হলমার্ক কেলেঙ্কারির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার গভীর সংকট প্রতিফলিত হয়েছে। এ বিষয়ে কী করণীয়, তা নিয়ে মতামত দিয়েছেন একজন ব্যাংকার ও একজন অর্থনীতিবিদ
বাংলাদেশে পুঁজি সঞ্চয়-প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঋণ জালিয়াতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ৪১ বছর আগে এ দেশে কোটিপতির সংখ্যা কত ছিল এবং আজকে কতজন? এখন কেবল কোটিপতি নন, হাজার হাজার কোটি টাকার মালিকই আছেন অনেকজন। পুঁজি যখন প্রাথমিকভাবে সঞ্চিত হয়, তখন এই লুণ্ঠন আর তস্করবৃত্তির মাধ্যমেই হয়। আজকে বাংলাদেশে ঋণ খেলাপ, ভূমিদস্যুতা, কালোবাজারি, চোরাকারবারসহ দুর্নীতিই বিত্ত অর্জনের প্রধান পথ।
এটা তখনই সম্ভব হয়, যখন রাষ্ট্র সরাসরি এসব কাজে সহযোগিতা করে। রাষ্ট্রের যাঁরা প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁরা এর সঙ্গে জড়িত। রাজনৈতিক লোকেরা আভাসে-ইঙ্গিতে চাপে-প্রভাবে এসব কার্যকলাপের জন্য সুযোগ তৈরি করে দেন। এঁদের চাপে অনেক সৎ কর্মকর্তার জন্য কাজ করা কঠিন হয়। অনেকে চাপে পড়েও অসৎ হয়ে যান।
এই সমস্যা একদিনের নয়। ’৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত এটাই চলছে।
কোনো ব্যবসায়ী যখন ঋণ নিতে আসেন, তখন ব্যাংকের কর্মকর্তার উচিত তাঁর চরিত্র, তাঁর অতীত কর্মকাণ্ড এবং তাঁর অন্যান্য ব্যবসা-সম্পর্কিত তথ্যগুলো ভালোভাবে জানা। ঋণগ্রহীতার ব্যবসায়িক আচরণ জানা না থাকলে ভুল লোকের কাছে অর্থ চলে যেতে পারে। তার মানে সৎ উদ্যোক্তা নেই, তা নয়।
সৎ উদ্যোক্তাদের কারণেই বিভিন্ন খাতে আমরা সক্ষমতা ও প্রবৃদ্ধি লক্ষ করছি। যেকোনো ব্যাংকের জন্য কুঋণ একটা বোঝা। অন্যদিকে কোনো সুনির্দিষ্ট একটা গ্রুপ বা কোম্পানিকে উপর্যুপরি ঋণ দেওয়া মানে বিরাট ঝুঁকি নেওয়া। জেনেশুনে এটা কেন করা হবে? এতে একদিকে ব্যাংকের পুঁজি খোয়া যাওয়ার ঝুঁকি, অন্যদিকে যাঁরা ভালো উদ্যোক্তা তাঁরা আটকে যান, ঋণ চেয়েও পান না বা বঞ্চিত হন। এ কারণে অর্থনীতির বিকাশে দরকারি খাতগুলোয় পুঁজির জোগানে সমস্যা সৃষ্টি হয়।
ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ তো রাজনৈতিক দলের কমিটির মতো হলে হবে না। এটাকে অবশ্যই পেশাদারদের দিয়ে গঠিত হতে হবে। যাঁরা ব্যাংকিং বোঝেন, যাঁদের সুনাগরিক হিসেবে সুনাম আছে, তাঁদের নিয়েই এটা গঠিত হতে হবে। আমি যে সময় সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলাম, সে সময় নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী ও দক্ষ মানুষ দিয়ে পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হয়েছিল। তবে আগে থেকেই জিইয়ে থাকা অনেক সমস্যার দায় আমাদেরও বহন করতে হয়েছিল।
আমার পরামর্শ হলো, বিশুদ্ধভাবে পেশাদার এবং যাঁদের সততা সম্পর্কে সুনাম রয়েছে, তাঁদের নিয়েই পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা উচিত। এঁদের সামগ্রিক অর্থনীতি সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে।
এখন পর্যন্ত বড় ঋণ যেগুলো বা যেখানে যেখানে ব্যাংকের বিরাট অঙ্কের অর্থ জমা আছে, সেসব ভালোভাবে নিরীক্ষা করা এবং সেসবের সমস্যা চিহ্নিত করা দরকার। খেলাপি ঋণের বিষয়েও জাতীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এ কাজে আইনের দুর্বলতা দূর করার ব্যবস্থা থাকা উচিত।
ব্যাংকের ওপরে রাজনৈতিক প্রভাব একেবারে নিশ্চিহ্ন করতে হবে। ব্যাংককে ব্যাংকের মতো কাজ করতে দিতে হবে। ব্যাংকের কর্মকর্তারা যাতে নির্ভয়ে এবং জবাবদিহির সঙ্গে কাজ করতে পারেন, তা দেখতে হবে। রাজনীতির সংস্রব পরিহার করতে হবে। বাংলাদেশের মতো দেশে বহুদিনের পুরোনো ঋণ বা কুঋণ বিষয়ে জাতীয়ভাবে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বছরের পর বছর এই ঋণের জের কীভাবে টানব! যাঁদের কুঋণ আছে, তাঁদের অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণও বন্ধ করতে হবে। যাঁরা ভালো শিল্পপতি আছেন, তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। ব্যবসাকে যেমন টুঁটি চেপে ধরা যাবে না, আবার তাঁদের বল্গাহীনভাবেও চলতে দেওয়া যাবে না।
অনিয়ম ঠেকাতে অর্থঋণ আদালত করা হলো। কিন্তু সমস্যা হলো, এই আদালতে প্রতিপক্ষ যদি দুই লাখ টাকা দিয়ে আইনজীবী নিযুক্ত করে আর ব্যাংকের আইনজীবী মাত্র দুই হাজার টাকা পান, তাহলে ফল কী হবে তা বুঝতে পারার কথা।
দেখা গেল, অর্থঋণ আদালতে করা মামলাগুলো উচ্চ আদালতে গিয়ে আটকে থাকল কিংবা খেলাপি ব্যক্তি জিতে গেলেন।
দেশের সার্বিক আর্থিক শৃঙ্খলা রাখার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। সুতরাং তারা নির্দেশনা-পরামর্শ এবং অনুসন্ধান চালাতেই পারে। এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী যে উষ্মা প্রকাশ করেছেন, সেটা যথার্থ নয়। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তো অর্থ মন্ত্রণালয়কেই অনুরোধ করেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন ব্যাংক বিভাগেরই উচিত ছিল সেই বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া। এখন হলমার্ক বিষয়ে যত রকম আইনি ব্যবস্থা আছে, সব প্রয়োগ করতে হবে। আইনে ত্রুটি থাকলে সেটা সংস্কার করতে হবে। ব্যাংকিং খাতের সংস্কার নিয়ে বিভিন্ন সময় যেসব সুপারিশ এসেছে, সেসব নিয়ে কাজ করার সুযোগ আছে। তবে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতকে শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই।
ড. মাহবুবউল্লাহ: অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক। সাবেক চেয়ারম্যান, সোনালী ব্যাংক।
সূত্র: ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।