অপ্রয়োজনে অনেক কথা বলে যাই, কিন্তু বলা হয়না আরো অনেক বেশী কথা- অনেক আপন মানুষদেরকে। তাইতো, এই খোলা চিঠি। হয়তো কারোর চোখে পরবে কোনদিন, যখন আমি থাকবোনা..... চার: তুষারের দেশের আদব কায়দা........
ছবি: নেট থেকে সংগ্রহকৃত।
তুষারের দেশে, আমার এক একটা দিন- তিন
আমার নিজের মতো করে বাঁচতে চাওয়াটাই মনে হয় সবচেয়ে বড় সমস্যা, আমার জীবনে। আরেক দিক থেকে ভাবলে এইটাই তো একমাত্র বৈশিষ্ঠ্য যা আমাকে করেছে সবার থেকে আলাদা।
জানিনা, আমার জীবনে এই খামখেয়ালী খারাপ প্রভাব কতটুকু? তবে আমি আমার জীবনের এই দিকটাই সবচেয়ে ভালোবাসি।
"সময়" আমাকে যা করতে বলে আমি তাই করি। অন্য মানুষ শুনলে বলবে- আতলামী। কিন্তু আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য এটি। যখন যেখানে দাড়িয়ে আমার যে সিদ্ধান্ত নিতে মন চেয়েছে, আজ পর্যন্ত আমি তাই করেছি।
বলবোনা আমার করা কাজগুলো সবসময় সঠিক ছিল। তবে ভুল-শুদ্ধের হিসাব করতে যাওয়ার দক্ষতাও কি আমাদের আছে?
হলোই বা ভুল। তাতে কি বা আসে যায়। আর যদি ভুল করেই থাকি, তবে তার মাসুল দেবার ক্ষমতাও আমার আছে। আছে ভুলকে মেনে নিয়ে, আবার নতুন করে শুরু করবার মতো সাহস।
নতুবা, ভুলটাকেই আবার নতুন করে সাজিয়ে সঠিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার মতো মানুসিকতা।
তবে বর্তমানে আমার নেয়া, সিদ্ধান্তের কারনে আমি একটু অস্বস্থিতে আছি। অস্বীকার করবো না। তবে তার চাইতে বেশি কিছুনা। বলবোনা কাজটা ভুল ছিল।
কেননা সেদিন সন্ধ্যায় এ্যলেন যখন আমার দরজার সামনে দাড়িয়ে ছিল, কোন চিন্তা আমি করিনি। ভাবিনি, আজ পর্যন্ত আমার বাসায় কোনদিন কোন ছেলের ঢোকার অনুমতিই ছিলনা। আমি কোন চিন্তা তখনও করিনি, যখন ওকে বলেছিলাম আমার সাথে পরবর্তি কটা দিন থেকে যেতে, যেখানে আমার বাথরুমের দরজা হচ্ছে Sliding Door , তাই lock করার কোন ব্যবস্থা নেই। নেই Bedroom এর বাহিরে-ভেতরে কোন সিটকিনি। কিন্তু তারপরও সিদ্ধান্তগুলো নিজের মনেই এসেছিল সেসময়, তাই সিদ্ধান্তগুলোর উপর আছে আমার অগাধ আস্থা।
আপাদত কেবল একটাই সমস্যা, বেচারী সাড়ে ছফুট লম্বা, তাই সারাক্ষন ঘাড় কাত করে রাখতে হচ্ছে। আর আমি হচ্ছি মাত্র পাঁচ ফুট, আগে কোন দিন নিজেকে এতো খাটো মনে হয়নি, যা এখন হচ্ছে। কেবল এই একটা কষ্ট আমাকে খুব খোচাঁচ্ছে। মনে হচ্ছে কি দরকার ছিল, সেঁধে সেঁধে নিজের খুঁত নিজের সামনে নিয়ে আসার?
এসব ভাবতে ভাবতেই দেখি আমার বাসার দরজায় শব্দ হচ্ছে। এ্যলেন তো নিজের ঘরেই আছে, তবে এসময় আবার কে এলো?
: কি ব্যপার?
: আমরা তোমার ব্যপারে খোজ নিতে এসেছি।
তুমি কি কোন সমস্যায় আছো?
জীবনে একমাত্র পুলিশের সাথে কথা বলতেই কেন জানি ভয় হয়, তারপর যদি আবার নিজের বাসার দরজায় তারা কড়া নেড়ে জানতে চায় আপনার কুশলাদি, তবে তো হলোই। উপরোন্তু বাসায় বসে আছে অপরিচিত একজন যার সাথে আপনার পরিচয় কেবল চব্বিশ ঘন্টা আগের।
মুহূর্তের মাঝে মনে হলো, একি মসিবতে পরা গেল? যতদুর পারলাম স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে ,বললাম-
: না আমি ঠিক আছি।
: তুমি কি সঠিক কথা বলছো? ভয় পাবার কিছু নেই। আমরা তোমার নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই এসেছি।
: না, তোমরা ভুল ঠিকানায় নতুবা কোন ভুল তথ্য পেয়ে এসেছো।
: তুমি কি আমাদের সাথে একটু বাহিরে আসবে?
বলেই দরজা আগলে দাড়িয়ে, আমাকে আড়াল করলো অফিসার দুজন। এবার আমার "আত্বা রাম" খাঁচা ছাড়া হবার যোগার।
: তোমার (Neighbor) পড়শীদের মাঝে কেউ একজন ফোন করে বলেছে, সে তোমার বাসায় একটা ছেলেকে দেখেছে। যা কিনা স্বাভাবিক না।
: ও...। , আমার এক বন্ধু কয়েকদিনের জন্য এখানে থাকতে এসেছে। তোমরা চাইলে তার সাথে কথা বলতে পারো। আমি ঢেকে দিচ্ছি।
: তাহলে, তোমার সেল ফোন বন্ধ কেন?
: আমার সেল ফোন বন্ধ? কই না তো?
: তুমি তোমার কোন ইমেইলের ও জবাব দিচ্ছোনা ।
গত চব্বিশ ঘন্টায় তুমি বাসা থেকে বের হওনি।
: আসলে এসবই coincidence। সবই সঠিক, তবে আমি ঠিক আছি।
: তুমি কি তোমার বাড়িওয়ালার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছো?
: হ্যা, মানে আমার বাড়ি ওয়ালা জানে যে আমি রুমমেট খুজছি, তাই তাকে আর বিশেষ ভাবে খবরগুলো জানানো হয়নি।
: তোমার বাড়িওয়ালার কথা মতে, তুমি খুব রক্ষনশীল।
তোমার বাসায় কোন ছেলে, কোন দিন আসেনা। আর আসবেনা বলেই তাদের বিশ্বাস। তারা তোমাকে চেষ্টা করেছে যোগাযোগ করার কিন্তু তোমার সাথে যোগাযোগ করার কোন উপায় তারা না পেয়ে আমাদের কাছে ফোন করে সাহায্য চেয়েছে। আমরা কি তোমার বন্ধুর সাথে কথা বলতে পারি?
এ্যলেন খুব সম্ভবত কাছ থেকে সব শুনছিল, তাই নিজেই নীচে নেমে এসে কথা বললো , অফিসারদের সাথে। এ্যলেনের কাগজপত্র দেখে, কথা বলে মনে হয় আশ্বস্ত হলো বলেই মনে হয়।
তারপরও ওরা আমাকে বিদায় জানিয়ে যাবার সময়, বার বার আমার কোন সাহায্য লাগলে ফোন করার কথা বলে গেল।
: আমি খুবই দু্ঃখিত। এরকম একটা পরিস্থিতির জন্য। আসলে আমার বাড়িওয়ালা জানে আমি রুমমেট খুজছি, আর তুমি যেহেতু আমার permanent রুমমেট নও তাই আমিও আর তোমার ব্যপারে ওদের জানাইনি। আর ওরা জানে যে আমার বাসায় কোন ছেলে বেড়াতে আসার অনুমতিই আমি দেইনা, সুতরাং ওদের কাছে এটা খুবই অস্বাভাবিক।
: আমি কিছু মনে করিনি। বরং বুঝতে পারছি, তুমি আসলেই আমার জন্য কতটুকু ছাঁড় দিয়েছো, যেটা তোমার বাড়িওয়ালার পক্ষেও মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি।
তবে হ্যা, সেদিন মনে হয়েছিল আসলেই আমার বাড়িওয়ালারা এতো কম বয়স্ক, পার্টিবাজ আর দুজন Live together করলেও আমাকে খুব গুরুত্ব দেয়, এবং Caring। তাই বলে, পুলিশকে ফোন করে আনার কি দরকার ছিল? নিজে এসে আমার দরজায় কড়া নেড়ে জিঞ্জেস করলেই তো হতো?
কি জানি বাবা, এরা কি ভেবে কি করে?
অবশ্য একদিক থেকে ভালোই করেছে। প্রতি মাসে দেড় ডলার দেই, ৯১১কে।
ওদেরও তো কোন কাজ নেই। সুতরাং একটু বেড়াতে আসলো আর কি?
সাময়িক এই জীবনে আমরা কেন এতো দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা করার কথা ভাবি তা আমার বোধগম্য হয়না। তাই তো আমি আমার এই সামনের সময়টাকে বিবেচনা করেই জীবনটাকে পাড় করে দিচ্ছি। তবে একারনেই সেদিন পুলিশের সাক্ষাৎটাও হয়েছিল।
কিন্তু তবু কেউ কি বলতে পারে, অনেক বিবেচনা করার পরও তার সিদ্ধান্ত শতভাগ সঠিক।
আর আমার সাময়িক বিবেচনাহীন কাজগুলোও একেবারে ভুল? হয়তো, মাস ছয়েক পরে আপনাদের মাঝে আমাকে কেউ আমাকে বোকা বলবেন, বলবেন আমার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। আরো অনেক অপবাদ। তাতে কিঅনেক কিছু বদলে যাবে? আমি কেবল জানি, সেসময়ে আমার সিদ্ধান্তটিই সঠিক ছিল। আর ভবিষ্যতে দাড়িয়ে অতীতকে বিচার করাটা কি খুব একটা যুক্তিসংগত?
আর আমি এও জানি, ছ'মাস পরের আপনাদের দেয়া সেই "বিশেষঞ্জের" মতামত, কখোনোই আমার পক্ষে যাবেনা। কিন্তু খেলা শেষে - আমার নির্ধারন করা সিদ্ধান্তটাই সবচেয়ে সঠিক হবে।
কেননা খেলাটা যে আমার।
এ খেলায় হার জিতের চাইতেও বড় যে জিনিস, তা হলো আমার আনন্দ। এখন কি বলবেন। সাময়িক আনন্দটাকে এতো বড় করে বিবেচনা করা ঠিক না। হয়তো ঠিক না।
কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত করে বলতে পারেন আমার জীবনের আজকের এই আনন্দটাই শেষ পাওয়া না? আগামী কালের সূর্য এসে আমার দেখা পাবে?
*************
ছবি: আনন্দের নিজের ক্যামেরা থেকে সংগ্রহকৃত।
: আমার অনেক ভাই-বোন, কারন তোমার কথা মতে আমার অনেকগুলো বাবা-মা। কিন্তু জান? আমার প্রয়োজনের সময় আমার কেউ নাই , এমনকি বাবা-মা ও না।
: ছোটবেলায় দেখতাম, আমার মা নিজেকে "সিংগেল মাম" হিসেবে পরিচয় দিতেন। যদিও আমার বাবা কে, তা আমি জানি।
তার সাথে আমার একবার দেখা হয়েছে। আমার বাবা তার স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে থাকতেন ওটোয়াতে। আমাকে কখোনো সাথে থাকার কথা বলেননি, যোগাযোগও করেনি তারপর। আর আমারও কোন আগ্রহ হয়নি।
: আমার মায়ের কাছ থেকে শুনেছি, তার আগের স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ির পর উনি বহুদিন একাই ছিলেন।
সেসময় উনাকে আবার তার আগের স্ত্রীর তিন ছেলেমেয়ের খরচ দিতে হতো। আমার মায়ের সাথেসেসময়ই পরিচয়।
আমার বাবা-মা বিয়ে করেনি। আমার মা ছিলেন তার দ্বিতীয় গার্লফ্রেন্ড।
: আর আমি আমার মায়ের কাছে থাকতাম, টরেন্টোতে।
আমার মা, তার বয়ফ্রেন্ডের পরিবারের সাথে। পরিবার বলতে, আমার স্টেপ সিস্টার, আর একজন হাফ ব্রাদার আর একজন হাফ সিস্টার।
এ্যলেনের কথাগুলো শুনতে শুনতে মনে হলো, এ যেন অন্য গ্রহের মানুষ। আমার বাবা-মা, ভাই-বোন ঘেরা জীবন যেন এর সাথে মেলেনা। আমি তো কেবল ভাই-বোন, ভাবী-দুলাভাই নামক সম্পর্কগুলোর সাথে জড়ানো।
বেশি হলে স্টেপ সিস্টারটা পর্যন্ত বুঝলাম। কিন্তু এই হাফ ব্রাদার আর হাফ সিস্টারটা আবার কি? মনের মাঝে ঘুরতে থাকলো এই নতুন পরিচয় হওয়া শব্দগুলো।
: কিন্তু আমার মায়ের পরের বয়ফ্রেন্ড- আর তার ছেলেমেয়েদের আমার ভালো লাগতোনা। তারাও আমাকে পচ্ছন্দ করতোনা। অসহ্য ছিল সেই জীবন।
কয়েক বছর বাদে, আমার মায়ের সাথে লোকটার মতের অমিল হয়, তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এই ছাড়াছাড়ির মূল কারন ছিলাম আমি।
: আমার উপস্থিতি ঐ পরিবারের কেউই পচ্ছন্দ করতে পারছিলনা। তখন আমি একটা হোটেলে কাজ করতাম, পার্ট টাইম। তা দিয়ে আমার হাত খরচ চলে যেত।
কিন্তু থাকার জন্য একটা জায়গার ব্যবস্থা করার মতো সামর্থ ছিলনা বলেই সব সহ্য করতাম। আসলে সহ্য করতাম , কথাটা ঠিক না। সহ্য করতাম না বলেই তো নানা রকম ঝামেলা হতো।
একটু থেমে এ্যলেন, আমার মুখের দিকে তাকালো। ঠোটে লজ্জার রেখা টেনে হঠাৎ বললো-
: এই এখনও তো একই পরিস্থিতি।
পারিনা থাকার জন্য একটা জায়গার ব্যবস্থা করতে। তাইতো তোমার আমাকে সহ্য করতে হচ্ছে।
: বাদ দাও তো , ও সব কথা। তোমার কথা বলো।
: আরে, আমার কথাই তো বলছি।
: আমি বলছি, তোমার অতীতের কথা বলতে। আর যদি বলতে না চাও, তবে আমি উঠলাম।
: এই ছাড়াছাড়ির পর থেকে আমার মা , আমাকে সহ্য করতে পারতেন না, তার ধারনা জন্মে ছিল আমি ইচ্ছে করেই এমন সব কাজ করতাম যা আমার মায়ের আশপাশের মানুষগুলো পচ্ছন্দ করেনা । আর আমার এমন করার কারন মাকে একলা জীবনযাপন করানো।
: আমি আমার মায়ের কাছাকাছি থাকতে চাই কিন্তু তাই বলে তাকে কখন দুঃখী দেখতে চাইনি।
আমার মায়ের এই রকম আচরন, তার সন্দেহ, আর একাকীত্বের কষ্ট আমাকে দিশেহারা করে দিচ্ছিল। সে কারনেই একদিন সিদ্ধান্ত নেই, একা চলবার। আর তার পরিনাম, বর্তমান অবস্থাটা তো দেখতেই পাচ্ছো।
: তোমার মা কি এখন সুখে আছে? মানে বলতে চাচ্ছিলাম, উনি কি এখন উনার বর্তমান সময়ে তৃপ্ত?
: জানি না তো, কখোনো জিঞ্জেস করিনি এভাবে। হয়তো ভয়ও হয় জানতে, উনি যদি আমাকে তার অবস্থার জন্য দায়ী করে?
: তুমি তো জান, তোমার দোষ কতটুকু, তোমার চাওয়াটা কতটা ন্যায় সংগত ছিল, তাহলে তোমার কিসের ভয়?
: হয়তো যতটুকু আছে , তা হারাবার ভয়।
: যতটুকু আছে, তার চেয়ে বেশিও তো পেতে পারো।
: তুমি না পাগল। সারাক্ষন কল্পনার জগতে থাকতে থাকতে সবাইকে তোমার মতো করে ভাবতে শুরু করে দিয়েছো। তুমি কি ভাবো, সবাই তোমার মতো আরেকজনের সুবিধা-অসুবিধা দেখে বেড়ায়? নিজের কথা ভাবেনা?
: না , আমিও তো নিজের কথা ভাবি। এই যে দেখছোনা, তোমার অতীত - ইতিহাস সব জেনে নিচ্ছি।
তারপর একটা সিনেমা বানাবো।
তুষারের দেশে, আমার এক একটা দিন- পঞ্চম পর্ব
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।