বছরখানেক পর দেশে। বন্ধু শাজাহানের শান্তিনগরের বাসায় ভুড়িভোজন হলো। তারপর গল্প করতে করতে বিকেল অতিক্রম। এবার ফেরার পালা। রিকশা নিলাম একটা।
সেটি বারবারই আটকে যায় ট্রাফিক জ্যামে। আমি নিজের ভাবনায় নিমগ্ন থেকেই এদিক সেদিক তাকাই। পুব-পশ্চিমে উড়াউড়ি, কাছের মানুষ, দূরের মানুষ, ঢাকার রাস্তাঘাট- রাজনীতি, এগুলোই তো পরবাসী জীবনের নাইয়র ভাবনা। এরই মাঝে সামনের রিক্সা থেকে এক লোক বলে উঠলেন,
- স্লামালিকুম ভাই। আমাকে চিনতে পারছেন?
সালামের উত্তর দিয়ে ঢাকার রাস্তার আলো আঁধারের মাঝে চমকে ফিরে তাকালাম।
তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মতো বয়েস। বেশ ফিটফাট চেহারা ও পোশাক। কিন্তু পরিচিত বলে মনে হলো না। সালামের উত্তর দিয়ে সেটিই জানালাম তাকে।
- আমার নাম জহির।
আমি শান্তিবাগের তুষারের বড়ো ভাই। চিনলেন না আমাকে?
- না।
- আপনি শান্তিবাগে থাকেন না।
- আমি শান্তিবাগেই থাকি।
- আমি তুষারের বড়োভাই।
- আমি তুষারকেও চিনি না।
- সত্যিই চিনেন না?
- না, চিনলে তো আগেই বলতাম!
অনেকটা বিরক্ত উত্তর আমার। তারপরও কাউকে চিনতে না পারার এক অস্বস্তি ঘিরে থাকল আমাকে। জ্যামে মাঝে মাঝে আটকে এগিয়ে চলল রিকশা। একমসয় লোকটির কথা ভুলে নিজের ভাবনায় ডুবে গেলাম আবার।
জ্যাম পেরিয়ে শহিদবাগের সামনে এসে বাঁদিকে মোড় নিল আমার রিকশা। রাজারবাগ পুলিশ ফাঁড়ির সামনে বেশ অন্ধকার। জ্যামও কমে এসেছে অনেকটা। পেছন থেকে একটি রিকশা এসে থামল আমার রিকশার সামনে। রিকশা থেকে নেমে সেই একই লোক আমার সামনে নেমে হাত বাড়িয়ে দিল।
- আপনি আমাকে চিনতে পারলেন না, তাই ভালো করে আলাপ করতে এলাম।
- আলাপ করার তো কিছুই নেই। আমার মনে পড়ছে না, ব্যাস!
- আমি তুষারের বড়োভাই।
- হ্যা, সেটি কয়েকবারই শুনলাম।
- তুষারের কথা আপনার মনে নেই?
- না।
- আমাকেও চিনতে পারছেন না?
- না।
এবার আরও দুজন এগিয়ে এলো অন্ধকার ফুঁড়ে। একজন বলল,
- ও যা বলে, করবেন। নইলে বিপদ আছে।
- কী ব্যাপার! আমি তাকে চিনতে পারছি না বলে বিপদ হবে কেন?
- সে টা পরে দেখবেন।
বলেই সামনে থেকে সরে গেল লোকটি। আগের লোকটি তখনও আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে। আমার বিরক্তি তখন চরমে। বললাম,
- যথেষ্ট হয়েছে। আপনাকে ও আপনার ভাইকে আমি চিনি না।
এবার হাত ছাড়েন, বাড়ি যাব।
এবার আরেকটু কাছে এগিয়ে এলো লোকটি। মনে হলো কোনো গোপন কথা যেন বলতে চাইছে।
- আমি একটা কথা বলছি, ভলো করে শোনেন!
- হ্যা, শুনছি।
- আমাকে চিনতে পারছেন না।
- হ্যা, এইমাত্রই তো চিনলাম। আপনি জহির, তুষারের ভাই। কিন্তু তুষারকে আমি চিনি না।
- তুষারকে চেনার কোনো দরকার নাই আপনার।
- ঠিক, তাহলে হাত ছাড়েন, বাড়ি যাই
- বাড়ি তো যাবেনই।
তার আগে একটা কথা শুনে যান।
- বলুন, শুনছি।
- তুষার-টুসার কিছু নয়!
- তাহলে কী?
- আমি একটা সন্ত্রাসী দলের লোক। খবর পেয়েছি, আপনার কাছে এক লাখ টাকা আছে। তাই আপনাকে ধরেছি।
লোকটি কথা শুনে হঠাৎ বেশ আওয়াজ করেই হেসে ফেললাম। হাসি শুনে যেন একটু চমকেই উঠল লোকটি। এক লাখ টাকা নেই, মিথ্যে বলতে হচ্ছে না, সেটি ভেবেই হয়তো আমার এই হাসি। হাসতে হাসতেই বললাম,
- এক লাখ টাকা আমার কাছে নেই! আপনাকে কে এই খবর দিয়েছে? তুষার? খবরটি একেবারেই ভুল।
- এক লাখ টাকা নেই আপনার কাছে?
- না, ব্যাগ খুলে দেখতে পারেন।
।
- আমাকে চিনতেও পারছেন না।
- আপনি নিজেই তো বললেন, আপনি তুষারের ভাই, এক সন্ত্রাসী।
- তার মানে, আপনি আমাকে চেনেন?
- আপনাকে এইমাত্র চিনলাম, আপনি জহির, তবে তুষারকে আমি মনে করতে পারছি না।
- কিন্তু আমাকে তো চিনলেন।
- হ্যা, আপনি সন্ত্রাসী, কিন্তু আমার কাছে এক লাখ টাকা তো নেই।
-
এই আলো আঁধরের মাঝেই কেমন এক হতাশার ছায়া দেখতে পেলাম লোকটির চেহারায়। সেই সাথে একটু অপ্রস্তুত ভয় ভয় ভাব। “ঠিক আছে ভাই, যান!”, বলে রিকশাওয়ালাকে ইশারা দিল এগিয়ে যাবার জন্যে। আমিও ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরে এলাম।
কার কবলে পড়েছিলাম, সেটা তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু কী কারণে আমাকে ছেড়ে দিল, সেটি খুঁজে বের করতে গিয়ে কোনো কুল কিনারা পেলাম না। ঢাকার রাস্তায় হাইজ্যাকাররা এত সহজে কাউকে ছেড়ে দেয়, এমন কখনোই শুনিনি। হতে পারে, সন্ত্রাসীর সামনে হাসতে পারে, এমন কাউকে সন্ত্রাসীরাও আজ অবধি পায়নি। তাতেই হয়তো ঘাবড়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।
পরে, আরও ভাবনা চিন্তার পর আসল কারণটি খুঁজে বের করলাম। এরা যে সন্ত্রাসী, সেটি বুঝতে ঢাকার মানুষের এতোটা সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু আমাকে তা বোঝাতেই বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে ওদের। নইলে সন্ত্রাসীর সামনে কোন গর্দভ এমন ভাবে হাসতে পারে? আমাকে আটকে এতোটাই বিব্রত লোকটি, যদি সন্ত্রাসীদের কোনো আইডেন্টিটি কার্ড থাকতো, সেটিই বের করতো। তাই মনে হয়, সন্ত্রাসীদের জন্যে আইডেন্টিটি কার্ড চালু করা দরকার।
তাতে ওদেরও সুবিধা হয়, আমরাও সহজেই ওদেরকে চিনতে পারব।
এর পর আরও তিনদিন ঢাকায় ছিলাম। সন্ধ্যার পর আমার ভাইবোনেরা আমাকে কখনোই আর একা বেরুতে দেয়নি। অথচ মতিঝিলে আমার বড়োবোনের বাড়িতে শহীদবাগের মোড় পেরিয়ে রাজারবাগের সামনে দিয়েই আসাযাওয়া করতে হয়। সেখানে যাবার জন্যে সার্বক্ষণিক পাহারাদার পেলাম।
সে বেশ ভীতু চরিত্রের মানুষ হিসেবে পরিচিত আমারই ছোটোবোন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।