অপ্রয়োজনে অনেক কথা বলে যাই, কিন্তু বলা হয়না আরো অনেক বেশী কথা- অনেক আপন মানুষদেরকে। তাইতো, এই খোলা চিঠি। হয়তো কারোর চোখে পরবে কোনদিন, যখন আমি থাকবোনা..... তুষারস্নাত এক সন্ধ্যায়
আজ ইউনিভার্সিটি থেকে তারাতারি ফিরেছি, অপেক্ষায় আছি আমার নতুন রুমমেটের। বাহিরে প্রচন্ড তুষারপাত হচ্ছে। বাস থেকে নামে আমার বাসা পর্যন্ত আসতে মাত্র পাচঁমিনিট লাগে, কিন্তু এরই মাঝে আমার ওভারকোট-ব্যাগ সব তুষারে সাদা হয়ে গেল।
মেইন রাস্তায় অতিরিক্ত তুষার জমে যাওয়ায়, ট্রাফিক জ্যাম দীর্ঘ থেকে কেবল দীর্ঘই হচ্ছে যেন। মেয়েটার আসার কথা, বিকেলে। অথচ এখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হতে চললো।
এতো দিন আমি একাই থাকতাম, গত কয়েকমাস হলো অন্য ঘরটা আরেকজনের কাছে ভাড়া দিয়েছি। আগের ভদ্রমহিলা বেশ ভালোই ছিল, জামাইয়ের সাথে ঝগরা করে বাসা ছেড়ে আমার ঘরটা ভাড়া নিয়েছিল।
ঝগরা মিটে যাওয়ায় আবার সে তার স্বস্থানে ফিরে গেল সেদিন। তার ঘর জোড়া লাগলো ঠিকই কিন্তু আমাকে আবার রুমমেট জোগাড়ের ধান্দায় নামতে হলো। হাজারো জাত, ধর্ম, চিন্তার মানুষের সাথে কথা। নানান প্রশ্ন, নানান মতামত, তারপরও মনে হয় এদের মানষিকতা তবু যেন আমার চেয়ে অনেক উঁচু। এরা যেন অনেক সৎ, অনেক স্পষ্টবাদী।
এরা কথা দিয়ে কথা রাখতে জানে। জানে অন্যের চিন্তাধারাকে সম্মান করতে। অন্যের ধর্মের-কর্মের , সংস্কৃতিকে মানতে না পরলে এড়িয়ে যাবার মতো পরোক্ষ অনুমোদন দেয়ার চেষ্টা। কিন্তু আমরা অনেকেই পারিনা তা। বরং কটাক্ষ-সরাসরি ব্যঙ্গ, অথবা সমালোচনা যেন প্রত্যক্ষ অপমানেরই আরেকরুপ।
আমরা এশীয়রা যেন কুটিল বুদ্ধির এক একটা আধাঁর। অপরপক্ষে আফ্রিকানরাও কম যায়না। আর তাই হয়তো বাকি মানুষগুলোকে অনেক সরল, সৎ আর আন্তরিক মনে হয়। কেউ শুনলে, হয়তো আমার আত্নঅহমিকা ভাববে, কিন্তু এটা সত্য দক্ষিন, পশ্চিম আর দক্ষিন-পূর্ব এশীয়দের চাইতে আমরা বাঙ্গালীরা অনেক উচুদরের। যদিও সাধারনভাবে আমাদের, বিশেষ করে বাংলাদেশীদের পরিচয়টা ভারতীয় বলেই ধরে নেয় সবাই।
নিজের দেশটাকে পরিচয় করিয়ে দিতে হলে অনিচ্ছা সত্যেও ভারতকে মাপকাঠি করে বোঝাতে হয়, আমি ভারতীয় না।
বাড়ি ছাড়া হয়েছি, বহু বছর। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে, আরেকটায়, তারপর আরেকটায়। জেলার গন্ডি পেরিয়ে, আরেক জেলায়। এক সময় দেশের সীমানা পেরিয়ে, বিদেশে।
চেনা পৃথিবীর চেনা মুখগুলোকে পেছনে ফেলে নতুন মুখের সন্ধানে। নতুন প্রানের সন্ধানে। এখানে আসার পর জেনেছি অনেক কিছু, পেয়েছি অনেক অচেনা মানুষের ভালোবাসা। দেখেছি মানুষের আসল রুপ, বিশেষত আমার নিজের পরিচিতের গন্ডির মাঝেই। মজার ব্যপার হলো, অভিজ্ঞতা নিতে নিতে ততদিনে আমি অনেকটা পথ পার করে ফেলেছি।
যে পথটা ছিল সবচেয়ে সংকটময়। আজও ভাবি, এখনো যদি কেও আমাকে ঐ পথ দিয়ে চলতে বলে, আমি বুঝি এবারও উত্তীর্ন হতে পারবো না সে পরীক্ষায়। হয়তো তাই আজ কেন জানি মানুষের সাথে মিশতে ভালো লাগেনা। ভালো লাগেনা সামাজিকতার মতো অপ্রয়োজনীয় ক্রিয়াকলাপে অংশ নিতে। মেনে নিতে পারিনা মানুষের কৃত্তিম ভালোবাসার কথা, সহ্য হয়না মেকি হাসি।
তাই তো আজ আর সমাজ-সংসার, পাশে থাকা মানুষদের ভাবনা, কোন কিছুই আমাকে খুব ভাবায় না। কাছে টানেনা এদের ভালোবাসার আহ্বান।
এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি, না পারলে মিথ্যা বলি, কখোনো বা স্পষ্ট ভাষায় সত্যটা বলে দেই। ভালো লাগলে জড়াই, না লাগলে সরাসরি প্রত্যাখ্যান। আমি জানি , এই সমাজ-সংসার, এই পাশে থাকা মানুষেরা অনেক ক্ষমতাধর, আমার প্রত্যাখ্যানে তাদের কিছুই যায় আসবেনা।
তাই তো নিজের এই আচরনে অপরাধবোধটাও কাজ করেনা। আমি তো আর অসহায়-অবান্চিত কেওকে অস্বীকার করছিনা। করছি আমার চেয়ে প্রভাবশালী কারোর সমালোচনা-অবজ্ঞা, অথবা সেসব পারছিনা বলে চাইছি এড়িয়ে যেতে। তবু যেন এই সমাজ নামক অক্টোপাসটা আমার পিছু ছাড়েনা। যতই বোঝে আমি তাদের এড়িয়ে চলতে চাই, তারা ততই আমাকে তাদের কৃত্তিম মায়ার জালে জরাতে চায়।
কেবল ভাবি, আমার মতো একজন না হয় তোমাদের দলে নাইবা রইলো, তাতে কি। তোমাদের কি খুব অপমানবোধ হয়, কোন সামান্য-সাধারন মানুষের অবজ্ঞা পেতে? তোমাদের আলোচনার দাড়িপাল্লায় তো অনেক দামী দামী রত্ন আছে, যারা চায় তোমাদের সান্ন্যিধ্য, গুরুত্ব দেয় তোমাদের দেয়া প্রাধান্যকে। তবে কেন আমাকে তোমারা ছেড়ে দাওনা, একটু একা থাকবার জন্য। নিজের মতো করে থাকবার জন্য।
দরজায় শব্দ হচ্ছে।
বোধ হয়, মেয়েটা এসেছে।
***************************************************
গত সপ্তাহে, ইমেইলে একজনের সাথে যোগাযোগ হলো, সে মেয়ে আসছে টরেন্ট থেকে। এখানে চাকরী করবে। পরিচয়ে জানালো সে মুসলিম, সোমালিয়া থেকে এসেছে, পড়া শোনা করেছে ব্রক ইউনিভার্সিটিতে। আমি জানালাম রুম নিতে হলে অগ্রীম টাকা আমার একাউন্টে ইমেইল ট্রান্সফার করে পাঠাতে হবে।
তার আর্থিক অসুবিধার কথা বিবেচনা করে, তাকে বললাম অন্তত কিছু বর্ণনা দিতে তার ব্যপারে যেন আমি তার কথার উপর আস্থা রাখতে পারি। বারবার ফোন করে তার উপর আস্থা রাখার জন্য অনুরোধ করলো, এবং বললো মুসলিম হিসেবে সে তার ওয়াদা ভংগ করবে না ইত্যাদি। আমি নিজে মুসলিম তাই বলে আরেকজন মুসলিম হলেই অন্ধ বিশ্বাস করবো অথবা, অমুসলিমদের সন্দেহ করবো এধরনের চিন্তা আমার ভালো লাগেনা। তারপরও ভাবলাম আমি যেদিন এখানে এসেছিলাম আগের বাসার ভাড়ার টাকা রেখে নতুন বাসার ভাড়া, অগ্রীম সব পরিশোধ করার টাকা আমার ছিলনা। সেসময় এখানকার একজন বাংগালী ছাত্র আমাকে ধার দিয়েছিল।
সবারই জীবনের একটা ধাপ থেকে আরেকটা ধাপে উঠতে গেলে সম্মুখীন হতে হয় নানা সমস্যার।
তারপর আবার সেসময় আমার রুমের জন্য তেমন সাড়াও পাচ্ছিলামনা। আর শত হলেও একটা মেয়ে আমার উপর আস্থা করে একটা নতুন শহরে আসছে, কেন জানি আর কোন চেষ্টাও করলামনা , তবে আগের বিজ্ঞাপনটা মুছেও ফেললামনা। আসলে ঠিক মেয়েটার কথায় আস্থা রাখতে পারছিলামনা আর পুরোপুরি ভরসাও করতে পারছিলামনা। তারপর আবার তার মোবাইল নেই , সুতরাং কেবল সে ফোন করলেই আমার পক্ষে যোগাযোগ সম্ভব, নইলে না।
মেয়েটা মাসের শেষদিন ফোন করে জানালো, সে পরেরদিন সকালে আসছে, তাই আমি সকালে ক্যম্পাস গেলামনা। সকালে ফোন করে জানালো সে, বিকালে আসবে। অপেক্ষায় রইলাম। মানুষকে বিশ্বাস করার এই এক যন্ত্রনা।
অদ্ভুত হলেও সত্য, সেই মুসলিম মেয়ে আমাকে এক তারিখ সারাদিন বসিয়ে রেখে , আসলোনা।
দুই তারিখেও কেন জানি মনে হচ্ছিল মেয়েটা আসতে পারে তাই ক্যম্পাসে গেলামনা। আমি পেলামনা নতুন কোন রুমমেট। ভাবছি পুরো বাসার ভাড়া টানতে হলে আমি আর কতদিন থাকতে পারবো? তাই তো আবার বিজ্ঞাপনটা দিয়ে দিলাম , নতুন কোন অভিজ্ঞতার আশায়।
হ্যা, আবারো মেইল পড়া, উত্তর দেয়া। লেখা পড়ার পাশাপাশি এই আরেক বিরাট চিন্তা।
বিরাট ব্যাঘাত নিজের গবেষনার কাজে। একবার ভাবি, এই বাসা ছেড়ে দিয়ে নতুন একটা রুম ভাড়া নেব। কিন্তু তাতেও সমস্যা। আমার বেতন দিয়ে এরচেয়ে বেশি ভাড়ার ঘর পাওয়া খুব মুশকিল। সম্ভব কিন্তু সেটা হবে, ক্যাম্পাস থেকে অনেক দুরে, নতুবা অনেকগুলো রুমমেটের সাথে।
নতুবা ছেলেমেয়ে মেলানো কোন বাসা। আমার নিজস্ব কিছু চিন্তাধারা আমাকে কেন জানি মিশতে দেয়না অন্য সবকিছুর সাথে, অন্য সবার মতো করে। তাই হয়তো, আমার এই আমি আজ এরকম!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।