে কথা বলতে চান। যথারীতি কবি রাজ দরবারে উপস্থিত হলেন। নগর কোতোয়াল, সেনাপতি অক্ষয় সেন,রাজজোতিষী সবাই উপস্থিত। কবি শুনলেন অভিযোগ।
রাজা শুধোনঃ
-মহাকুলবধু কবির গৃহে মাঝরাতে কেনো গেলেন?
কবি নিরুত্তর। কবি জানেন এই নপুংসক রাজা পুজো বুঝেনা। সে জানে খেলা! কবি চুপ চাপ। রাজা নির্দেশ দিলেন কবিকে পাটালীপুত্র ছাড়তে হবে। চলে যেতে হবে দীপান্তর।
কবি’র শাস্তি।
অন্তিম যাত্রাঃ
কবি প্রস্তুত হচ্ছেন। দ্বীপান্তরে যাবেন। একা একা থাকবেন। কবিতা লিখবেন।
হঠাত মনে হলো কি হবে আর কবিতা লিখে। তিনি একবারেই চলে যাবেন। মধ্যাহ্নে আসবে রাজকীয় সৈন্য আর সেনাপতি; কবিকে নিয়ে যাবেন দূর দ্বীপে। কবি আবার বিরহে কাতর হলেন। মহাকুলবধু।
পাটালীপুত্র। না তিনি আর বিচ্ছেদ সইবেননা। মাধবিকা আর পাটালীপুত্র নগর ছাড়া তাঁর বেচে থাকা অর্থহীন। পুজোহীন জীবন কবি কিভাবে যাপন করবেন। করবী, রঙ্গ্ চন্দ্র মল্লিকা আর বকুলহীন দেশে তিনি বেঁচে থেকেই কি করবেন? কবিতাহীন জীবন দিয়ে কবি কি করবেন? মাধবিকাহীন জীবন কাকে দেবেন?
তখনো সুর্য উঠেনি।
প্রভাত আলোয় রাঙ্গায়নি দশ-দিক। কবি তাকালেন উঠানে। কেউ নেই। কবি একা। ভাব্লেন এই পৃথিবীতে সবচেয়ে শান্ত স্থির মা গংগা ত তাঁকে ঠাই দেবে।
গংগা বক্ষে আস্রয় নেবেন কবি। তাঁর শব পুড়ে যখন ছাঁই হবে, মা গঙ্গা পরম মমতায় তাঁকে ঠাই দেবে বুকে। প্রেমহীন পৃথিবীতে কি এমন হবে বেঁচে থেকে। মাধবিকাকে ভালোবাসা তাঁর জীবনের পাপ!! না তিনি তো কবি তিনি তো ভালোবাসাই দেবেন।
ঘরের অন্দরে গিয়ে নিয়ে আসলেন ধতুরা ফল।
খুব আরাম করে খেলেন। তারপর বস্লেন দাওয়ায়। আকাশের দিকে চাইলেন। দেখলেন তাঁর প্রিয় মেঘ উড়ে উড়ে যাচ্ছে। তিনি বলতে থাকলেন-
মমাপিচ ক্ষপয়তু নীললোহিতঃ
পুনর্ভবং পরিগত শক্তি রতভুঁঃ
হে সর্বশক্তিমান নীললোহিত শংকর আমাকে যেনো পরজন্ম নিতে না হয়,ভব যন্ত্রনা সইতে না হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।